আপনি কি কল্পনা করতে পারেন এমন এক জায়গার, যেখানে প্রবালের আঁচলে জড়ানো নীল সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্ত রঙ ছড়ায় রক্তিম আলপনা? যেখানে পায়ের নিচের সাদা বালি গুনগুন করে গান গায়, আর প্রবাল-খচিত সৈকতে ভেসে আসা নোনাজলের গন্ধ মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীর আদিম সৌন্দর্যের কথা? বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এমনই এক স্বর্গরাজ্য, যেখানে প্রকৃতি তার সমস্ত মহিমায় উন্মোচিত হয়। এই ক্ষুদ্র প্রবালদ্বীপটিই আমাদের দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ, সমুদ্রের বুকে বসে থাকা এক জীবন্ত কবিতা, যার প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি নারিকেল গাছের ছায়া যেন বলে— “এসো, মুগ্ধ হও!”
Table of Contents
বাংলাদেশের অমূল্য রত্ন: সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক মহিমা
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠেছে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই নৈসর্গিক দ্বীপ। স্থানীয়ভাবে যাকে ডাকা হয় “নারিকেল জিঞ্জিরা”। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ নথিপত্রে প্রথম এই দ্বীপের উল্লেখ পাওয়া গেলেও, এর প্রাকৃতিক ইতিহাস হাজার বছর প্রাচীন। এখানকার অবিশ্বাস্য দর্শনীয় স্থান শুধু চোখ জুড়ায় না, হৃদয়কেও স্পর্শ করে গভীরভাবে। দ্বীপের পূর্ব পাশের ‘প্যাসেঞ্জার জেটি’ থেকে শুরু করে পশ্চিমের ‘চেরা দ্বীপ’ পর্যন্ত বিস্তৃত এই ভূ-স্বর্গে রয়েছে:
- প্রবাল প্রাচীরের রাজ্য: ৬৬ প্রজাতির প্রবাল (সরকারি সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের তথ্য) এখানকার সমুদ্রতলকে রূপ দিয়েছে এক জীবন্ত জাদুঘরে। গ্লাস বোটে চড়ে দেখতে পাবেন রঙিন মাছেদের অলীক নৃত্য, যেন পানির নিচে চলছে এক নীরব উৎসব।
- স্মৃতিতে গাঁথা সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত: উত্তরের ‘শীলা বীচ’ বা দক্ষিণের ‘কেওয়াক্রা পয়েন্ট’-এ বসে সূর্যের লালিমায় সমুদ্রের জল যখন রূপোলি হয়ে ওঠে, তখন মনে হয়— “এই দৃশ্য চিরকাল মনে থাকবে।”
- জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য: শীতকালে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয় দ্বীপ। সবুজ কচ্ছপ (Green Turtle) এর ডিম পাড়ার দৃশ্য বা ডলফিনের দলবদ্ধ খেলায় মাতোয়ারা হবেন আপনি।
২০২৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, এখানে বছরে ৫ লাখেরও বেশি পর্যটক আসেন, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়— ৭০% দ্বীপই এখনও অমর্যাদ! স্থানীয় মৎস্যজীবী জাহাঙ্গীর আলমের কথায়, “এখানকার সৌন্দর্য শুধু চোখে দেখার নয়, গায়ে লাগানোর। যখন জোয়ারের জল পায়ে ছুঁয়েছে, তখনি বুঝবেন— এ যেন মায়ের স্পর্শ!”
অবিশ্বাস্য দর্শনীয় স্থানের স্বর্গরাজ্য: সেন্ট মার্টিনের অদেখা কোণগুলি
সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য শুধু সমুদ্রসৈকতে সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রতিটি গলিপথ, প্রতিটি গ্রাম্য পথ আপনাকে নিয়ে যাবে এক অনন্য অভিজ্ঞতায়। এই অবিশ্বাস্য দর্শনীয় স্থান গুলো যেন প্রকৃতির আঁকা একেকটি মাস্টারপিস:
চেরা দ্বীপ: প্রবালের মায়াবী জগৎ
জোয়ারের সময় সমুদ্রে ডুবে যায়, ভাটায় হাঁটাপথে যাওয়া যায়— এই ক্ষণজন্মা দ্বীপটি সেন্ট মার্টিনের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য দর্শনীয় স্থান। এখানে প্রবালের তৈরি প্রাকৃতিক ব্রিজ, নীল লেগুন, আর বেলাভূমিতে জমে থাকা প্রবালের সাদা স্তূপ দেখে মনে হবে আপনি চাঁদের বুকে হাঁটছেন! স্থানীয় গাইড রাশেদুলের পরামর্শ: “ভাটার ২ ঘণ্টা আগে রওনা দিন। জোয়ারের সময় ফেরার পথ কেটে যায়— তখন মনে হবে সমুদ্র যেন আপনাকে আটকাতে চাইছে!”
সামুদ্রিক জীবন সংরক্ষণের লড়াই
দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয়দের ভূমিকা প্রশংসনীয়। ‘সেন্ট মার্টিন ইকো ট্যুরিজম সোসাইটি’ প্লাস্টিক মুক্ত দ্বীপ গড়তে কাজ করছে। পর্যটকদের জন্য তাদের বার্তা: “শুধু ফুটো করুন, কিছু নয়। প্রবাল ভাঙবেন না, কচ্ছপের ডিমের ঘাঁটিতে শব্দ করবেন না।” সরকারি উদ্যোগে প্রবাল সংরক্ষণ প্রকল্প চলছে— যা দ্বীপের ভবিষ্যৎ রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বপূর্ণ টিপস:
- নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ভ্রমণের আদর্শ সময় (সমুদ্র শান্ত থাকে)
- স্থানীয় হোটেলে থাকুন, সমুদ্রের শব্দে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা নিন
- সাইকেল ভাড়া করে ঘুরুন, প্রতিটি পথই সুন্দর
কেন সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য দর্শনীয় স্থান?
অন্যান্য প্রাকৃতিক স্থানের তুলনায় সেন্ট মার্টিনের বিশিষ্টতা হলো এর বৈচিত্র্য ও নাজুকতা। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বা বান্দরবানের পাহাড়ি ঝর্ণা যেমন আপনাকে প্রকৃতির শক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়, সেন্ট মার্টিন আপনাকে শেখায় নরম সৌন্দর্যের মাহাত্ম্য। এখানে:
- ভূতাত্ত্বিক বিস্ময়: প্রবাল প্রাচীর গঠিত এই দ্বীপের মাটি লবণাক্ত, তবুও নারিকেল গাছের সারি আপনাকে স্বাগত জানায়
- সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন: রাখাইন সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ বিহার, মসজিদ, মন্দির— সবই পাশাপাশি, যেন সৌন্দর্যের ধর্ম নেই
- রাতের জগৎ: চাঁদনী রাতে ফসফরেসেন্ট প্লাঙ্কটনের কারণে সমুদ্রের জল জ্বলজ্বল করে! এ যেন নক্ষত্রখচিত আকাশ নেমে এসেছে সমুদ্রে
পরিবেশবিদ ড. আতিক রহমানের মতে, “সেন্ট মার্টিন শুধু পর্যটন স্পট নয়, এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ। এর প্রতিটি প্রবাল, প্রতিটি বালুকণা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।”
আপনার ভ্রমণকে স্মরণীয় করতে টিপস ও দায়িত্বশীল পর্যটন
সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য টেকসই রাখতে আমাদের সবার দায়িত্ব রয়েছে:
- পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং: প্লাস্টিকের বোতলের বদলে রিফিলযোগ্য ফ্লাস্ক ব্যবহার করুন
- স্থানীয় অর্থনীতিকে সমর্থন: মাছিজীবীদের কাছ থেকে সামুদ্রিক মাছ কিনুন, স্থানীয় হোটেলে থাকুন
- সূর্য সুরক্ষা: রিফিল-ফ্রি সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন (রাসায়নিক প্রবালের জন্য ক্ষতিকর)
মোবাইল ফটোগ্রাফি টিপস: সূর্যোদয়ের সময় গোল্ডেন আওয়ারে (Golden Hour) ছবি তুলুন। সমুদ্রের রঙ তখন সবচেয়ে প্রাণবন্ত হয়!
জেনে রাখুন
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাওয়ার সেরা সময় কোনটি?
নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের আদর্শ সময়। এই সময় সমুদ্র শান্ত থাকে, বৃষ্টিপাত কম হয় এবং তাপমাত্রা সহনীয় থাকে। বিশেষ করে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দ্বীপে পর্যটকের ভিড় বেশি থাকে, তাই বুকিং আগে থেকে করাই ভালো। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সমুদ্র উত্তাল থাকতে পারে।
সেন্ট মার্টিনের কোন অবিশ্বাস্য দর্শনীয় স্থান গুলো সবচেয়ে জনপ্রিয়?
চেরা দ্বীপ, কেওয়াক্রা পয়েন্ট, শীলা বীচ এবং উত্তর বীচ সেন্ট মার্টিনের শীর্ষ দর্শনীয় স্থান। চেরা দ্বীপে প্রবালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, কেওয়াক্রায় সূর্যাস্তের দৃশ্য, শীলা বীচের নির্জনতা এবং উত্তর বীচের নীল জল বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। এছাড়াও স্থানীয় মৎস্য বন্দর এবং রাখাইন পল্লীর সাংস্কৃতিক দৃশ্যও দেখার মতো।
সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে আনুমানিক খরচ কত?
ঢাকা থেকে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে ৩ দিন ২ রাতের জন্য মাথাপিছু খরচ পড়বে প্রায় ৮,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকা (এসি বাস ও লঞ্চ ভাড়া, মধ্যম মানের হোটেল ও খাওয়ার খরচ ধরে)। কক্সবাজার থেকে দিনে দিনে ঘুরে আসতে খরচ পড়বে ২,০০০-৩,০০০ টাকা। চেরা দ্বীপে যাওয়ার নৌকা ভাড়া জনপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা এবং গ্লাস বোট রাইড ৩০০-৪০০ টাকা।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় পর্যটকরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন?
প্লাস্টিক বর্জ্য (বিশেষ করে পলিব্যাগ ও পানির বোতল) দ্বীপে না ফেলা, প্রবাল বা শামুক না তোলা, সমুদ্র সৈকতে আগুন না জ্বালানো এবং স্থানীয় পরিবেশবান্ধব গাইড নিয়োগের মাধ্যমে পর্যটকরা ভূমিকা রাখতে পারেন। রাতে অতিরিক্ত আলো ব্যবহার না করা (কচ্ছপের ডিম ফুটতে বিঘ্ন ঘটে) এবং সূর্য সুরক্ষার জন্য প্রবাল-বান্ধব সানস্ক্রিন ব্যবহার করা জরুরি।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মতো অবিশ্বাস্য দর্শনীয় স্থান কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার গর্ব। এই প্রবালদ্বীপের প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি বালুকণা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় প্রকৃতির কত নাজুক আর কত সুন্দর হতে পারে! আজই আপনার ব্যাগ গুছিয়ে ফেলুন— কারণ এই অপার সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আপনি অনুভব করবেন, পৃথিবীতে এমন স্বর্গ থাকা সম্ভব! আপনার ভ্রমণ কাহিনী আমাদের সাথে শেয়ার করুন #সেন্টমার্টিন_আমার_স্বর্গ হ্যাশট্যাগে। প্রকৃতি ডাকছে— সাড়া দিন!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।