জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশে ইলিশের জন্য চাঁদপুর কিংবা দক্ষিণের কিছু জেলা সবসময় আলোচনায় আসলেও এবার ঢাকার কাছে ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলায় ফেনী নদীতে প্রচুর ইলিশ পাচ্ছেন জেলেরা এবং এসব ইলিশ আকারেও তুলনামূলক অনেক বড়।
মৎস্য গবেষকরা বলছেন, ইলিশ মাছ সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের নানা উদ্যোগ আর ফেনী নদীর পরিবেশ বড় আকারের ইলিশকে সেখানে নিয়ে আসছে।
স্থানীয় বাজারে প্রায়ই বিক্র হচ্ছে দুই থেকে তিন কেজি ওজনের ইলিশ মাছ। জেলেরা বলছেন, ২০ থেকে ২৫ বছর আগে ফেনী নদীতে ইলিশ নিয়মিত মিললেও মাঝে দীর্ঘসময় খুব একটা পাওয়া যেতো না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আবার ইলিশ পাচ্ছেন তারা।
‘ফেনীর সাথে মেঘনার যোগসূত্র আছে। আবার এখন ইলিশের বিচরণও অনেক বেড়েছে। সামনে ইলিশ আরো পাওয়া যাবে কারণ সাগর থেকে ইলিশ এখন উজানের দিকে আসার সময় হচ্ছে ডিম পাড়ার জন্য,’ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন।
ফেনী নদীতে ইলিশ কেন?
স্থানীয় জেলে প্রিয় লাল জলদাস ফেনী নদী থেকে শুরু করে সন্দ্বীপের সাগর মোহনা এলাকায় মাছ ধরেন তিন দশকেরও বেশী সময় ধরে।
তিনি বলছেন, অনেক আগে ছোট ও বড় ফেনী নদীতে ইলিশ পাওয়া যেতো নিয়মিত। মাঝে পরিমাণে কমে গিয়েছিল, তবে এখন আবার বেড়েছে।
‘এখন বড় বড় ইলিশ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। যদিও সব মিলিয়ে নদীতে মাছ কমেছে নানা সমস্যা কারণে,’ বলছিলেন তিনি।
আর এই ইলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বড় আকারের মাছ বেশি পাওয়ার কারণ কী?
মৎস্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, সাগরে ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধের কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে এমনিতেই ইলিশের পরিমাণ বেড়েছে।
‘পাশাপাশি পূর্ণিমার পর ইলিশের বিচরণ বেড়ে গেছে। আর প্রজনন মৌসুমকে সামনে রেখে ইলিশ এখন উজানের দিকে আসবে। ফলে উজানের জলাশয়ে ইলিশের প্রাপ্যতা বাড়বে। এসব কারণেই ফেনী নদীতেও আগের চেয়ে বেশি ইলিশ মিলছে,’ বলছিলেন মাহমুদ।
তার মতে- মেঘনা নদীর সাথে ফেনী নদীর যোগসূত্র থাকায় এমনিতেও এটি ইলিশের একটি পরিভ্রমণ রুট।
বাংলাদেশে মাছের প্রজনন, উৎপাদন ও সংরক্ষণের জন্য ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে।
আবার অক্টোবরেও ইলিশ প্রজনন মৌসুমে বাইশ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকে। পাশাপাশি জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে জাটকা নিধন বন্ধেও কিছু পদক্ষেপ নেয় কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে সাগরে ও নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের সরকার বিকল্প সহায়তা দিয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম বলছেন, নদীর যেখানে গভীরতা ভালো ও পানির যেখানে প্রবাহ ভালো ইলিশ সেখানে স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
‘ভারতের ত্রিপুরায় উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ফেনী নদী এমনই একটি নদী। এটিও ইলিশকে সেখানে আসতে উৎসাহিত করছে। আর মাছ সংরক্ষণে নেয়া কর্মসূচিও কার্যকর হওয়ায় মাছের পরিমাণ বেড়ে গেছে,’ বলছিলেন ইসলাম।
অর্থাৎ সীমান্ত নদী হিসেবে ফেনী নদী হিসেবেও তার স্বাভাবিকতা ফিরে পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
নদীটি ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা দিয়ে আশি কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে ফেনীতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে এটি গিয়ে সন্দ্বীপ চ্যানেলে মিশেছে।
ফেনী নদী ইলিশের রুট
সাধারণত অক্টোবর নভেম্বর মাসে ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ার পর ডিম থেকে হওয়া জাটকাগুলো পরবর্তী ছয় থেকে সাত মাস নদীতেই বড় হতে থাকে। এরপর ইলিশগুলো সাগরে চলে যায়।
ওই সময়কে লক্ষ্য করেই সাগরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে যাতে করে মাছগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পায়। এক বছর পর একটি ইলিশ পরিপূর্ণ হয় এবং এরপর আবার ডিম ছাড়ার জন্য ইলিশ নদীতে ফিরে আসে।
অক্টোবর নভেম্বর মাস নাগাদ প্রজনন মৌসুম শুরু হলে ইলিশ তখন উজানের দিকে আসতে থাকে।
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলছেন একটা ইলিশ অন্তত এক বছর বড় হওয়ার সময় পাচ্ছে এখন। ‘আমরা মনে করি একটা ইলিশকে জীবনে অন্তত একবার ডিম দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। এই সুযোগটা বেড়েছে বলেই প্রজনন সফলতা বাড়ছে ও ইলিশের সংখ্যা বাড়ছে। এ কারণেই নতুন এলাকায় ইলিশের বিস্তৃতি ঘটছে।’
অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম বলছেন, একদিকে ইলিশের মাইগ্রেটরি প্যাটার্নে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে বলে হয়তো ফেনী নদীতে ইলিশ বৃদ্ধিতে সেটি ভূমিকা রেখেছে।
‘অন্যদিকে অন্য এলাকায় মাছ ধরার প্রবণতা বেশি কিন্তু সে তুলনায় ফেনী নদীর এলাকাটি কিছুটা নিরিবিলি। এটারও প্রভাব থাকতে পারে,’ বলছিলেন তিনি।
সোনাগাজী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তূর্য সাহা অবশ্য বলছেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার কারণে নদী ও সাগরে জেলেদের জালে ইলিশসহ অন্য প্রজাতির মাছও ধরা পড়ছে।
‘ফেনী নদী ইলিশের একটি রুট। এটি সন্দ্বীপ চ্যানেল হয়ে সমুদ্রের দিকে চলে গেছে। এখন ইলিশ নদীতে আসার সময় হচ্ছে। এসব কারণে ইলিশের উপস্থিতি বেড়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
কেমন ইলিশ মেলে
জানা গেছে প্রতিদিন ৪০-৫০টি নৌকা ফেনী নদী হয়ে মোহনার দিকে গিয়ে জাল ফেলে এবং কম বেশি প্রতি নৌকাই গড়ে ১০০-১৫০টি ইলিশ নিয়ে বাজারগুলোতে আসছে।
আর বেশিরভাগ ইলিশের আকারই এক কেজির কাছাকাছি কিংবা তার চেয়েও বেশি। এক থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশও পাওয়া যাচ্ছে অনেক।
স্থানীয়রা অবশ্য বলছেন ‘অপ্রত্যাশিত কিছু উৎপাতে’র কারণে জেলেরা ইলিশ মাছ দ্রুত বিক্রি করতে চান এবং ইলিশ বেশি পেলেও সেটি প্রকাশ করতে চান না।
সোনাগাজীর মাছের বাজার সম্পর্কে খবর রাখেন এমন একজন জানিয়েছেন, কোনো নৌকা ইলিশ মাছ বেশি পেলে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী সেগুলো নদীতে নৌকায় থাকা অবস্থাতেই তাদের কাছে কম দামে বিক্রির জন্য চাপ দেয়। সেজন্য ইলিশ প্রসঙ্গে স্থানীয় জেলেরা খুব একটা মুখ খুলতে চান না।
মৎস্য অধিদফতরের ইলিশ পর্যবেক্ষণ সেলের হিসেবে ১৫ বছর আগে দেশের ২৪টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণ ছিল। এখন দেশের অন্তত ১২৫টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তবে জলবায়ু পরিবর্তন, নদীতে সৃষ্ট বহু চর ও ডুবো চর এবং পদ্মা ও মেঘনার নাব্যতা হ্রাস পাওয়ার কারণে সমুদ্র থেকে ইলিশের মিঠা পানিতে আসতে বাধা ও ইলিশের গতি পথ পরিবর্তন হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ১২ শতাংশই ইলিশ। উৎপাদন আরো বাড়াতে বঙ্গোপসাগরের সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ইলিশের প্রধান প্রজনন এলাকা চিহ্নিতকরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার।
কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিলো প্রায় তিন লাখ হাজার মেট্রিক টন। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সেটি বেড়ে ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।