জিন্নাতুন নূর : বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা জায়েদুর রহমান। ছুটির দিন বাদে অফিস শেষে এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে একটু গল্প করে রাত ৮টায় বাড়ি ফেরেন। ১০টায় খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়েন। তার ছোট সন্তানকে ঘুম পাড়িয়ে স্ত্রী নীলা রহমানও ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু জায়েদুর হাতে থাকা মোবাইল নিয়ে ডুবে যান ইন্টারনেটের দুনিয়ায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক থেকে শুরু করে টিকটক, ইউটিউবে ঘুরে বেড়ান। বাদ যায় না নেটফ্লিক্স, চরকি, জি প্রাইমের মতো অ্যাপ। রাত ২টা পার হয়ে যায় কিন্তু জায়েদুরের চোখে ঘুম নেই। একপর্যায়ে মোবাইল রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলেও সহজে ঘুমাতে পারেন না। সকাল ৭টায় যখন অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন তখন অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে মাথা ও গায়ে ব্যথা অনুভব করেন। অফিসে গিয়ে ক্লান্তি বোধ করেন। কাজে মন বসাতে পারেন না। এতে তার কর্মঘণ্টাও নষ্ট হয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সার্ফিন আহমেদ। করোনাকালে ক্লাস ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের পুরোটাই করেছেন মোবাইল দিয়ে। এখন সশরীরে ক্লাস শুরু হলেও তার মোবাইল আসক্তি কমেনি, উল্টো বেড়েছে। রাতে দীর্ঘক্ষণ ইউটিউবে নাটক বা ব্লগ দেখার অভ্যাস ছাড়তে পারছেন না। এ ছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে মেসেনজারে গ্রুপ চ্যাটেও রাত জেগে গল্প করেন। কখনো কখনো সিনেমা দেখেন। তিনি জানান, বেশির ভাগ দিনই রাত ৩টার পর ঘুমাতে যান। অভ্যাস এমনই হয়েছে যে এখন এর আগে তার ঘুম আসে না। অথচ এ কারণে সকালের ক্লাস প্রায়ই ধরতে পারেন না সাফিন।
এ ছাড়া ফেসবুকে গভীর রাত পর্যন্ত এখন বিভিন্ন পেজ থেকে নারীদের পোশাক, কসমেটিকসহ নানা রকম পণ্যের লাইভ প্রচার চালানো হয়। এ লাইভগুলো গভীর রাত পর্যন্ত দেখতে জেগে থাকেন অনেকেই। আর এসব লাইভের মূল দর্শকই হচ্ছেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীসহ গৃহিণী ও কর্মজীবী নারী।
করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ কয়েকটি জরিপ চালায় বেসরকারি সংস্থা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, করোনাকালে ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন। এর অধিকাংশই শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ দৈনিক ছয় ঘণ্টার বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অতিমাত্রায় ব্যবহার করেন। আবার লকডাউনে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সাত-আট ঘণ্টার ওপরে ভার্চুয়াল স্ক্রিনের সামনে থাকেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীর প্রায় সবাই দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে থাকায় মাথাব্যথা, মনোযোগ কমে যাওয়া, অনিদ্রার সমস্যার সম্মুখীন। এ কারণে ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশের মাথাব্যথা, ৫১ শতাংশের ঘুমের সমস্যা, ৩৩ দশমিক ১ শতাংশের চোখের সমস্যা, ৩৮ দশমিক ২ শতাংশের অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, ঘাড়, হাত ও পিঠের ব্যথা ৩০ দশমিক ৪ শতাংশের, ৩০ দশমিক ৪ শতাংশের ওজন বৃদ্ধি, ২১ দশমিক ৭ শতাংশের পারিবারিক দূরত্ব বেড়ে যাওয়া, ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশের মনোযোগ বা স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার সমস্যা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যারা দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের মানুষের উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই বিষণ্নতায় ভোগেন। আবার মোবাইল স্ক্রিনের দিকে বেশি সময় ধরে তাকিয়ে থাকলে ঘুমের সময় যে হরমোন শরীর থেকে নির্গত হওয়ার কথা তা কম বের হয়। এ অবস্থায় ১০ মিনিট মোবাইল ব্যবহার করলেই আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা ঘুম আসে না। আর পর্যাপ্ত ঘুম না হলে কাজের ব্যাঘাত ঘটে। আবার অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে দৈনিক কাজের রুটিনেও সামঞ্জস্য আনা যায় না। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে সকালে যে শারীরিক ব্যায়াম করার কথা তা আর করা হয় না। এতে শরীরে যে ভিটামিন ডি নেওয়ার কথা তা আর হয় না। শ্রেণিকক্ষে বা কর্মক্ষেত্রেও ঠিকভাবে মন বসানো যায় না। এতে একজন ব্যক্তির কাজের ক্ষেত্রে উৎপাদন ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ বলেন, ‘বর্তমান যুগে মোবাইল ব্যবহার যেহেতু একেবারে বন্ধ করা যাবে না এজন্য সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে, মোবাইল যেন কাউকে নিয়ন্ত্রণ না করে। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে হবে। প্রাত্যহিক কর্মঘণ্টার জন্য নির্দিষ্ট সময়সূচি মানতে হবে। সপ্তাহে এক দিন শুক্রবার বা শনিবার সারা দিন মোবাইল বা ল্যাপটপ স্ক্রিন থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে।’ সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।