জুমবাংলা ডেস্ক : একটি বিশেষ ধরনের খাবার যে কীভাবে একটি ছোট্ট নিভৃত পল্লীর নাম ও সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে পারে তা দেখতে হলে যেতে হবে রাজশাহীর সবচেয়ে কাছের উপজেলা পবার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের মড়মড়িয়া গ্রামে। ঝকঝকে তকতকে সরু পিচঢালা সড়ক ধরে শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের এই ছোট্ট গ্রামটি যেন ঘন সবুজ গালিচার চাদরে মোড়ানো।
চীর তরুণ, উজ্জ্বল, চঞ্চল এক অসম্ভব মায়ায় জড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এমনই এক গ্রাম, যিনি একবার গেছেন; তিনি বারবার যাবেন। একটি বিশেষ খাবার এই গ্রামের পরিচিতি নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। আর সেই খাবারটির নাম ‘হাঁসের মাংসের কালাভুনা’।
অতি পরিচিত হলেও বাসাবাড়িতে সচরাচর খাওয়া হয়ে ওঠে না হাঁসের সুস্বাদু মাংস। এর কারণও রয়েছে ঢের। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই হাঁসের কালাভুনা এখন রাজশাহীর ক্রেজ। ফুডিদের কাছে নতুন হাইপ। আর ভোজনরসিকদের কাছে অমৃত। এই হাঁসের কালাভুনা মাংসের কারণেই সবুজ-শ্যামল মড়মড়িয়া গ্রামের অপার সৌন্দর্য পেয়েছে নতুন মাত্রা ও পরিচিতি।
এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর কালাভুনার টানে দেশের আনাচে কানাচে থেকে প্রতিদিনই তরুণ-তরুণী, যুবা-বুড়োসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ ঝাঁক বেঁধে ঢু মারছেন মড়মড়িয়ায়।
এক হাঁসের মাংসের কালাভুনা পাল্টে দিয়েছে এই গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতি। স্থানীয়ভাবে ঘটেছে বেকার যুব নারী ও যুবদের কর্মসংস্থান। হাজারো ভোজনপটু মানুষের পদচারণার কারণে যেখানে রোজ বিক্রি হয় লাখ টাকার হাঁসের কালাভুনা। আর খাবারের এই পদটির দোকান কেন্দ্র করে আশপাশে গড়ে উঠেছে পান, মনোহারী ও কোমল পানীয়সহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের দোকানও।
যেভাবে প্রতিদিন মধ্য দুপুরে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে এই গ্রামে ঢোকে আর বের হয়; বাইরে থেকে তা দেখলে মনে হবে গ্রামের ভেতর কোনো বড় ধরনের বিয়ের দাওয়াত অনুষ্ঠান চলছে। শুধুমাত্র হাঁসের মাংস খাওয়ার জন্যই মানুষ বহু ক্রোশ দূর থেকে ছুটে আসছেন এই মড়মড়িয়া গ্রামে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট, খুলনা নয়, সারাদেশ থেকেই আসা ভোজনরসিকদের উপচে পড়া ভিড় লেগে থাকে এখানে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত নেই- এখানে মাটির চুলোয় খড়ির আগুনে প্রতি ঋতুতে প্রতি দিনই কড়ই কড়ই হাঁসের কালাভুনা রান্না করেন গ্রামের রাঁধুনি শিল্পীরা।
এর সুবাস ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের সড়কে। যার ঘ্রাণ ও রান্নার দৃশ্য দেখেই জিভে জল চলে আসে ভোজনরসিকদের। অল্প টাকায় রসনা পূজায় জুড়ি নেই এই গ্রামে। তাই মাত্র দুই বছরের মধ্যে গ্রামটির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-বিদেশে। খেতে পছন্দ করেন আর রাজশাহীর মড়মড়িয়া গ্রামের নাম শোনেনি বা জানেন না এমন মানুষ তাই এখন খুঁজে পাওয়াই ভার।
রাজশাহী শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে পবা উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের মড়মড়িয়া হাট এখন তাই হাঁসের মাংস খাওয়ার জন্য তুমুল জনপ্রিয়। অথচ দুই বছর আগেও এই এলাকার নাম তেমন কেউই জানতেন না। ছিল না বিশেষ কোনো পরিচিতিও। কিন্তু একটি দুটি করে এখন মোট তিনটি বড় খাবার হোটেল তৈরি হয়েছে এই ছায়া ঘেরা গ্রামীণ সবুজ পরিবেশে।
মড়মড়িয়ায় দুপুর বেলা পাওয়া যায় রাজ হাঁস ও পাতি হাঁসের মাংস ও ভাত। ভোজনরসিকরাও দূর দূরান্ত থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটে আসছেন এ গ্রামে খাবারের স্বাদ নিতে। খাবার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রিভিউও দিচ্ছেন অনেকে। তা দেখে আবার অন্যরা ছুটছেন।
দর্শনপাড়া গ্রামের কুটুমবাড়ি হোটেল মূলত নতুন ভাবধারায় মানুষের রুচি ও ভোজনবিলাসে ভিন্ন মাত্রা ও বৈচিত্র্য আনতে এই হাঁসের কালাভুনা রান্না ও বিক্রি শুরু করেন। এরপর তার অবাক করা সফলতা দেখে পাশেই তালুকদার বাড়ি ও বিয়ান বাড়ি নামে সামনাসামনি আরও দুটি খাবার হোটেল গড়ে ওঠে মড়মড়িয়া গ্রামে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, শুরুটা হয়েছিল স্থানীয় বাসিন্দা ষাটোর্ধ সাবু মিয়ার হাত ধরে। হাটের অদূরে ব্রিজের পাশে তার হাঁসের মাংসের হোটেল ছিল। এই হাঁস আনতে গিয়েই সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। এরপর সাবেক ইউপি সদস্য হাসান আলী ‘কুটুম বাড়ি’ নাম দিয়ে এখানে নতুনভাবে হাঁসের মাংসের হোটেল খুলে বসেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। উল্টো তাকে অনুকরণ করে কুটুম বাড়ি হোটেলের নামের সাথে মিল রেখে গড়ে তোলা হয়েছে আরও দুটি হোটেল।
এগুলো হচ্ছে- তালুকদার বাড়ি হোটেল ও বিয়াইন বাড়ি হোটেল। তবে স্বাদে গুণে অনন্য হওয়ায় প্রথমে প্রতিষ্ঠিত কুটুম বাড়ি হোটেলেই মানুষের ভিড় বেশি হয়। গ্রামের মধ্যে হলেও সাধ্যানুযায়ী পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি পরিবেশে সুস্বাদু হাঁসের মাংসের কালাভুনা তারা তুলে দেন দূর দূরান্ত থেকে যাওয়া ভোজনরসিকদের মুখে।
পবা উপজেলার মড়মড়িয়া গ্রামে এখন প্রতিদিন লাখ টাকার হাঁসের মাংস বিক্রি করেন স্থানীয় বিক্রেতারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে স্থানটি। এই হাঁসের মাংসের বিশেষ কালাভুনার প্রচারণা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। তরুণ-তরুণীরা এখানে এসে খেয়েদেয়ে রিভিউ করছেন ফেসবুকে। আর এভাবে দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। এজন্য কুটুম বাড়িসহ তিনটি হোটেল মিলিয়ে হাঁস প্রয়োজন হয় অন্তত ২৫০টি। আর রোজকার ভোজনরসিকের সংখ্যা হাজারের ওপর। এতে দৈনিক লাখ টাকার হাঁসের মাংস বেচাকেনা হয় পবা উপজেলার এই মড়মড়িয়া গ্রামে।
মড়মড়িয়া গ্রামের কুটুম বাড়ি হোটেলের স্বত্বাধিকারী সাবেক ইউপি সদস্য হাসান আলী জানান, সাধারণ হাঁসের মাংস কাটাকুটি বেশ ঝামেলার। তাই সবাই হাঁসের মাংস পছন্দ করলেও বাড়ির গৃহিণীরা কষ্টের ভয়ে বাড়িতে হাঁসের মাংস কমই তোলেন। বিশেষ কোনো উপলক্ষ ছাড়া এর স্বাদ নেওয়া হয়ে ওঠে না। সেইখানে নির্ঝঞ্ঝাটভাবে এখানে এসে সুস্বাদু হাঁসের মাংসের স্বাদ নিতে পারেন। তাই যতই দিন যাচ্ছে মানুষজন হাঁসের মাংস খাওয়ার জন্য এমন রেস্তোরাঁমুখী হচ্ছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে হাসান আলী বলেন, এখানে পুরাদস্তুর গ্রামে লালনপালন করা দেশি জাতের হাঁসের মাংস, হাতে বাটা মসলা আর মাটির চুলোয় খড়ি দিয়ে রান্না করা হয় বলেই এ মাংসের স্বাদ এত অতুলনীয়। আর এখানে খাবারের দামও বাইরের চেয়ে তুলনামূলক কম।
তার খাবার হোটেলে দুই ধরনের হাঁসের মাংসের কালাভুনা হয়। একটি রাজ হাঁস ও অন্যটি পাতি হাঁস। তবে দাম একই। রাজ হাঁস কিংবা পাতি হাঁস প্রতি বাটিতে বড় বড় পাঁচ পিস করে মাংস দেওয়া হয়। এক বাটির দাম ধরা হয় ১৪০ টাকা। পরের বার বাড়তি হিসেবে ঝোলের সাথে আরও এক পিস মাংস দেওয়া হয়। আর ভাত ৩০ টাকায় যতো খুশি ততো খাওয়া যায়। সাথে লেবু, কাঁচামরিচ, সালাদ, মসুর ডাল ও আলুর ভর্তাও ফ্রি।
তালুকদার বাড়ি হোটেলের লিটন আলী ও বিয়াইন বাড়ি হোটেলের সাজুরদ্দিন সাজু জানান, মড়মড়িয়া গ্রামের তিনটি হোটেলের এই খাবারকে ঘিরে স্থানীয় শতাধিক বেকার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া তাদের এই ব্যবসা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই এমন খাবারের হোটেল প্রতিষ্ঠায় ঝুঁকছেন। আর এর খ্যাতি দেশ-বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। আগে রাজশাহীতে এলে মানুষজন কেবল কালাই রুটি ও গরুর কালাভুনা খেতে চাইতেন। কিন্তু এখন রুচিতে ভিন্ন স্বাদ ও বৈচিত্র্য আনতে তারাও হাঁসের মাংসের কালাভুনার খোঁজে মড়মড়িয়ায় ছুটে আসছেন। খাবারের স্বাদের পাশাপাশি এখনকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের বিমোহিত করছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।