বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিন দিন উচ্চশিক্ষা খাতে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে উচ্চশিক্ষায় নেতৃত্ব দিলেও বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আসন সংখ্যা ও সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতার কারণে চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের বড় একটি ফারাক তৈরি হয়েছে। এ সংকট মোচনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যকর বিকল্প হিসাবে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের উচ্চশিক্ষায় ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আর শুধু সহায়ক নয়, বরং মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।
প্রায় তিন যুগ আগে দেশে যাত্রা শুরু হয়েছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। শুরুতে হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলে এখন তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিগুণ। সরকারি তেমন কোনো সুবিধা ছাড়াই মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ব র্যাংকিংয়েও।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এখন চাকরি করছে নাসার মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে। দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস, মানসম্পন্ন শিক্ষক, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি ও নিয়মানুবর্তিতায় অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেও পেছনে ফেলছে তারা। দেশ-বিদেশের কর্মবাজারে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
গত জুনে প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিয়ে দেশের সেরা ১৫ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাতটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নিয়েছে। একই মাসে প্রকাশিত টাইমস হায়ার ইমপ্যাক্ট র্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়া ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১২টিই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা তিন লাখ ৫৮ হাজার। তার মধ্যে ছাত্রী এক লাখ ২৫ হাজার (৩৪ শতাংশ)।
চালু থাকা ১০৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছে ১৭ হাজার ৪৭৯ জন। বর্তমানে অনুমোদিত ১১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়নি, আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ে, তাদের সংখ্যা ৪৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। এরপর ব্যবসায় শিক্ষায় ২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, কলা ও মানবিকে ১০ দশমিক ৯৪ শতাংশ, আইনে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ, সামাজিক বিজ্ঞানে ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ফার্মেসিতে ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ, টেক্সটাইল ও ফ্যাশনে ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ, কৃষিতে ০ দশমিক ৫৮ শতাংশ, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ও জনস্বাস্থ্য ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ভেটেরিনারি ও এনিমেল সায়েন্স ০ দশমিক ১১ শতাংশ, বিজ্ঞানে পড়ছে ২ দশমিক ১৩, অন্যান্য ০ দশমিক ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক : বর্ণিত বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সর্বমোট শিক্ষক সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ৪৭৯ জন। এর মধ্যে পূর্ণকালীন শিক্ষক ১৩ হাজার ১৬৯ জন। খণ্ডকালীন শিক্ষক চার হাজার ৩১০ জন। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত দাঁড়ায় ১:২১।
অর্থাৎ সূচকের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে মোট শিক্ষকের প্রায় ৭৫ শতাংশ পূর্ণকালীন এবং ২৫ শতাংশ খণ্ডকালীন। পূর্ণকালীন শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক ৯৫২, সহযোগী অধ্যাপক এক হাজার ১১৯, সহকারী অধ্যাপক তিনি হাজার ৪১০, প্রভাষক সাত হাজার ৪৭৮ ও অন্যান্য ২১০ জন। খণ্ডকালীন শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক এক হাজার সাত, সহযোগী অধ্যাপক ৫৯৯, সহকারী অধ্যাপক ৬৯৮, প্রভাষক এক হাজার ৬৫০ ও অন্যান্য ৩৫৬ জন।
২০২২ সালে পূর্ণকালীন শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক ৮৫৮, সহযোগী অধ্যাপক ৯৮৬, সহকারী অধ্যাপক তিন হাজার ২৯৩, প্রভাষক ছয় হাজার ৮৪৫ ও অন্যান্য ২৪৭ জন। খণ্ডকালীন শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক ৯৯৯, সহযোগী অধ্যাপক ৫৪৫, সহকারী অধ্যাপক ৬৯৫, প্রভাষক এক হাজার ৫৭৭ ও অন্যান্য ৪৬২ জন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডুয়েল ও ট্রাই সেমিস্টারে ভর্তি পদ্ধতিও শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়। এতে একজন শিক্ষার্থী তার পছন্দমতো সময়ে ভর্তি হতে পারছে। ডুয়েল সেমিস্টার জানুয়ারি ও জুলাই মাসে শুরু হয়। আর ট্রাই সেমিস্টারের বিষয়গুলোতে স্প্র্রিং (জানুয়ারি-এপ্রিল), সামার (মে-আগস্ট), ফল (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) এ তিনবার ভর্তির সুযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একসময় মনে করা হতো, শুধু উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা সম্পূর্ণই ভিন্ন। এখন শুধু মধ্যবিত্তই নয়, নিæমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সেশনজট নেই, ছাত্র রাজনীতি নেই, যা অনেক অভিভাবকেরই অন্যতম পছন্দ। বর্তমানে ৩৬টির বেশি দেশের শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কীভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ দেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থী যাতে পড়ালেখা শেষ করেই চাকরিবাজারে ঢুকতে পারে, সেই ব্যাপারটা প্রাধান্য দিতে হবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।