সাহানোয়ার সাইদ শাহীন : দেশে মোট উৎপাদিত চালের প্রায় অর্ধেকই আসে আমন মৌসুমে। সেই আমনের বেশির ভাগই আবার উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে উৎপাদন করা হয়। কিন্তু গত কয়েক দশকের ব্যবধানে উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি ও ভূমি গঠনে বড় পরিবর্তন এসেছে। প্রতিনিয়তই বাড়ছে খরা। এর পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ জন্য গত কয়েক বছরে ধান আবাদের জমিতে আমের বাগান করছেন এ অঞ্চলের কৃষক। একসময়ে স্বর্ণা জাতের ধান আবাদ করলে নানা রোগে এই জাতটি ফলন কম দিয়েছে। এতে ধান উৎপাদনে, বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তবে সেই শঙ্কা এখন অনেকটাই কাটতে শুরু করেছে। খরাসহিষ্ণু জাত ও আমবাগানের মধ্যে ধানের আবাদ করা যাবে—এমন জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। তিন বছর ধরে পাইলট আকারে রাজশাহী বিভাগে উৎপাদনের মাধ্যমে সফলতা এসেছে।
কিছুদিন আগে উত্তরাঞ্চলের এই পরিবর্তন দেখার সুযোগ হয়েছিল। রাজশাহী আঞ্চলিক ধান গবেষণা কেন্দ্র ছাড়াও নাটোরের বাগাতিপাড়ার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে আলাপের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে দেখেছি দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের সোনালি ধান। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি আমবাগান। একসময় এ অঞ্চলের কৃষকরা স্বর্ণা ধান চাষ করতেন। কিন্তু স্বর্ণা বেশ মোটা। ফলনও কম। খরার কারণে রোগে আক্রান্ত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে কৃষি বিভাগের পরামর্শে গ্রামের তিন-চারজন কৃষক ব্রিধান৮৭ জাতের ধানের আবাদ শুরু করেন। এখন ব্রিধান৮৭ ধানের ফলন দেখে পুরো গ্রামের কৃষকই এটি চাষ করেছেন। সারা দেশে জাতটি ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে ব্রি। ব্রিধান৮৭ ধান কেটে সরিষা, মসুর ডাল, ছোলাসহ বিভিন্ন ডালজাতীয় ফসল আবাদ করা হচ্ছে।
ব্রিধান৮৭ ধানের চাল বেশ চিকন। ধানের বাজারমূল্যও বেশি। প্রতি মণ ধান এক হাজার ৩৫০ টাকা করে পাওয়া যাচ্ছে। এই ধান ব্লাস্ট প্রতিরোধী। গাছ শক্ত, শীষ বড়। বাতাসে হেলে পড়ে না। পোকার আক্রমণ নেই, জীবনকালও কম। হেক্টরপ্রতি সাড়ে সাত টন ফলন পাওয়া যাচ্ছে। বাড়তি সুবিধার কারণে ব্রিধান৮৭ ধান উত্তরাঞ্চলের কৃষকের কাছে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তা ছাড়া এই জাতের ধানের বীজ সংরক্ষণ করা যায়।
আবার এই ধানের জাত আমবাগানের সারির মধ্যে আবাদ করা যাচ্ছে। আমবাগানে ব্রিধান৮৭ ধান কৃষকের বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। একসময় আমবাগান সারা বছর খালি পড়ে থাকত। ব্রিধান৮৭ ধানগাছ বেশ শক্ত হওয়ায় কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আমের পাশাপাশি ধানও পাওয়া যাচ্ছে। ফলনও ভালো। এতে গ্রামের অন্য আমবাগানের মালিকরাও একই পথে হাঁটছেন। এ জাতের ধানে চিটা নেই বললেই চলে। আগাম ফসল কাটতে পারায় ওই জমিতে এখন সরিষা, আলুসহ অন্যান্য রবিশস্য চাষ করা সম্ভব হচ্ছে।
ব্রির বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্রিধান৮৭ জাতের চিকন ধান। প্রতি ৩৩ শতাংশ জমিতে ২৭ থেকে ৩০ মণ পর্যন্ত ফলন হয়ে থাকে। স্বর্ণা ধানের জীবনকাল ১৪৫ দিন আর ব্রিধান৮৭ চিকন আমন ধানের জীবনকাল ১২৭ দিন। স্বর্ণা ধান কাটার গড়ে ১৫ দিন আগেই কাটা যায় ব্রিধান৮৭ জাতের চিকন আমন ধান। মোটা জাতের স্বর্ণা ও গুটি স্বর্ণা ধান বাজারে বিক্রি করতে গেলে ভালো দাম পাওয়া যেত না। আর ব্রিধান৮৭ ধান বাজারে নিয়ে গেলে আড়তদার, চাতাল মালিক ও মহাজনরা বেশি দামেই কিনছেন।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরাপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে আশার আলো দেখাচ্ছে জাতটি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে উচ্চ ফলনশীল ব্রিধান৮৭ ধানটির আবাদ সম্প্রসারণে যৌথভাবে কাজ করতে হবে ব্রি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে। আমন মৌসুমের প্রধান শস্যে পরিণত করতে পারলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি দেশের কৃষক এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারবেন।
লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের কণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।