অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া : কলহ হয় না এমন দম্পতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আবার পারিবারিক কলহ মেটাতে কাউন্সিলিংয়ের কাছেও যেতে চান না কেউ। তাই তো প্রথমে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসে পরিবার। বিয়ের কথা হলেই, সবার আগে যে বিষয়টি সামনে আসে, তা হলো কাবিন। এতে নিজেদের পাশাপাশি পরিবারেরও থাকে নানা মতামত। অথচ কত টাকার কাবিন হবে সেটা ঠিক না করে, দরকার ছিল বিয়ের আগেই কিছু তথ্য খোলসা করে নেওয়া।
স্পষ্ট করে বললে, নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নেওয়া। যেমন, নিজেদের বিষয়ে কতটুকু পরিবারকে বলব? নিজেদের সমস্যা সমাধানে কতটুকু পরিবারকে যুক্ত করবো? এখানে স্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ জরুরি। না হলে, পরিবারের মধ্যে নানা কথা উঠতে পারে। যেমন, ‘ছেলে তো মা-বোনের বুদ্ধিতে চলে’ বা ‘মেয়ে তো কারও কথাই শোনে না’। এমন অনেক কথা। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে, আমার সঙ্গী কী চাই, আর আমি কি সেটা তাকে দিতে পারছি? তার কাছ থেকে সম্মান আশা করছি, কিন্তু কি দিচ্ছি? আমি যেটা দেব, সেটাই ফেরত পাব।
আমাদের দেশে দুই ধরনের পরিবার দেখা যায়। একটা বৃহত্তর পরিবার, যেখানে বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই আছে। আরেকটি নিউক্লিয়ার পরিবার, যেটা শুধু দম্পতির। পরিবারের কোন সদস্য দাম্পত্য সমস্যায় পড়েছেন। সে ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য হিসেবে এই ক্ষত দূর করতে আপনি কী ভূমিকা নেবেন? মনে রাখবেন, ভালোবাসার জায়গাটা থেকে আপনি যে পরামর্শ দিচ্ছেন, তা তাদের খারাপও লাগতে পারে। হয়তো সমস্যার কথা আপনি পুরোপুরি জানেনই না। এ ক্ষেত্রে একটা সময়ের পর তারা আপনাকেই উল্টো দোষ দিতে পারে।
এ দেশে ছেলে–মেয়ে দুইজনের বিয়েই হয় না, মিলন হয় দুটি পরিবারের। বিয়েতে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই প্রভাবই আছে। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিছু কিছু অভিভাবক যখন শ্বশুর-শাশুড়ি হন, তখন অনেকেই সন্তানের উপর খবরদারির সময় পুরান অভ্যস্ততা ছাড়তে পারেন না। মা মনে করেন, সন্তান বিয়ের কী বোঝে? সন্তান না চাইলেও, অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মা আগ বাড়িয়ে উপদেশ দেন। এই উপদেশ দেন তাদের নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। কিন্তু সেই সময় আর বর্তমানের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সেই আমলে তার শাশুড়ি তাকে জ্বালিয়েছেন। তার মানে যে, বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক নেতিবাচকই হবে। কাজেই পুরান নেতিবাচক অভিজ্ঞতা দিয়ে বর্তমানকে বিচার করলে চলবে না।
নারী নির্যাতনকে বড় করে দেখা হয়, কিন্তু বিবাহিত পুরুষদের নির্যাতনের বিষয়টি দেখি না। নতুন জামাই যখন শ্বশুর বাড়ি যান, আমরা শুধু তার আদর আপ্যায়নই দেখি। কিন্তু ছেলেটিও যে ক্ষেত্রবিশেষে প্রচণ্ড অসহায় বোধ করতে পারে সেই খবর কি রাখি? পেশাগত জীবনে অনেককে বলতে শুনেছি, বিবাহিত জীবনের ৩০ বছর পরেও তোমার বাড়িতে আমাকে এই করেছিল, সেই করেছিল। এই কষ্টগুলো আমরা ভুলি না। ক্ষেত্র বিশেষে একে অপরকে দোষারোপ করি। আর ভেতরে ভেতরে পুড়তে থাকি। এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, জেনারেশন গ্যাপ। যেটা বউ-শাশুড়ি দুইজনকেই খেয়াল করতে হবে। আমি ২৫ বছর ধরে আমার সন্তানকে যা শিখিয়েছি, সেটা কি চট করে অন্য বাড়ির আরেকটা সন্তান এক মাসের শিখিয়ে ফেলতে পারবে? তার জন্য সময় প্রয়োজন। আমরা একটা নির্দিষ্ট বয়স হলেই সন্তানকে বিয়ে দেই। সন্তানের উপর সে আস্থাটা আমার রাখা দরকার। তার সংসার সে নিজের মতন করে করতে পারবে। ভুল করবে, ভুল থেকে শিখবে। আমি যদি আগবাড়ায়ে শুধরাতে যাই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখবো সুবিধা থেকে অসুবিধা বেশি হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরা দোষ দেয় মেয়েদেরকে, আর মেয়েরা ছেলেদেরকে। পরিবারের সদস্যরা পারস্পরিক এত খুঁটিনাটি তথ্য জানে যে, তারা একজন আরেকজনের কাছে খোলা বইয়ের মত। আবার কোন কোন পরিবারের সদস্যরা দূরত্ব বজায় রাখে। এমনকি বিয়ের আগে গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড থাকলেও বিয়ের পর সম্পর্ক সেরকম থাকে না। বিবাহিত রিলেশনশিপের কমিটমেন্ট ভিন্ন। বিবাহিত সম্পর্কতে নতুন মানুষটি পরিবারের অংশ। কাজেই বিবাহিত সম্পর্কে একটা স্পেস স্বামী-স্ত্রীর যেমন প্রয়োজন, সেরকম উভয় শ্বশুরবাড়ির পক্ষের মানুষগুলির নিজেদের মধ্যেও প্রয়োজন। মেয়ে পক্ষকে খেয়াল করতে হবে, আমরা জিনিসটা যেভাবে ইমোশনাল দৃষ্টিতে দেখছি, এটা নতুন সম্পর্কটাকে বাধাগ্রস্ত করছে কী? ছেলের পরিবারকে দেখতে হবে, নতুন বউয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো কি নিজের মেয়ে হলেও করতাম? বউকে এই নতুন পরিবারটিকে বোঝবার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সহমর্মিতা দিয়েছি কী?
অনেক সময় দেখা যায় যৌথ পরিবারের না থেকেও কিছু হলেই একজন ফোন করে, বুদ্ধি নিতে থাকে মায়ের কাছ থেকে। আপনারা যদি এরকম করেন তবে আজকেই সেটা বন্ধ করুন। কারণ আপনার পরিবারের সিদ্ধান্ত আপনি, আপনার জীবনসঙ্গী নেবেন। আপনার বাবা-মা বা শ্বশুর-শাশুড়ির নয়। শ্বশুর-শাশুড়িদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা সন্তান যখন জীবন সঙ্গী বেছে নেয় তখন খেয়াল রাখবেন নেতিবাচক অনুভূতি যেন কোনো ভাবেই তাদের সম্পর্কে না ঢুকে। সম্পর্ক তৈরি করা সহজ কঠিন, আর রক্ষা করা আরও কঠিন। তারপরও যদি দেখা যায় নিজেদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মতবিরোধ হচ্ছে তবে, পরিবারের হস্তক্ষেপ অবশ্যই নয়, প্রয়োজনে কাঁপল থেরাপি। সাইকোথেরাপি বা ফ্যামিলি থেরাপি নিতে পারেন অর্থাৎ পেশাদারের সাহায্য নেবেন। কারণ কখনো কখনো শুধু পারস্পরিক খোলামেলা আলোচনা সমাধানের পথ দেখায় না। যদি আমার মধ্যে সহানুভূতির বদলে সহানুভূতি না থাকে খোলামেলা আলোচনায় লাভ হবে না।
সম্পর্কগুলো কোন প্রতিযোগিতা নয়, বিনিয়োগ। জীবনসঙ্গী আমার নিজের জন্যই প্রয়োজন। এখানে ভাল থাকতে হলে, কীভাবে তাল মেলাবো নিজের আত্মসম্মানকে রেখে এক কথায় অভিযোজিত (adapt করা) হব সেটা নিজেকেই শিখতে হয়। দাম্পত্য সম্পর্কের ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে দুই পরিবারের নেতিবাচক প্রভাব ফেললে যা করবেন।
১. প্রয়োজনে এগিয়ে এসে কথা বলুন।
২. আমি যা ভাবছি সবসময় যে সেটাই ঠিক, এই মনগড়া ভাবনাকে প্রশ্রয় দেবেন না।
৩. শান্তভাবে খোলামেলা আলোচনা করুন।
৪. উত্তেজিত হয়ে কথা বলা যাবে না।
৫. নিজের মতামত চাপিয়ে দিয়ে নয়, পরস্পরকে বুঝতে চেষ্টা করুন।
৬. অপর পক্ষের দুর্বলতাকে খোঁচা দিবেন না।
৭. দাম্পত্যে তৃতীয় ব্যক্তিকে ঢুকতে না দিলে ভালো।
স্ত্রীকে নিয়ে নীল ভিডিও বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বরখাস্ত
লেখক: চিকিৎসক, কাউন্সেলর সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বাংলাদেশ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।