ধর্ম ডেস্ক : রিজিক অনুসন্ধানের জন্য মানুষ যেসব পেশা বেছে নেয়, তার মধ্যে পবিত্র একটি পেশা হলো ব্যবসা। কেউ যদি কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা মোতাবেক সত্ভাবে ব্যবসা করে, তবে মহান আল্লাহ দুনিয়া-আখিরাতে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। তার জীবন বরকতময় করেন। আখিরাতকেও সুখময় করবেন ইনশা আল্লাহ।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সত্যবাদী ও শহীদের সঙ্গে থাকবে।’
(তিরমিজি, হাদিস : ১২০৯)
কিন্তু কিছু কাজ আছে, যেগুলো ব্যবসার বরকত উঠিয়ে নেয়। বাহ্যিকভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এগুলো করা যৌক্তিক মনে হলেও তা মানুষের দুনিয়া-আখিরাত ধ্বংস করে দেয়। নিম্নে এ ধরনের কিছু কাজ তুলে ধরা হলো,
মাপে কম দেওয়া : শহর থেকে গ্রাম—সবখানে এই সমস্যাটি ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। কিছু নির্দিষ্ট ব্যবসার ক্ষেত্রে এ কাজটি ব্যাপকভাবে হওয়ার কারণে মানুষ একে নিয়তি হিসেবে মেনে নিতে শুরু করেছে। অথচ এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বহু দুর্ভোগ আছে তাদের, যারা মাপে কম দেয়, যারা মানুষের কাছ থেকে যখন মেপে নেয় পূর্ণমাত্রায় নেয় আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয়, তখন কমিয়ে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না, তাদেরকে জীবিত করে ওঠানো হবে? এক মহাদিবসে, যেদিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামিনের সামনে দাঁড়াবে। ’ (সুরা : মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৬)
মানুষের এই পাপের কারণে দুনিয়াতেও বিভিন্ন বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলেন, ‘যখন কোনো জাতি ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করে, তখন তাদের ওপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ-মুসিবত।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)
নিম্নমানের পণ্য দেওয়া : অনেক সময় দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের কৌশলে নিম্নমানের পণ্য দিয়ে দেয়, যা ক্রেতা তাৎক্ষণিক বুঝতেও পারে না। এ ধরনের প্রতারণাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করছিল।
তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিভাবে বিক্রি করছ?’ তখন সে তাঁকে এ সম্পর্কে জানাল। এরই মধ্যে তিনি এ মর্মে ওহি প্রাপ্ত হলেন, আপনি আপনার হাত শস্যের স্তূপের ভেতরে ঢোকান। তিনি স্তূপের ভেতরে তাঁর হাত ঢুকিয়ে অনুভব করলেন যে তার ভেতরের অংশ ভেজা। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
(আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৫২)
মিথ্যা শপথ করা : ব্যবসায় অধিক লাভের আশায় অনেকে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এ ক্ষেত্রে ক্রেতার আস্থা অর্জন করতে অনেকে মিথ্যা শপথ পর্যন্ত করে বসে, যা নিষিদ্ধ। আবু জর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন তিন প্রকার ব্যক্তির সঙ্গে আল্লাহ কথা বলবেন না এবং তাদের গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না, বরং তাদের জন্য থাকবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হলো সেই ব্যক্তি, যে দান করে পরে খোঁটা দেয়; দ্বিতীয় ব্যক্তি, যে ইজার বা লুঙ্গি ইত্যাদি লটকিয়ে চলে; তৃতীয় ব্যক্তি, যে মিথ্যা শপথ দ্বারা পণ্য চালায়।’ (নাসায়ি, হাদিস : ৫৩৩৩)
পণ্যের দোষ গোপন করা : কিছু পণ্য এমন আছে, যেগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ধারণা রাখে না। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাদের পণ্যের দোষ গোপন করে সেই সরল ক্রেতাদের ঠকিয়ে দেয়। অথচ নবীজি (সা.) এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ করেছেন। উকবাহ বিন আমির (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। অতএব কোনো মুসলমানের পক্ষে তার ভাইয়ের কাছে পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে তা বিক্রি করা বৈধ নয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪৬)
ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করা : সাধারণত ব্যবসা পরিচালনার জন্য ঋণ (কর্জে হাসানাহ) নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে, তা যথাযথভাবে নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করে দিলে সমস্যা নেই। কিন্তু অনেকে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃত পাওনাদারদের পাওনা মেটাতে চায় না। এতে আল্লাহ নারাজ হন। যার প্রভাব ব্যবসার ওপরও পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ধনী ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করা জুলুম।’ (বুখারি, হাদিস : ২২৮৭)
সুদি লেনদেন করা : পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোনো অতি কুফরকারী পাপীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৬)
এর প্রভাব কখনো কখনো দুনিয়াতেও দেখা যায় যে সুদি লেনদেনে জড়িত হওয়ার পর থেকে ব্যবসায় লোকসানের হার বেড়ে যায়। কারো কারো দুনিয়াতে এর প্রভাব অনুভূত না হলেও হারামে লিপ্ত হওয়ার কারণে সে তো আখিরাত থেকে নিশ্চিতভাবে বঞ্চিত হচ্ছে, এ অবস্থায় দুনিয়া থেকে চলে গেলে সেই ক্ষতি কোনো কিছু দিয়ে পোষানোর সুযোগ থাকবে না।
কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে গুদামজাত করা : রমজান, ঈদসহ বিভিন্ন মৌসুমে ক্রেতাদের থেকে বাড়তি মুনাফা করার জন্য অনেক সময় অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। অথচ এই কাজের শাস্তি মহান আল্লাহ দুনিয়া থেকেই দেওয়া শুরু করেন। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে (বা সমাজে) খাদ্যদ্রব্য মজুদদারি করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৫)
অন্যের ক্রেতা ফুসলিয়ে নেওয়া : অনেকে আছে অন্যের ক্রেতাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চায়, এ কাজ করতে তারা বিভিন্ন রকম প্রতারণার আশ্রয় নেয়। আরেকজনের ঠিক হয়ে যাওয়া বিক্রি বানচাল করে দিতে কৌশলে তার ক্রেতাকে ভুলভাল বোঝায়। নবীজি (সা.) এ ধরনের কাজ করতে নিষেধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা প্রতারণামূলক দালালি কোরো না। কোনো ব্যক্তি যেন তার ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর ক্রয়-বিক্রয় না করে।’ (বুখারি, হাদিস : ২১৪০)
ওয়াদা পূরণ না করা : ব্যবসা-বাণিজ্যে ওয়াদা রক্ষা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশি দূর এগোনো যায় না। ঈমানদারের জন্যও এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুমিন কখনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর অঙ্গীকার পূরণ করো, নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৪)
দাম বাড়াতে কৃত্রিম দরদাম : অনেক সময় ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য দালালের মাধ্যমে মিথ্যা দরদাম করায়। কোরবানির পশুর হাটে এ কাজ বেশি দেখা গেলেও পাইকারি বাজারগুলোতেও এ ধরনের কারচুপি চলে। ইসলামের এ ধরনের প্রতারণাও নিষিদ্ধ। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর ‘নাজাশ’ (ক্রেতাকে ঠকানোর জন্য দ্রব্যের দরদাম) করো না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৩০৪)
এককথায় বলতে গেলে আমাদের প্রত্যেকের রিজিক মহান আল্লাহর হাতে। তিনি আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রিজিক যেকোনো মূল্যে আমাদের কাছে পৌঁছাবেন। অবৈধ পথ অবলম্বনের মাধ্যমে আমরা আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত রিজিকের চেয়ে এক কণা পরিমাণ বেশি অর্জন করতে পারব না। কিন্তু আমাদের এই অনৈতিক কাজটির জন্য আল্লাহর দরবারে অবশ্যই হিসাব দিতে হবে। তাই আমাদের উচিত, ব্যবসা-বাণিজ্য জীবনের সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর বিধানকে প্রাধান্য দেওয়া। মহান আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।