বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : লিথিয়াম-আয়ন বা লি-আয়ন ব্যাটারিকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করে তোলার অনন্য এক উপায় খুঁজে পেয়েছেন আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় ডালাসের একদল গবেষক। গবেষণায় তাঁরা লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে ব্যবহৃত লিথিয়াম নিকেল অক্সাইড (LiNiO₂) রাসায়নিক যৌগটি কেন ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তার মূল কারণ বের করতে পেরেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই গবেষণাটির বিস্তারিত সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞানবিষয়ক পিয়ার-রিভিউড জার্নাল অ্যাডভান্সড এনার্জি ম্যাটেরিয়ালসে।
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি হচ্ছে বহুল ব্যবহৃত এক প্রকার রিচার্জেবল ব্যাটারি। এতে থাকা লিথিয়াম আয়নগুলো চার্জিং ও ডিসচার্জিংয়ের সময় অ্যানোড (নেগেটিভ ইলেকট্রোড) ও ক্যাথোড (ধনাত্মক ইলেকট্রোড) এর মধ্যে চলাচল করে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে ক্যাথোড বা পজিটিভ ইলেকট্রোড (বিদ্যুদ্বাহক) হিসেবে ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম নিকেল অক্সাইড (LiNiO₂)। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মূলত এই লিথিয়াম নিকেল অক্সাইড নিয়েই সম্প্রতি গবেষণা করেছেন।
গবেষকরা লিথিয়াম নিকেল অক্সাইডকে (LiNiO₂) স্থিতিশীল করার নতুন কৌশল বের করতে পেরেছেন, যার কল্যাণে অচিরেই ঘন ঘন ব্যাটারি পরিবর্তনের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে পারেন ব্যবহারকারীরা। যুগান্তকারী এই গবেষণার ফলে বৈদ্যুতিক যানবাহন, এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির জন্য আরও দীর্ঘস্থায়ী লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৫০-এর দশকে আবিষ্কৃত লিথিয়াম নিকেল অক্সাইড (LiNiO₂) মূলত লিথিয়াম, নিকেল ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে তৈরি একটি রাসায়নিক যৌগ। এতে বিদ্যমান তড়িৎ রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য একে রিচার্জেবল ব্যাটারিতে ক্যাথোড ম্যাটেরিয়াল হিসেবে ব্যবহারের জন্য দারুনভাবে উপযোগী করে তোলে। তবে বার বার চার্জিং ও ডিসচার্জিংয়ের (চার্জিং সাইকেল) কারণে এটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এবার এই সমস্যার মূল কারণ ও সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
মোটামুটি দু’দশক আগে প্রচলিত ক্যাথোড ম্যাটেরিয়ালের এক সম্ভাবনাময় বিকল্প হয়ে উঠে লিথিয়াম নিকেল অক্সাইড। তবে এর আভ্যন্তরীণ কাঠামোগত স্থিতিশীলতার অভাবে ব্যাপক আকারে এর গ্রহণযোগ্যতা গড়ে উঠেনি, ফলে এর বিস্তৃত ব্যবহারও নিশ্চিত করা যায়নি।
দীর্ঘস্থায়ী লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি পেতে মূল প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী?
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির সক্ষমতা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় চার্জিং সাইকেলের (চার্জিং ও ডিসচার্জিং) সময়। এর পেছনে কারণ মূলত তিনটি- অপরিবর্তনীয় ফেজ ট্রানজিশন (রুপান্তর), ক্যাশন মিক্সিং ও অক্সিজেনের ক্ষয়। চলুন সংক্ষেপে এই তিনটি বিষয় জেনে নেওয়া যাক।
অপরিবর্তনীয় ফেজ ট্রানজিশন (রুপান্তর): চার্জিং সাইকেল অর্থাৎ চার্জিং ও ডিসচার্জিংয়ের সময় ব্যাটারিতে বিদ্যমান ম্যাটেরিয়ালগুলো, বিশেষ করে ক্যাথোড, আভ্যন্তরীণ গঠনগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। চার্জিং ও ডিসচার্জিংয়ের মধ্যে ট্রানজিশন বা রুপান্তরের সময় যে পরিবর্তন সাধিত হয় সেটা সাধারণত সাময়িক হয়ে থাকে। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে ট্রানজিশনের পর ম্যাটেরিয়ালগুলো তাদের পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসার কথা। তবে কিছু কিছু ট্রানজিশনের পর ম্যাটেরিয়ালগুলো আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। এর ফলে ব্যাটারির লিথিয়াম আয়ন সংরক্ষণ ও নিঃসরণ করার ক্ষমতা ব্যাহত হয়, যেটা সার্বিকভাবে ব্যাটারি সক্ষমতা হ্রাস করে।
ক্যাশন মিক্সিং: ব্যাটারির ক্যাথোড ম্যাটেরিয়ালে মেটালের তৈরি বিভিন্ন আয়নগুলো নির্দিষ্ট কাঠামোতে সুবিন্যস্ত থাকে। এই মেটাল আয়নগুলোকেই ক্যাশন বলা হয়। চার্জিং সাইকেলের সময় এই আয়নগুলো নিজেদের মধ্যে অবস্থান পরিবর্তন করে, ফলে সুশৃঙ্খল কাঠামোতে বিঘ্ন ঘটে। এই বিষয়টিকেই ‘ক্যাশন মিক্সিং’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ‘ক্যাশন মিক্সিং’ লিথিয়াম আয়নের চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, ফলে ব্যাটারির চার্জ ধরে রাখার ক্ষমতা ও পারফরম্যান্স দুটোই হ্রাস পায়।
অক্সিজেনের ক্ষয়: কিছু ক্যাথোড ম্যাটেরিয়াল চার্জিংয়ের সময় অক্সিজেন পরমাণু (অ্যাটম) হারাতে পারে, বিশেষ করে হাই ভোল্টেজে। অক্সিজেন হ্রাস পাওয়ায় ব্যাটারির অভ্যন্তরে কাঠামোগত অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় এবং অবাঞ্ছিত কিছু বাইপ্রোডাক্টের-ও উৎপত্তি ঘটে। ফলে ব্যাটারির সক্ষমতা আরও হ্রাস পায়- যেটা হাই ভোল্টেজে আরও ত্বরান্বিত হয়।
অপরিবর্তনীয় ফেজ ট্রানজিশন (রুপান্তর), ক্যাশন মিক্সিং ও অক্সিজেনের ক্ষয়- সার্বিকভাবে এই তিনটি কারণে ব্যাটারির স্থায়িত্ব উল্লেখযোগ্যহারে কমে যায়। ফলে হাই-এনার্জি-ডেনসিটি অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির বাণিজ্যিক ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়ে।
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির স্থায়িত্ব বাড়াতে গবেষকরা যে পথে এগোচ্ছেন
এই সমস্যার সমাধানে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় ডালাসের গবেষকরা কমপিউটেশনাল মডেলিং ব্যবহার করেছেন, যার মাধ্যমে চার্জিংয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঘটে যাওয়া পারমাণবিক-স্তরের প্রক্রিয়াগুলো বিশ্লেষণ করা যায়। গবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, লিথিয়াম নিকেল অক্সাইড (LiNiO₂) কাঠামোর মধ্যে বিদ্যমান একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া (যাতে অক্সিজেন পরমাণুও রয়েছে) ম্যাটেরিয়ালকে অস্থিতিশীল করে তোলে এবং ফাটল ধরায়।
বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে গবেষকরা একটি তাত্ত্বিক সমাধান বের করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁরা লিথিয়াম নিকেল অক্সাইডের কাঠামোকে শক্তিশালী (রিইনফোর্স) করতে পজিটিভ চার্জসমৃদ্ধ ক্যাশন বা মেটাল আয়ন নিয়ে আসার প্রস্তাব করেছেন। এই ক্যাশনগুলো ‘পিলার’ (স্তম্ভ) হিসেবে কাজ করবে ম্যাটেরিয়ালের কাঠামোতে। ফলে ম্যাটেরিয়ালগুলো আরো শক্তিশালী হবে এবং এদের ক্ষয়রোধ সম্ভবপর হয়ে উঠবে।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় ডালাসের ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রসেফর ডক্টর কিয়ংজায়ে চো বলেন, ‘লিথিয়াম নিকেল অক্সাইড (LiNiO₂) দিয়ে তৈরি ব্যাটারি ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার সমস্যাটি কয়েক দশক ধরেই বিদ্যমান, কিন্তু এর মূল কারণ ভালোভাবে নির্ণয় করা যাচ্ছিল না। এখন আমরা পরিষ্কার ধারণা পেয়েছি কেন এমনটা হয়, আমরা এর সমাধান বের করতে কাজ করছি যাতে করে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফোন ও বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো নানাবিধ পণ্যে আরও দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি নিয়ে আসা যায়।’
উল্লেখ্য, টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় ডালাসের বিকনস প্রোগ্রামের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন প্রসেফর ডক্টর কিয়ংজায়ে চো। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া বিকনস প্রোগ্রামটির লক্ষ্য হচ্ছে নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তি ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিকাশ ও বাণিজ্যিকীকরণ, আভ্যন্তরীণ বাজারে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল আরও সহজলভ্য করে তোলা এবং ক্রমবিকাশমান ব্যাটারি স্টোরেজ সেক্টরে পর্যাপ্ত দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা। ল্যাবরেটরির পরীক্ষা থেকে পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে রুপান্তরের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করাও এই উদ্যোগের অন্যতম উদ্দেশ্য।
ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অধ্যয়নরত পিএইচডি শিক্ষার্থী ম্যাথিউ বার্গশ্নাইডার উক্ত গবেষক দলের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য। তিনি বর্তমানে রোবটিক্সের ওপর ভিত্তি করে এমন একটি ল্যাব তৈরি করছেন যেখানে এই ব্যাটারির প্রোটোটাইপ তৈরি করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে অল্প পরিমাণে উৎপাদন করব এবং প্রক্রিয়াটিকে আরও উন্নত করে তুলব। এরপর আমরা ‘বিকনস’-এর উৎপাদন কেন্দ্রে (ফ্যাসিলিটিতে) বিভিন্ন উপাদানের সংশ্লেষ (ম্যাটেরিয়াল সিনথেসিস) বাড়াব এবং প্রতি সপ্তাহে শত শত ব্যাটারি তৈরি করবো। বাণিজ্যিকীকরণের দিকে এগুলো সবই একেকটি পদক্ষেপ।’
লিথিয়াম নিকেল অক্সাইড (LiNiO₂)-এর ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার মূল কারণ চিহ্নিত করে গবেষকরা লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির স্থায়িত্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিদ্যমান বড় একটি প্রতিবন্ধকতার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। পরবর্তী প্রজন্মের লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরিতে এটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
এবারে গবেষকদের লক্ষ্য হচ্ছে ল্যাব-পর্যায়ে এই নতুন প্রযুক্তির লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির উৎপাদন শুরু করা। এক্ষেত্রে ইন্ডাস্ট্রিতে সক্রিয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অংশীদার হিসেবে যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে তাঁদের। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি পর্যায়ে ও শিল্পকারখানায় বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে এক সময় আরও দীর্ঘস্থায়ী ও উচ্চ সক্ষমতার ব্যাটারির দেখা পাওয়া যাবে, এমনটাই লক্ষ্য ও প্রত্যাশা গবেষকদের।
তথ্যসূত্র: ইনটারেস্টিং ইনজিনিয়ারিং
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।