জুমবাংলা ডেস্ক : একটা সময়ে মধ্যবিত্ত কিংবা ধনী-গরিব সকলের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেছিলো দেশীয় মৌসুমী সুস্বাদু ফল তরমুজ। গ্রীস্মের তাপদাহ থেকে নিজেদের স্বস্তি দিতে গ্রামীণ হাট-বাজার ও বৈশাখী মেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে স্বজনদের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো তরমুজ। চলতি মৌসুমে তরমুজের বাজারে সেই আগের চিত্র নেই।
আড়ত থেকে পিস হিসেবে কিনে খুচরা বাজারে অধিক লাভের আশায় কেজির দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। তার ফলাফল তরমুজ আছাড় মেরে ভেঙে ফেলার ভিডিও এখন ফেসবুকে ছড়াছড়ি । সেটা অবশ্য ফল হিসেবে তরমুজের প্রতি মানুষের অনীহা থেকে নয়, বরং ফলটির বিক্রয় পদ্ধতি নিয়ে ক্ষোভের কারণে। তরমুজ কেজিদরে বিক্রির বিরোধিতা থেকে এই ক্ষোভের জন্ম।
তরমুজ নষ্ট করার ভিডিও তৈরির হিড়িক পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তরমুজের দোকানে এক ক্রেতা দাম জানতে চাইলেন। বিক্রেতা বলছেন, কেজি ৫০ টাকা। এ কথা শুনে বিস্মিত ক্রেতা বলছেন, কেজি এলো কবে থেকে?
বিক্রেতার সহজ উত্তর, ‘অনেক আগে থেইক্যা।’
এ কথা শুনেই ক্রেতা বললেন, ‘আমাকে এক কেজি দেন।’
তখন বিক্রেতা বলেন, ‘এক কেজি! গেরামের থেইক্যা কবে আইছেন মামা।’
ক্রেতা যখন বললেন, ‘কী বলেন?’
বিক্রেতা বলেন, ‘তরমুজ খাওয়া লাগব না। রাখেন।’
উত্তরে ক্রেতা বলেন, ‘আপনি আড়ত থেইক্যা শ হিসাবে কিনে আনছেন, আপনি অতি লাভের আশায় কেজি হিসাবে বিক্রি করবেন। আপনি হালাল ব্যবসাকে হারাম কেন করতেছেন, মামা?’
বিক্রেতা উপদেশ শুনে আরও ক্ষেপে যান, ক্রেতাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্রেতা তরমুজ বিক্রি করতে বসছেন। সুরে সুরে ডাকছেন ক্রেতাদের।
একজন নারী ক্রেতা এসে দাম জানতে চান, বিক্রেতা বলেন, কেজি ৪৫ টাকা। তখন তিনি একটি তরমুজ দেখিয়ে দিয়ে বলেন, এটা থেকে দুই কেজি দেন।
বিক্রেতা বলেন, ‘ক্যামনে দিমু দুই কেজি?’
সাবলীল ঢঙে ক্রেতা বললেন, ‘ওমা, আপনি কেজি মাপে বিক্রি করেন না?’
বিক্রেতার যুক্তি দুই কেজি দিলে, বাকিটা কী করব?
চলতে থাকে বাগবিতণ্ডা। উত্তেজিত হয়ে পড়েন ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনই।
একপর্যায়ে রাগান্বিত ক্রেতা তরমুজ মাথার ওপর তুলে আছাড় মারেন।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, একজন উত্তেজিত যুবক একের পর এক তরমুজ ছুড়ে নষ্ট করছেন। সেখানে হাজির এক মধ্যস্থতাকারী। শেষ পর্যন্ত ওই এক ইস্যু। সংখ্যা গুণে তরমুজ এনে কেজি হিসাবে বিক্রি করার প্রতিবাদে করা হয়েছে এই ভিডিওটি।
বাস্তবতা ভিডিওর মতো নাটকীয় না হলেও কেজিদরেই দেদার তরমুজ বিক্রি চলছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কেজিদরে তরমুজ বিক্রি ঠেকাতে অভিযান চালিয়েছে প্রশাসন।
কয়েক বছর ধরে কেজিদরে তরমুজ বিক্রি নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ বছর সেটি বেড়েছে।
কেজি হিসাবে কিনলে ক্রেতার চোখে দেখে অনুমান করে কিনে ঠকার সুযোগ নেই। তবে কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী ফলটি পাইকারি বাজারে গোটা হিসাবে বিক্রি হয় বলে খুচরায় কেজিদরে বিক্রির সুযোগ নেই।
বড় আকারের একমাত্র ফল হিসেবে কেজিদরে বিক্রির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তরমুজের ক্ষেত্রে। আবার অন্য যেসব ফল কেজি হিসাবে বিক্রি হয়, সেগুলো ক্রেতা চাইলে এক কেজি, দুই কেজি বা যেকোনো একক নিতে পারেন। কিন্তু এখানে তা নয়। কেজি হিসাবে বিক্রি করছেন বিক্রেতা, কিন্তু ক্রেতাকে নিতে হবে আস্ত ফলটাই।
পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে খুচরা বিক্রেতার মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা ঠেকানোর কোনো কার্যকর উপায় এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার খুচরা বিক্রেতাদের বেশভুষা ক্রেতাদের অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রতি সমব্যথী করে তোলে।
ফলের ক্ষেত্রে পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে দামের পার্থক্য হতে পারবে, সেটিও আইনে বলা আছে। অন্য ফলের তুলনায় তরমুজে মুনাফা করা যাবে কম- এটাও আইনের বিধান। এ ক্ষেত্রেও আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে।
রাজধানীর বাদামতলী আড়ত, কারওয়ান বাজারের পাইকারি ও খুচরা বাজার এবং বাড্ডার মহল্লার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরায় সব জায়গায় কেজিদরেই বিক্রি হয়। তবে আড়তে বিক্রি হয় গোটা হিসাবে।
আকারভেদে তরমুজ ৩ কেজি থেকে ১২ কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের দেখা গেছে। খুচরায় বিক্রেতারা দাম চাইছেন ৩০ থেকে ৫০ টাকা কেজি।
ছোট ফলের দাম কম, আর আকারে বড় হলে কারওয়ান বাজারে দর ৩৫ থেকে ৪০ টাকা আর মহল্লার বাজারে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা।
বাদামতলী ফলের আড়ত থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে জনসন রোডে ইউসুফ কনফেকশনারির সামনে ফলের দোকানে বড় আকারের তরমুজ সাজিয়ে রেখেছেন মোহাম্মাদ হোসেন। দাম কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৫০ টাকা কেজি।’
পিস হিসাবে কিনে কেজি হিসাবে বিক্রি করা বেআইনি– এটি মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘ঠিকাও বেচি আবার কেজিও বেচি। যে যেমনে লয়।’ কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের সঙ্গে ফুটপাতে তরমুজ নিয়ে বসেছেন এক বিক্রেতা। এক ক্রেতা কিনতে চাইলে দাম চাইলেন ৪০ টাকা কেজি। কেজিদরে বিক্রির কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘পিস হিসাবেও বেচি, আবার কেজি হিসাবেও বেচি। যে যেমনে নেয়।’
আইনে কী বলে
কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী: ফলের ক্ষেত্রে বিক্রেতা কেজিতে ১০ টাকা লাভ করতে পারবেন। তবে তরমুজের ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা আছে। কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকার বেশি লাভ করতে পারবেন না বিক্রেতা। আর কেজি বা পিস যেভাবে পাইকারি কেনা হবে, বিক্রেতাকে সেভাবেই বেচতে হবে।
দুই বছর ধরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জেলায় জেলায় অভিযান চালিয়ে তরমুজ বিক্রেতাদের জরিমানা করছে। এবারও কারওয়ান বাজারে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে। তবে পাড়া-মহল্লায় কেজিতে বিক্রি, এটাই স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাগফুর রহমান জানান, কেজি হিসাবে বিক্রির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
কোথায় এ রকম ঘটনা পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারওয়ান বাজার, শান্তিনগর।’ কতজনকে কত টাকা জরিমানা করা হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। আমরা প্রতিদিন কমবেশি জরিমানা করে থাকি।’ সর্বোচ্চ সাজা কতটুকু জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূল্যতালিকা না থাকলে ৫০ হাজার টাকা। কেজিদরে বিক্রি করলেও সর্বোচ্চ সাজা ৫০ হাজার টাকা।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।