জুমবাংলা ডেস্ক : বাবা-মায়ের মধ্যে মতের অমিলের কারণে যখন বিচ্ছেদ ঘটে তখনই প্রশ্ন আসে সন্তান কার কাছে থাকবে। আর এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। আমাদের সমাজে একটা প্রচলিত ধারণা হচ্ছে সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং কাস্টডি দুইটাই বাবা পায়। কিন্তু তা নয়। সন্তানের কল্যাণ বিবেচনা করে আদালত কিন্তু মায়ের কাছে সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং কাস্টডি দুইটাই অর্পণ করতে পারেন। এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আমাদের দেশে ‘অভিভাবক ও প্রতিপালন আইন-১৮৯০ এবং পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫’ রয়েছে।
দেশে প্রচলিত আইন এবং মুসলিম শরিয়াহ আইন অনুযায়ী অভিভাবকত্ব মূলত তিন ধরণের হয়ে থাকে। যথা: ক) নাবালকের জীবনের খ) সম্পত্তির এবং গ) জীবন ও সম্পত্তি উভয়ের। অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৯৮০ এ অভিভাবকত্ব ও কাস্টডিকে আলাদা দেখানো হয়নি। যদিও মুসলিম শরিয়াহ আইনে বিষয় দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাভাবিক নিয়মে যদিও অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বাবাই হলো সন্তানের অভিভাবক। তবে কাস্টডিয়ানের ক্ষেত্রে ছেলে সন্তানের বয়স ৭ বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত সন্তানের কাষ্টডি মায়ের কাছে থাকবে। ফ্যামিলি কোর্ড অর্ডিন্যান্স (FCU) অনুযায়ী অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে কাস্টডিয়ান হিসেবে মা প্রথম অগ্রাধিকার পাবেন। বিচ্ছেদের পর সন্তানের কল্যাণের বিষয়ে অর্থাৎ সন্তানের শারীরিক, মানসিক ও শিক্ষার বিষয়ে মাকে মনে করা হয় সবচেয়ে উপযুক্ত। একমাত্র পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে মা ভূমিকা রাখতে পারবেন না, তখনই সেখানে আদালত ভিন্ন সিদ্ধান্ত দিতে পারে।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, এখানে পারিবারিক মুসলিম আইনও বাদ দেওয়া যাবে না। সন্তানের বয়স ৭ বছরের অধিক হলে সন্তানের মতামত নিয়ে আদালতও সিদ্ধান্ত দিতে পারে। আবার বাবা যদি ওসিয়ত করে বা আদালত যদি ঘোষণা করে সেক্ষেত্রেও মা অভিভাবক হতে পারেন। অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৯৮০ অনুযায়ী একমাত্র আদালতই পারে নাবালকের অভিভাবকত্ব ঘোষণা এবং নিয়োগ করতে। মুসলিম শরিয়াহ আইন অনুসারে বাবার অনুপস্থিতিতে দাদা বা পরিবারের অন্যপুরুষ অভিভাবকত্ব লাভ করবেন। তবে সন্তানের কাস্টডি রাখার ক্ষেত্রে মা সব সময় প্রাধান্য পাবেন।
যখন সন্তান একটি উপযুক্ত বয়সে পৌঁছাবে তখন তার সিদ্ধান্ত অনুসারে হেফাজত নির্ধারিত হবে। তবে তার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও আদালতের কাছে সন্তানের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা, সন্তানের কল্যাণ ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচিত হবে। বিভিন্ন যুক্তি বিশ্লেষণ করে সকল জুরিস্ট এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, Welfare of the Child -ই হলো সন্তান হেফাজতে দেওয়ার প্রধান শর্ত। অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৯৮০ এর ধারা ৭ এবং ১৭ এ একই কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন মামলায় কিন্তু আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই। মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বনাম এস এম এ বক্কর এবং অন্যান্য, ৬ বি এলডি (এডি) ২৪৫ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ছেলে সন্তানের অভিভাবকত্ব ও কাস্টডি বিষয়ে তার সর্বোচ্চ কল্যাণ বিবেচনায় সন্তানটিকে মায়ের হেফাজতে প্রদান করেন। জাহিদা আহমেদ (লিজা) বনাম সৈয়দ নূরউদ্দিন আহমেদ এবং অন্যান্য, ২০০৯, ৩৮ সিএলসি (এইচসিডি) [৮১১৮] মামলায় আদালত বলেন, “The child’s welfare is the supreme consideration, irrespective of the rights and wrongs of the contending parties”।
ব্লাস্টসহ তিনটি সংস্থার দায়ের করা একটি মামলায় সম্প্রতি শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীর তথ্য সংক্রান্ত ফরম (এসআইএফ) সংশোধনের মাধ্যমে ‘বাবা’ বা ‘মা’ বা ‘আইনগত অভিভাবকের’ নামযুক্ত করতে নির্দেশ দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিশেষ করে একক মায়েরা (সিঙ্গেল মাদার), যেসব শিশু পরিচয়হীন, যৌনকর্মীদের সন্তান যাদের বাবার পরিচয় নেই তারা শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন ফরমে অভিভাবকের নামের স্থানে মা হিসেবে নিজের নাম লিখতে পারবেন।
আগে শিক্ষা ফরমে শুধু বাবার নাম থাকলেও ২০০০ সালে সেখানে মায়ের নাম লেখাও বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে এখন থেকে শুধু মায়ের পরিচয়েও যে কোনো সন্তান শিক্ষার অধিকার পাবেন। অর্থাৎ অভিভাবক হিসেবে যাঁর নাম লিখতে চাইবেন, তাঁর নামই লেখা যাবে। সেটা বাবা, মা বা আইনগত অভিভাবকের নাম হতে পারে।
মা-বাবার বিচ্ছেদের পর সন্তান মায়ের কাছে থাকলেও সে তার বাবার কাছ থেকে ভরণপোষণের খরচ পাবে। এ জন্য মা যদি আদালতের দ্বারস্থ হন, তখন আদালত পিতার প্রতি সন্তানের ভরণপোষণের আদেশ দিতে পারেন। সন্তান মায়ের কাছে থাকলেও ভরণপোষণ পাবেন। লেখাপড়া, চিকিৎসাসহ সন্তানের প্রয়োজনীয় খরচ বাবার উপার্জন অনুযায়ী আদালত নির্ধারণ করে দিতে পারেন। অথবা বাবা-মা একত্রে বসে সমঝোতা করে নিতে পারেন। আইনগতভাবে মা এই সুযোগটি পেতে পারেন।
সন্তানের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আইনের দ্বারস্থ একেবারে সবার শেষ উপায় হওয়া উচিত। সন্তানের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আদালতে না এসে বাবা-মা নিজেরা বসে পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তাহলে সন্তানের শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাটা ভালোভাবে হবে ।
যখন বিচ্ছেদ হয়, তখন সন্তানের কল্যাণের চেয়ে বাবা-মায়ের জেদি মনোভাব বেশি কাজ করে। পারিবারিকভাবে, ব্যক্তিগতভাবে এটা এড়িয়ে চলা উচিত। সন্তানের কল্যাণ নিশ্চিতের জন্য পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে যেভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে। তবে যখন কোন কিছুই কাজ করবে না বা কোনোভাবেই সমস্যার সমাধান করা যাবে না, তখন আইন-আদালতের আশ্রয় নেওয়া উচিত।
লেখক: ব্যারিস্টার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।