জুমবাংলা ডেস্ক : ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনের বিভিন্ন পদে রদবদলের অংশ হিসেবে নতুন পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মো. জসীম উদ্দিন। নতুন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা এবং সম্পর্ক বেগবান করা, সরকারের অগ্রাধিকার ও সংস্কার কার্যক্রম বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা সংগ্রহ করা, সামগ্রিকভাবে বর্তমান বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের কঠিন দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছেন তিনি।
বিসিএস ১৩তম ব্যাচের পররাষ্ট্র ক্যাডারের মেধাবী কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন চীন, কাতার ও গ্রিসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া দীর্ঘ কর্মজীবনে দিল্লি, ওয়াশিংটন, টোকিও ও ইসলামাবাদে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশের নতুন প্রেক্ষাপট, চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের বিষয়টি পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে কীভাবে দেখছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার এবং কর্মপন্থা নিয়ে জুমবাংলার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন তিনি।
জুমবাংলা: অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার কী কী?
মো. জসীম উদ্দিন: ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। গত কয়েক মাসে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের অগ্রাধিকারগুলো তুলে ধরেছে। সরকারের অগ্রাধিকারগুলো বাস্তবায়নের জন্য অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন আমাদের অগ্রাধিকার।
অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমটি হচ্ছে, সামনে যেসব কাজ তাৎক্ষণিক আসছে সেগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। এর মধ্যে রয়েছে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার কাজে সহায়তা, অর্থনীতিকে মজবুত করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ইত্যাদি।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, পররাষ্ট্র সম্পর্কে চলমান বিষয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। তার মধ্যে রয়েছে—বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, জনশক্তি রফতানি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলা, আমাদের অবস্থান তুলে ধরা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের প্রার্থিতা নিয়ে কাজ করা ইত্যাদি।
তৃতীয়ত, দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার নিয়ে যে কাজ হচ্ছে—সেই কাজে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রাখা।
অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে বর্তমান সময়ের বড় পার্থক্য হলো—জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা এবং অন্যান্য যে অধিকার নাগরিক প্রত্যাশা করেন, সেটা প্রতিষ্ঠা করা। এই অভীষ্ট অর্জনে যে সংস্কার সেই সংস্কার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের এক উল্লেখযোগ্য দিক। অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তায় যেটা স্পষ্ট সেটা হলো—সংস্কার কার্যক্রম ফলপ্রসূ করার জন্য বিভিন্ন দেশ আমাদের সহায়তা করতে ইচ্ছুক। এই বিষয়ে তাদের আগ্রহ রয়েছে। আমি যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ওই দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় দেখেছি যে তারা আমাদের সহায়তা দিতে প্রস্তুত। একইভাবে জাতিসংঘ, তুরস্ক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ অন্যরাও আমাদের সংস্কার কার্যক্রমে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। এই সহায়তা নানা ধরনের হতে পারে। যেমন- সংস্কারের জন্য কোনও কোনও দেশ এবং জাতিসংঘ কারিগরি সহায়তা দিতে পারে। কিংবা ওইসব দেশের বেস্ট প্র্যাকটিস সম্পর্কে আমাদের জানাতে পারেন, অথবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে পারেন ইত্যাদি।
জুমবাংলা: অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম পররাষ্ট্রনীতিতে কী প্রভাব রাখছে?
মো. জসীম উদ্দিন: আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা, সুরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ সব বিষয়ে দেশীয় নীতি থাকে। সেসব দেশীয় নীতি বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক সম্পর্ককে কাজে লাগানোর নীতিই হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি। অন্যভাবে বলা যায়, অভ্যন্তরীণ নীতির সম্প্রসারিত অংশ হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি।
আপনি জানেন যে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে, এর বৈধতা নিয়ে, ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। গণতন্ত্র যেহেতু জনগণের জন্যে কাজেই সেখানে গণমানুষের দৃষ্টি থেকে এই ব্যবস্থাকে দেখা প্রয়োজন। একটা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নাগরিকের কিছু অধিকার আছে। এর মধ্যে আছে মন খুলে কথা বলা, অন্ন, বস্ত্র বাসস্থানের অধিকার, সরকারের কাজ খারাপ হলে সমালোচনা করার অধিকার ইত্যাদি। এসব বিষয় নিয়ে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী সময়ে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই অনুকূল পরিবেশে যে আলোচনা হচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে সংস্কার সম্পর্কে দেশের মানুষ আগ্রহী।
অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে সংস্কার এবং সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। অন্তর্বর্তী সরকার যতটা সফলতার সঙ্গে সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে পারবে, দেশীয় নীতি তত সফল হবে এবং এর ফলশ্রুতিতে পররাষ্ট্রনীতি তত বেশি কার্যকর হবে।
অন্যভাবে বলা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতি কতটুকু শক্তিশালী হবে, সেটি নির্ভর করছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদেশিরা গভীর আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং একইসঙ্গে এই কাজে আন্তরিকভাবে সহায়তা করছে চাইছে। এর অভীষ্ট ফলাফল হচ্ছে— নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরবর্তী যে সরকার আসবে, তাদের সঙ্গে বিদেশিদের সম্পর্কের অন্যতম নির্ধারক হবে দেশীয় সংস্কারের সাফল্য। সংস্কার নিয়ে এখন থেকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তায় একটা অন্যতম দিক হিসেবে স্থান পাবে বলে আমার ধারণা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়– আমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রয়েছে এমন অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ কম। অন্তর্বর্তী সরকার যদি সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করতে পারে, তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। বিদেশিরা এখন আমাদের সঙ্গে সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিবেশ উন্নয়নে সহায়তা করতে চাইছে। এটি হয়ে যাওয়ার পরে পরবর্তী সরকার যখন আসবে, তখন তারা বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করতে আসবে বলে আশা করা যায়। কাজেই অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্যের ওপর ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করছে।
জুমবাংলা: বর্তমানে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়?
মো. জসীম উদ্দিন: কোনও কিছু অর্জনের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আগেও ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। মূল বিষয় হচ্ছে, চ্যালেঞ্জকে সুযোগে রূপান্তর করা এবং এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যেকোনও কূটনীতিকের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে কোনও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে সেটিকে কীভাবে সুযোগে রূপান্তর করে আমাদের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করা যায়, সেই চেষ্টা করা। এটি যে সহজেই করা সম্ভব হয়, বিষয়টি সেরকম নয়।
শেখ শাহরিয়ার জামান
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।