শিশুজন্মের পর থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ শিশুর জন্য আদর্শ খাদ্য। এ সময় শিশুর জন্য একফোটা পানিরও প্রয়োজন নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, মায়ের বুকের দুধ শিশুর সঠিক বিকাশে সাহায্য করে। ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি পরিপূরক বাড়তি খাবার দেওয়া প্রয়োজন। অথচ এখনো দেশের ৪৫ শতাংশ মা তাদের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারছেন না।
তারা বলছেন, শিশুর প্রথম ছয় মাস মায়ের বুকের দুধ (এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং) শিশুর অপুষ্টিজনিত সমস্যা কমায় এবং ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শিশুমৃত্যু কমায়। দুধ না খাওয়ালে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। ডায়রিয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১১ গুণ বাড়ে। এ ছাড়া অপুষ্টি ও অন্যান্য কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১৪ গুণ বৃদ্ধি পায়। শিশুর জন্মের প্রথম ঘণ্টায় মায়ের সাল দুধ শিশুকে টিকার মতো সুরক্ষা দিয়ে থাকে। এই সাল দুধ খাওয়ানোর হার আগের চেয়ে কিছু বাড়লেও এখনো তৃণমূলে সাল দুধ খাওয়ানোর প্রবণতা কম। শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নেই। জন্মের পর শিশুর বেঁচে থাকা এবং স্বাভাবিকভাবে সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য মায়ের বুকের দুধের ভূমিকা অপরিসীম। শিশুকে সুস্থ সবলভাবে গড়ে তুলতে এবং নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি কর্মস্থলে দিবাযত্ন কেন্দ্র ও ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তা দেখা যায় না।
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ বিডিএইচএসের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ সালে ৬৫ শতাংশ শিশু মায়ের বুকের দুধ পেলেও, বর্তমানে এ হার কমে হয়েছে ৫৫ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরায়ণ ও কর্মজীবী নারীর হার বেড়ে যাওয়া এবং কর্মজীবী মায়েদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশসহ বুকের দুধ পান করানোর পর্যাপ্ত কর্নার না থাকা। সেইসঙ্গে ফর্মুলা দুধ উৎপাদক ও বাজারজাতকারীদের বিজ্ঞাপনের কারণে দিন দিন সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পানের হার কমছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটা শিশুর যতটুকু পুষ্টি দরকার, তার সবটাই আসে মায়ের বুকের দুধ থেকে। আমরা বলি, প্রথম ছয় মাস শিশুর একফোটা পানিরও প্রয়োজন পড়ে না। যখন একটি শিশু মায়ের গর্ভে থাকে, তখন থেকে তার মস্তিষ্কের বিকাশ শুরু হয়। জন্মের পর শিশুর মস্তিষ্কের নতুন করে কোনো কোষ তৈরি হয় না। একটা শিশু ১০ হাজার কোটি মস্তিষ্কের কোষ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পর এই কোষগুলোর ২৫ শতাংশের যোগাযোগ বা সংযোগ থাকে নিউরনে। বাকিগুলোর মধ্যে ৯৫ শতাংশের সংযোগ স্থাপনের কাজ জন্মের তিন বছরের মধ্যে হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে দেখা যায়— যারা ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পান করেছে, তারা অন্যদের তুলনায় ৩৫ শতাংশের বেশি মেধাবী হয়। তাই এখানে ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
পুষ্টিবিদ সামিয়া তামনিম ইত্তেফাককে বলেন, মায়ের বুকের দুধ শিশুর আদর্শ খাবার। এর বিকল্প শিশুর জন্য আর কিছু নেই। অনেকে মনে করেন শিশুকে গরুর দুধে পানি মিশিয়ে খাওয়ালে ঠিক আছে, কিন্তু পানি মেশালেই তো গরুর দুধের উপাদানগুলো বদলে যায় না। যেমন মায়ের দুধে প্রোটিনের যে পরিমাণ আছে সেটার সঙ্গে গরুর দুধের প্রোটিনের পরিমাণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মায়ের বুকের দুধে শিশুর জন্য যতটুকু প্রোটিন থাকা প্রয়োজন তা থাকার কারণে শিশুর কোনো ক্ষতি হয় না। বরং শিশু যে বেড়ে ওঠা সেটা ঠিকমতো হয়। মায়ের দুধ শিশুর জন্য আদর্শ, সেখানের শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য আমিষ, চর্বি এবং অন্য যে উপাদানগুলো প্রয়োজনীয় অনুপাতে থাকে। যাতে বাচ্চার শারীরিক গঠন সুন্দরভাবে হয়। মায়ের দুধ পানে বাচ্চার শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়, যা বাচ্চার রোগপ্রতিরোধে কাজ করে। শিশুর ঠাণ্ডা, কাশি জ্বর, বা যে কোনো ধরনের ইনফেকশন থেকে শিশুকে দূরে রাখতে এন্টিবডিগুলো ভালো কাজ করে। মায়ের দুধে ভালো ফ্যাট আছে, যা শিশুর মানসিক বিকাশ ভালোভাবে করতে পারে। মায়ের দুধে শিশুর ছয় মাস পর্যন্ত পরিপূর্ণ গঠন করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। কিন্তু ছয় মাস পরে শিশুর মায়ের বুকের দুধের সাথে বাড়তি খাবার যোগ করতে হয়।
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (দায়িত্বপ্রাপ্ত) ডা. রওশন জাহান আখতার আলো বলেন, ১ থেকে ৭ আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে।
মায়ের দুধের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ১ আগস্ট থেকে পালিত হয়—‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ-২০২৫’। সপ্তাহ উপলক্ষে অন্তঃসত্ত্বা মা, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মাতৃদুগ্ধ দান, মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য এবং পুষ্টিবিষয়ক অবহিতকরণসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্টফিডিং অ্যাকশনের (ডাব্লিউএবিএ) দেওয়া এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘টেকসই সহায়তা ব্যবস্থা তৈরি করুন’। ১৯৯০ সালে ইউনিসেফ বিশ্বব্যাপী শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য বুকের দুধ খাওয়ানোর গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিতে ইনোসেন্টি ঘোষণা করে। ১৯৯১ সালে ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্টফিডিং অ্যাকশন গঠন হয়। প্রথম বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ ১৯৯২ সালে পালিত হয়। প্রতি বছর ১ থেকে ৭ আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।