জুমবাংলা ডেস্ক : স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যেতে না পেরে প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর মাঝে হাহাকার অবস্থা বিরাজ করছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অফিসে কর্মীরা প্রতিনিয়ত ধরনা দিয়েও পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত পাচ্ছে না। মালয়েশিয়া গমনেচ্ছ অপেক্ষমাণ ভিসাপ্রাপ্ত হাজার হাজার কর্মী এবং তাদের পরিবার পরিজনের চোখে মুখে ঘুম নেই। তারা চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। কারণ গত ১ জুন থেকে চিহ্নিত সিন্ডিকেট চক্রের অনৈতিক কর্মকান্ড, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় আদায় এবং নানা অনিয়মের দরুণ দেশটি বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। গত ৩১ মে’র মধ্যে দেশটিতে প্রবেশের শেষ সময় বেধে দেয়া হয়েছিল।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া শ্রমিক রফতানিতে সিন্ডিকেট ও অতিরিক্ত অভিসন ব্যয় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে মালয়েশিয়া শ্রমিক রফতানি ৩১ মে বন্ধ হয়ে যায়। ই-ভিসাপ্রাপ্ত প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশি কর্মী সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরেও দেশটি যেতে পারেনি। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্য মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের সিন্ডিকেটে অপ-তৎপরতা এবং ১৭ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে না পারায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এসব অপেক্ষমাণ কর্মীদের প্রবেশের সময় বৃদ্ধির আবেদন জানানোর পরেও মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ায় প্রচুর রেমিট্যান্স আয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া সরকারের পূর্ব ঘোষিত অনুযায়ী ৩১ মে’র পর খেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতার দরজা বন্ধ রয়েছে। ৩১ মে’ থেকে আর কোনো অনুমোদিত অভিবাসী কর্মীকে দেশটিতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। অভিবাসী কর্মীদের প্রবেশের সময়সীমা বৃদ্ধি না হওয়ায় অপেক্ষমাণ বাংলাদেশি প্রায় ১৭ হাজার কর্মীর স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়েছে।
এদিকে, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ বন্ধ হলেও দেশটি পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সারওয়ার্কে প্লানটেশন ও নির্মাণখাতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ শুরু হয়েছে। আজ সোমবার রিক্রুটিং এজেন্সি ইস্টার্ন বিজনেস এসোসিয়েট লিমিটেডের ১৪ জন বাংলাদেশি কর্মী জাহারাত এসোসিয়েটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার সারওয়ার্কের সবচেয়ে বড় কোম্পানি ইমাস কনস্ট্রাকশন কোম্পানীতে নিয়োগের জন্য স্থানীয় সময় ১২টা ৪০ মিনিটে এয়ার এশিয়ার একটি ফ্লাইট যোগে কুচিং বিমান বন্দরে পৌঁছেছে। কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব বাংলাদেশি কর্মীদের রিসিভ করে সরাসরি কোম্পানির কোয়াটারে নিয়ে যায়। রাতে সারওয়ার্ক থেকে ইস্টার্ন বিজনেস এসোসিয়েটের চেয়ারম্যান ড.ওয়ালি উল্লাহ জাহিদ এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে ড.ওয়ালি উল্লাহ জাহিদ বলেন, সারওয়ার্কের বৃহৎ কোম্পানীতে কর্মরত অবস্থায় এসব বাংলাদেশি কর্মী দৈনিক চার ঘন্টা ওভারটাইমসহ প্রতি মাসে প্রায় তিন হাজার রিংগিট বেতন পাবেন। আগামী দশ দিনের মধ্যে বাকি ৩৫ জন কর্মী সারওয়ার্কে পৌঁছবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আগামী আগস্ট মাসে আরো ৫০ জন কর্মী সারওয়াকে যাবার সুযোগ পাবে। ড. ওয়ালি জাহিদ বলেন, সারওয়াকের বিভিন্ন কোম্পানির নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশি কর্মীদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। তারা কঠোর পরিশ্রমী হওয়ায় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশিদের নিয়োগ দিতে বেশি আগ্রহী।
আজ সোমবার একটি রিক্রুটিং এজেন্সির সামনে নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাঙ্গাইলের একজন কর্মী কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়েছি। গত ৩১ মে থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া বন্ধ হলেও এখনো এজেন্সির অফিস থেকে পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত পাইনি। পাসপোর্ট ও টাকা রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে কখন পাবো তা’ও জানি না। শুধু অহেতুক আশ্বাস দেয়া হচ্ছে শিগগিরই মালয়েশিয়া কর্মী যাওয়া শুরু হবে। কিন্ত এ ব্যাপারে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
এদিকে, সরকারের নির্দেশে গত ৩১ মে’র মধ্যে যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির অধীনে ভিসা পাওয়ার পরেও কর্মী পাঠাতে পারেনি সেসব দায়ী এজেন্সির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যেসব কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়ে চাকরি ও বেতন পাচ্ছে না তাদের ব্যাপারেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ থাকার কথা। গত সপ্তাহে উল্লেখিত তদন্ত কমিটি প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ও প্রবাসী সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্ত অদ্যাবধি তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দায়ী রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার আলামত পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেই মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ পাচ্ছেন না। কেউ কেউ চড়া সুদে ঋণ করে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসছেন। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার গত ৩১ মে’র আগে জানিয়েছেন দেশটিতে প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশি কর্মী কাজ পাচ্ছে না। তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে গত ১৯ এপ্রিল জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক
হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) ওয়েবসাইটে এক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেই দুর্বিষহ, মানবেতর ও অমর্যাদাকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। চাকরির ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেই দুর্বিষহ, মানবেতর ও অমর্যাদাকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। চাকরির ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
এবার ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে চলতি মাসের শুরু থেকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ফলে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। চলতি জুন মাসের প্রথম ২১ দিনে প্রবাসীরা ১৯১ কোটি ৪৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে। সউদীর শ্রমবাজার বন্ধ থাকলে রেমিট্যান্স খাতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। রেমিট্যান্স আয়ের ভাটার টান শুরু হলে জাতীয় অর্থনীতিতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। একাধিক জনশক্তি রফতানি-কারক এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
মূলত বাংলাদেশী শ্রমিকদের মালয়েশিয়া পাঠানোতে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে এ যাবত প্রায় সাড়ে চার লাখ কর্মী দেশটিতে গিয়েছে। বায়রার এক জন নেতা আজ সোমবার ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন,সিন্ডিকেট চক্রের অনিয়ম দুর্নীতি এবং অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের কারণে জনশক্তি রফতানি বন্ধ হয়েছে। দালালদের হাত বদল হয়ে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা ব্যয় করে কর্মীরা দেশটিতে গিয়েছে। তিনি বলেন, প্রায় ১০ লাখ কর্মীর মেডিকেল করেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়ায় গিয়ে শোষণের শিকার হচ্ছে। দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মীরা অস্থিতিশীল ও অসম্মানজনক অবস্থায় রয়েছে। শোষণকারী নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি অপর্যাপ্ত। বায়রা নেতা বলেন, ভবিষ্যতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হলে কোনো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যাতে কর্মী নিয়োগ না হয় সে ব্যাপারে প্রবাসী মন্ত্রণালয়কে অনড় থাকতে হবে। মালয়েশিয়ায় সিন্ডিকেটের তালিকায় বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যেরা।-দৈনিক ইনকিলাব
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।