ঢাকার একটি ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে, এক চায়ের দোকানে গল্প জমে উঠেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে একদল তরুণ। তবে তাদের আলোচনা শেয়ার মার্কেট বা চাকরির বাজারের গ্লানি নিয়ে নয়। কথা হচ্ছে একটি মোবাইল অ্যাপ নিয়ে, যেটি দেশের ছোট কৃষকদের ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করবে। আশেপাশে বসা আরেক টেবিলে দুজন তরুণী আলোচনা করছেন একটি এডটেক প্ল্যাটফর্মের প্রোটোটাইপ নিয়ে। এটা শুধু একটি দৃশ্য নয়, এটা বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ বিপ্লবের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। দেশজুড়ে একঝাঁক উদ্যমী তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ গড়ে তুলে শুধু অর্থনীতির চেহারা বদলাচ্ছেন না, সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা সমস্যার সমাধানও বের করে আনছেন উদ্ভাবনী চিন্তা দিয়ে। এই যাত্রা শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যের নয়, একটি জাতির আত্মবিশ্বাস ও সম্ভাবনার গল্প।
স্টার্টআপ বিপ্লবের বীজ বপণ: কীভাবে শুরু হলো?
বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ জগতের এই বিস্ফোরণ হঠাৎ করে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ প্রস্তুতি, প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, একটি সরকারি নীতির দৃঢ় প্রত্যয়। ২০১৮ সালে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশনকে ত্বরান্বিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার চালু করে ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’। এই সংস্থা এককভাবে দেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের গতিপথ বদলে দিয়েছে। এর লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট: তরুণ উদ্ভাবকদের আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপের ব্যবস্থা করা।
- সরকারের বলিষ্ঠ ভূমিকা: আইসিটি বিভাগের অধীনে ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ শুধু ফান্ডই দেয়নি, গড়ে তুলেছে একটি সম্পূর্ণ সহায়ক অবকাঠামো। দেশের ৮টি বিভাগে ‘ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনারশিপ একাডেমি (আইডিয়া)’ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে পাওয়া যায়:
- বিশ্বমানের কো-ওয়ার্কিং স্পেস
- প্রোটোটাইপ তৈরির জন্য ল্যাব সুবিধা (3D প্রিন্টিং, IoT ল্যাব)
- অভিজ্ঞ মেন্টরদের গাইডেন্স
- বিনিয়োগকারীদের সাথে সংযোগের (networking) প্ল্যাটফর্ম
- আইনি ও ব্যবসায়িক পরামর্শ সেবা
- ডাটা বলে সাফল্যের গল্প: সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ ইতিমধ্যে ৫০০+ স্টার্টআপকে বিনিয়োগ ও সহায়তা দিয়েছে, যা সৃষ্টি করেছে ১৫,০০০+ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান (সূত্র: স্টার্টআপ বাংলাদেশ অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, সর্বশেষ আপডেট ২০২৪)। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
- বিনিয়োগের ঢল: শুধু সরকারি ফান্ডিং নয়, দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগও (VC Funding) উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। লাইটক্যাস্টের ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম রিপোর্ট ২০২৩’ অনুসারে, বাংলাদেশে ১,৫০০+ সক্রিয় স্টার্টআপ রয়েছে, যারা ২০২২ সালে $১০০ মিলিয়ন+ বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় (সূত্র: LightCastle Partners)। এই প্রবণতা ২০২৪ সালেও অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ গুলোর সাফল্য শুধু সংখ্যায় নয়, বৈচিত্র্য ও প্রভাবেও।
যেসব নতুন স্টার্টআপ বদলে দিচ্ছে খেলার মাঠ
বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ গুলো শুধু মুনাফার পিছে ছোটে না। তারা দেশের নিত্যদিনের সমস্যা সমাধানে নেমেছে, তৈরি করছে টেকসই প্রভাব (Impact)। বিভিন্ন সেক্টরে তাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি:
- ফিনটেক (FinTech): আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নায়ক:
- নগদ (Nagad): ডিজিটাল ওয়ালেট ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার। রেকর্ড সময়ে কোটি কোটি বাংলাদেশিকে ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে থেকে ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের আওতায় এনেছে। এটি এখন একটি ‘ইউনিকর্ন’ (বিনিয়োগ মূল্য $১ বিলিয়ন+)।
- বক্সী (bKash): অগ্রদূত হিসেবে মোবাইল ফাইন্যান্স সেক্টরকে জনপ্রিয় করে তোলা। গ্রামীণফোন, বিটিআরসি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে সমন্বয়ে কাজ করে।
- ১০ মিনিট স্কুল (10 Minute School): দেশের সর্ববৃহৎ অনলাইন এডুকেশন প্ল্যাটফর্ম। সাশ্রয়ী মূল্যে সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য ভিডিও লেকচার, লাইভ ক্লাস, স্কিল ডেভেলপমেন্ট কোর্সের সুযোগ তৈরি করেছে। লাভজনক হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করছে।
- লজিস্টিক্স ও ই-কমার্স (Logistics & E-commerce): সাপ্লাই চেইনের রূপান্তরকারী:
- প্যাথাও (Pathao): শুরু রাইড-শেয়ারিং দিয়ে, এখন ফুড ডেলিভারি, কুরিয়ার সার্ভিস, এমনকি ডিজিটাল পেমেন্টেও সক্রিয়। শহুরে জীবনযাত্রাকে সহজ করেছে।
- শোহোজ (Shohoz): বাস-লঞ্চ টিকেট বুকিং, রাইড-শেয়ারিং, ফুড ডেলিভারি ও হোম সার্ভিসের সুবিধা একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে। ভ্রমণকে করেছে দুঃসাধ্যতা মুক্ত।
- চালডাল (Chaldal): অনলাইনে পাইকারি মূল্যে তাজা শাকসবজি, মাছ-মাংস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। কোভিড মহামারীর সময় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
- কৃষি প্রযুক্তি (AgriTech): কৃষকের নতুন আশা:
- এগ্রোশিকার (AgroSikar), ফার্মফ্রেশ (FarmFresh): সরাসরি কৃষকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে, ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করছে এবং শহরের ভোক্তাদের কাছে তাজা পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমিয়ে কৃষকের আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
- ট্রল (TROI): আইওটি (IoT) সেন্সর ও ডাটা এনালিটিক্স ব্যবহার করে কৃষকদের ফসলের সঠিক সময়ে সেচ দেওয়া, সার প্রয়োগ ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করছে। ‘স্মার্ট ফার্মিং’-এর ধারণা বাস্তবায়ন করছে।
- স্বাস্থ্যসেবা (HealthTech): ডাক্তার হাতের মুঠোয়:
- প্র্যাকটো (Prakti), ডক্টরোলা (Doctorola): টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ পাচ্ছেন ঘরে বসে। মেডিসিন ডেলিভারি, ল্যাব টেস্ট বুকিংয়ের সুবিধাও দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার সুযোগকে করেছে সর্বজনীন।
- ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড: যদিও বড় কর্পোরেশন, তাদের মেডিকেল ডিভাইস রিসার্চ ও ম্যানুফ্যাকচারিং (যেমন: ডায়ালিসিস মেশিন, ডিজিটাল এক্স-রে) দেশে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় কমিয়ে আনার প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করছে।
- শিল্পক্ষেত্র (Industry 4.0): উৎপাদনে ডিজিটাল রূপান্তর:
- সহজ (Sohoj): তৈরি পোশাক শিল্পের (RMG) জন্য এআই-ভিত্তিক সফ্টওয়্যার সলিউশন তৈরি করছে, যা উৎপাদন দক্ষতা, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ও সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব আনছে।
- স্মার্ট মেশিনারি ডেভেলপমেন্ট: বিভিন্ন স্টার্টআপ দেশীয় চাহিদা মেটাতে স্বল্প খরচে ও উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন শিল্প যন্ত্রপাতি ডিজাইন ও উৎপাদনে মনোযোগ দিচ্ছে।
বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ গুলোর বৈশিষ্ট্য: | বৈশিষ্ট্য | বিবরণ | উদাহরণ |
---|---|---|---|
সমাধান-ভিত্তিক | স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিত করে তার টেকসই সমাধান অফার করে। | এগ্রোশিকার (কৃষকের আয় বৃদ্ধি), প্র্যাকটো (সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা) | |
প্রযুক্তি নির্ভর | মোবাইল অ্যাপ, ক্লাউড কম্পিউটিং, AI, IoT, ডাটা এনালিটিক্সের সক্ষম ব্যবহার। | প্যাথাও, ট্রল, সহজ | |
সামাজিক প্রভাব | আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা প্রসার। | নগদ, ১০ মিনিট স্কুল, ডক্টরোলা | |
তরুণ নেতৃত্ব | অধিকাংশের প্রতিষ্ঠাতাই তরুণ, উদ্যোগী, বিশ্বব্যাপী চিন্তা করতে সক্ষম। | অধিকাংশ স্টার্টআপ | |
স্থিতিস্থাপকতা | কোভিড মহামারীর মতো সংকটেও দ্রুত অভিযোজিত হতে পেরেছে। | চালডাল, শোহোজ, টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্ম |
সাফল্যের পথে বাধা: চ্যালেঞ্জগুলো কোথায়?
যদিও বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ গুলোর অগ্রযাত্রা উৎসাহব্যঞ্জক, তাদের সামনে এখনও বেশ কিছু বড় বাধা দাঁড়িয়ে আছে:
- বিনিয়োগের ধারা টিকিয়ে রাখা (Sustaining Funding Flow): প্রাথমিক পর্যায়ের (Seed/ Angel) বিনিয়োগ কিছুটা সহজলভ্য হলেও, গ্রোথ স্টেজে (Series A, B এবং তার পর) পর্যাপ্ত বড় অংকের বিনিয়োগ পাওয়া এখনও চ্যালেঞ্জিং। স্থানীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (VC) ফার্মের সংখ্যা ও তহবিলের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য রেগুলেটরি জটিলতা ও এক্সিট অপশনের (Exit Option – যেমন: IPO সুবিধা) সীমাবদ্ধতা উদ্বেগের কারণ।
- দক্ষ জনবলের সঙ্কট (Talent Crunch): বিশেষ করে ডিপ টেক (AI, ML, ডাটা সায়েন্স, সাইবার সিকিউরিটি) এবং উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট, ডিজাইন ও মার্কেটিং এক্সপার্ট খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিদেশমুখী মেধা প্রবাহও (Brain Drain) একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ও শিল্পের চাহিদার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো দরকার।
- জটিল নিয়ন্ত্রণ কাঠামো (Regulatory Hurdles): বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও রেগুলেটরি বডির (বিবিআর, বিএসইসি, বিটিআরসি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইত্যাদি) সাথে কাজ করতে গিয়ে নীতির অস্পষ্টতা, দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং কখনও কখনও ঐতিহ্যগত ব্যবসার সাথে সমন্বয়ের অভাব স্টার্টআপদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। ‘টেস্টিং স্যান্ডবক্স’ বা নমনীয় রেগুলেটরি পরিবেশের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
- বাজার ও গ্রাহক আচরণ (Market Size & Customer Behavior): ডিজিটাল লেনদেনে অনীহা, ক্যাশ অন ডেলিভারির (COD) উপর অত্যধিক নির্ভরতা, সাবস্ক্রিপশন মডেলের প্রতি কম আগ্রহ এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার (Digital Literacy) সীমাবদ্ধতা বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, ব্যবসার স্কেলিংকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।
- মেন্টরশিপ ও নেটওয়ার্কিংয়ের অভাব: অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা, শিল্প বিশেষজ্ঞ এবং বৈশ্বিক বাজারের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য শক্তিশালী মেন্টরশিপ নেটওয়ার্কের প্রয়োজনীয়তা এখনও পুরোপুরি পূরণ হয়নি।
ভবিষ্যতের পথচলা: সম্ভাবনার দিগন্ত
চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। নিম্নলিখিত দিকগুলোই এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে:
- ডিপ টেকের উত্থান (Rise of Deep Tech): কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং (ML), ব্লকচেইন, ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) এবং রোবোটিক্সের মতো প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আরও জটিল ও স্কেলেবল সমস্যার সমাধান করবে ভবিষ্যতের স্টার্টআপগুলো। ক্লাইমেট টেক (Climate Tech), ক্লিন এনার্জি, বায়োটেক ও স্পেস টেকের মতো ক্ষেত্রেও সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে।
- বeyond ঢাকা (Expansion Beyond Dhaka): দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর (চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ) এবং জেলা শহরগুলোতেও স্টার্টআপ হাব গড়ে উঠছে। স্থানীয় সমস্যাগুলোকে কেন্দ্র করে স্থানীয় তরুণদের নিয়ে গড়ে উঠবে নতুন উদ্যোগ। আইডিয়া ল্যাবগুলো এই প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
- মহিলা উদ্যোক্তৃত্বের জোয়ার (Rise of Women Entrepreneurs): নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি বিশেষ প্রণোদনা, ফান্ডিং এবং নেটওয়ার্কিং সুযোগ (যেমন: বাংলাদেশ উইমেন ইন টেক – BWIT) তাদের এই যাত্রাকে ত্বরান্বিত করছে। শোহোজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মালিহা এম কাদের, চালডালের ওয়াসিউল হক শীষীর মতো সফল উদাহরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে।
- সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্ব (Enhanced Public-Private Partnership): সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা এবং বেসরকারি খাতের (ব্যাংক, কর্পোরেট হাউস, মোবাইল অপারেটর) আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ ও বিনিয়োগ ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করবে। ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ এর পরবর্তী ফেজগুলোতে আরও বড় বাজেট ও পরিকল্পনা আশা করা যায়।
- গ্লোবাল অ্যাম্বিশন (Global Footprint): অনেক বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ এখনই আঞ্চলিক (ভারত, নেপাল, ভুটান, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য) এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনা করছে। তাদের উদ্ভাবনী মডেল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকতে সাহায্য করবে। প্যাথাও ইতিমধ্যে নেপালে অপারেশন শুরু করেছে।
বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে টেকসই করতে করণীয়:
- বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন: স্থানীয় ভিসি ইন্ডাস্ট্রিকে শক্তিশালী করা, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য রেগুলেটরি সহজীকরণ, স্টক এক্সচেঞ্জে স্টার্টআপ তালিকাভুক্তির (IPO) পথ সুগম করা।
- মেধা বিকাশ: বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প সহযোগিতা জোরদার করা, ডিপ টেক ও সফট স্কিলে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা, বিদেশে পাড়ি জমানো মেধাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া।
- স্মার্ট রেগুলেশন: ‘ফেইল ফাস্ট, লার্ন ফাস্ট’ সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করতে নমনীয় রেগুলেটরি স্যান্ডবক্স তৈরি করা, ডাটা প্রাইভেসি ও সাইবার সিকিউরিটির জন্য পরিষ্কার নীতিমালা প্রণয়ন।
- ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি: দেশের সর্বত্র উচ্চগতির ইন্টারনেট ও ডিজিটাল সাক্ষরতা নিশ্চিত করা, ডিজিটাল লেনদেনকে আরও নিরাপদ ও সহজ করা।
- সহযোগিতার সংস্কৃতি: বড় কর্পোরেশন, শিল্প সংগঠন (বিকাশ, BASIS, BACCO) এবং একাডেমিয়ার মধ্যে জ্ঞান বিনিময় ও সহযোগিতার মঞ্চ তৈরি করা।
বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন নয়; এরা সমাজের গতানুগতিক চিন্তাধারা ভাঙছে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে, তরুণ প্রজন্মকে আত্মকর্মসংস্থানে উৎসাহিত করছে এবং বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে একটি গতিশীল, উদ্ভাবনী ও ডিজিটাল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করছে। প্রতিটি সফল স্টার্টআপ হাজার হাজার তরুণের মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দিচ্ছে। এটি এমন এক বিপ্লব, যা কেবল ডিজিটালাইজেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি একটি মানসিকতার পরিবর্তন, সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ এবং বিশ্বাস যে, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ শুধু পোশাকের ট্যাগ নয়, ভবিষ্যতের টেক জায়ান্টেরও নাম হতে পারে। এই যাত্রায় সবার অংশগ্রহণ – বিনিয়োগকারী, নীতিনির্ধারক, অভিজ্ঞ পেশাজীবী এবং সাধারণ ভোক্তা – একান্ত কাম্য। বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ এর এই উদ্দাম যাত্রাকে এগিয়ে নিতে, আপনার আশেপাশের প্রতিভাবান তরুণকে উৎসাহ দিন, স্থানীয় স্টার্টআপের পণ্য-সেবা ব্যবহার করে সমর্থন জানান, এবং নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা উদ্ভাবনী চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে আজই হাত লাগান। কারণ, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়ার এই মহাকাব্যে, আপনিও হতে পারেন একজন নায়ক।
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: বাংলাদেশে স্টার্টআপের সংজ্ঞা কী? সরকারি সহায়তা পেতে কী শর্ত?
উত্তর: সাধারণত, বাংলাদেশে স্টার্টআপ বলতে বোঝায় এমন নিবন্ধিত ব্যবসা যা ৮ বছরের কম পুরনো, বার্ষিক টার্নওভার ১৫ কোটি টাকার কম, এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি/মডেল ব্যবহার করে নতুন ধরনের পণ্য-সেবা প্রদান করে। ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’-এর সহায়তা পেতে প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধিত হতে হবে, উদ্ভাবনী ও স্কেলযোগ্য মডেল থাকতে হবে, এবং টিমের দক্ষতা ও সম্ভাবনা যাচাই করা হবে। বিস্তারিত শর্তাবলী স্টার্টআপ বাংলাদেশ ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের কোন কোন সেক্টরে নতুন স্টার্টআপের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা আছে?
উত্তর: ফিনটেক (ডিজিটাল ব্যাংকিং, ইনসুরটেক), হেলথটেক (টেলিমেডিসিন, হেলথ ডেটা এনালিটিক্স), এডটেক (অনলাইন লার্নিং, স্কিল ডেভেলপমেন্ট), এগ্রোটেক (স্মার্ট ফার্মিং, ফার্ম-টু-কনজিউমার মার্কেটপ্লেস), লজিস্টিক্স ও সাপ্লাই চেইন, ক্লিনটেক ও রিনিউয়েবল এনার্জি, এবং ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ (এআই, IoT, অটোমেশন) সেক্টরগুলোতে বাংলাদেশের নতুন স্টার্টআপ গুলোর জন্য বিশাল সুযোগ ও চাহিদা রয়েছে।
প্রশ্ন: ধারণা আছে, কিন্তু প্রাথমিক মূলধন (Seed Funding) পাব কোথায়?
উত্তর: প্রাথমিক পর্যায়ে ফান্ডিংয়ের উৎস হতে পারে:
- ব্যক্তিগত সঞ্চয়, বন্ধু-পরিবার (Friends, Family & Fools – FFF)
- এঞ্জেল ইনভেস্টর (Angel Investors – ধনী ব্যক্তিবর্গ যারা প্রারম্ভিক ধারণায় বিনিয়োগ করেন)
- সরকারি অনুদান ও প্রতিযোগিতা (স্টার্টআপ বাংলাদেশ, আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন ফান্ড, বিভিন্ন ইন্স্যুরেন্স ফান্ড যেমন ‘হ্যাচারি’র প্রতিযোগিতা)
- প্রি-সিড এক্সিলারেটর প্রোগ্রাম (যেমন: GP Accelerator, LightCastle的 WTEF প্রোগ্রাম)
- ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম (তবে বাংলাদেশে এখনও সীমিত)।
প্রশ্ন: স্টার্টআপের আইনি কাঠামো (Legal Structure) কীভাবে ঠিক করব? কোম্পানি নিবন্ধন জটিল কি?
উত্তর: সাধারণত প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি (Private Limited Company) স্টার্টআপের জন্য আদর্শ, কারণ দায় সীমিত থাকে এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ সহজ হয়। বাংলাদেশে কোম্পানি নিবন্ধন আগের চেয়ে সহজ হয়েছে, অনেকটা অনলাইনেই করা যায় RJSC পোর্টালের মাধ্যমে। তবুও একজন অভিজ্ঞ কোম্পানি সেক্রেটারি বা আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া উচিত ট্যাক্স (VAT, TIN), কর্মী নিয়োগ আইন এবং স্টার্টআপের জন্য প্রযোজ্য বিশেষ নিয়মাবলী (যদি থাকে) বুঝতে। ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ সহ অনেক সংস্থা আইনি সহায়তা দেয়।
প্রশ্ন: স্টার্টআপ ব্যর্থ হলে কী হবে? বাংলাদেশে ‘ফেইলিওর’কে কীভাবে দেখা হয়?
উত্তর: ব্যবসায় ব্যর্থতা বিশ্বব্যাপী স্টার্টআপ জার্নির একটি স্বাভাবিক অংশ। বাংলাদেশেও এই মানসিকতা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। ব্যর্থতা থেকে শেখার ও আবার চেষ্টা করার সাহসকে এখন অনেক বেশি উৎসাহিত করা হয়। অভিজ্ঞ উদ্যোক্তারা তাদের ‘ফেইলিওর স্টোরি’ শেয়ার করে অন্যকে সাহস জোগাচ্ছেন। সরকারি নীতিতেও ‘ব্যাংক্রাপ্টসি ল’ আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা চলছে যাতে ব্যর্থ উদ্যোক্তারা সহজে পুনরায় শুরু করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, আজকের অনেক সফল স্টার্টআপের পেছনে রয়েছে অতীতের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা।
প্রশ্ন: আমি একজন ছাত্র/পেশাজীবী, স্টার্টআপ শুরু করতে চাই। প্রথম ধাপ কী?
উত্তর: প্রথমেই আপনার ‘সমস্যা’ এবং ‘সমাধান’কে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করুন। গভীরভাবে মার্কেট রিসার্চ করুন। একটি সহজ প্রোটোটাইপ (Prototype) বা এমভিপি (Minimum Viable Product – MVP) বানান যেটার মাধ্যমে ধারণাটি পরীক্ষা করা যায়। আপনার টিম গঠন করুন (সহ-প্রতিষ্ঠাতা খুঁজুন যার দক্ষতা আপনার পরিপূরক)। ব্যবসায়িক মডেল (Business Model) ও আর্থিক সম্ভাব্যতা (Financial Projection) নিয়ে একটি মৌলিক প্ল্যান তৈরি করুন। এরপরই অনুসন্ধান শুরু করুন মেন্টরশিপ, ইনকিউবেটর প্রোগ্রাম এবং প্রাথমিক ফান্ডিংয়ের সুযোগের। ঢাকার বিভিন্ন স্টার্টআপ ইভেন্ট, মিটআপ ও ওয়ার্কশপে যোগ দিয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।