কখনো কি এমন হয়েছে—হঠাৎই বুকের ভেতরটা যেন উৎসুক পাখির মতো ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছে? নিঃশ্বাস আটকে আসছে, গলায় শুকনো ভাব, হাতের তালু ঘামছে… মনে হচ্ছে এই বুঝি হৃদযন্ত্রটা বেরিয়ে আসবে বুক ফুঁড়ে। বুক ধড়ফড়—এই সাধারণ কিন্তু ভীতিকর অনুভূতির মুখোমুখি আমরা কম-বেশি সবাই হয়েছি। হয়তো পরীক্ষার হলে বসে, হয়তো প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দেবার আগে, কিংবা অফিসে বসে গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশনের মুহূর্তে। কিন্তু যখন এই ধড়ফড়ানি আসে অকারণে, নির্জনে বসে, ঘুম ভাঙার পর—তখনই মনে প্রশ্ন জাগে, “এটা কি শুধুই নার্ভাসনেস, নাকি হৃদযন্ত্রের কোনো গোপন অসুখের ইঙ্গিত?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, এই তীব্র, কখনো কখনো আতঙ্কিত করে তোলা অনুভূতির পিছনের কারণ ও সমাধান নিয়েই আজকের এই গভীর আলোচনা।
বুক ধড়ফড় করার কারণ: শারীরিক থেকে মানসিক, একাধিক মুখ
বুক ধড়ফড় শব্দটি শুনলেই আমাদের মাথায় প্রথমেই আসে হৃদরোগের ভয়। অবশ্যই, হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা এর পেছনে দায়ী হতে পারে, কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ নয়। আসলে, আমাদের শরীর-মনের জটিল নেটওয়ার্কে নানা রকম প্রভাবক এই অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্ম দিতে পারে। চলুন, বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক:
- হৃদযন্ত্রের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত কারণ (কার্ডিয়াক কজ):
- অ্যারিদমিয়া (অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন): এটিই বুক ধড়ফড়ানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কখনো কখনো বিপজ্জনক কারণ। হৃদস্পন্দন অনিয়মিত, খুব দ্রুত (টাকিকার্ডিয়া), খুব ধীর (ব্রাডিকার্ডিয়া), বা অনিয়মিত (যেমন অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন) হলে এই অনুভূতি হয়। ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের ডাটা অনুযায়ী, হৃদস্পন্দনজনিত সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের প্রায় ৩০-৪০% প্রথম অভিযোগই ছিল ‘বুক ধড়ফড়’ করা।
- করোনারি ধমনীর রোগ: হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীগুলো সরু বা ব্লক হয়ে গেলে হৃদপেশীতে রক্ত ও অক্সিজেনের ঘাটতি হয় (ইস্কেমিয়া)। এতে শুধু ব্যথাই নয়, বুক ধড়ফড়ানিও হতে পারে, বিশেষ করে শারীরিক পরিশ্রমের সময়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. ফারহানা হকের মতে, “মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিদের, বিশেষ করে যারা ধূমপান করেন বা ডায়াবেটিস-হাইপারটেনশনে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে বুক ধড়ফড়ানিকে হৃদরোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবেই গুরুত্ব দিতে হবে।”
- হৃৎপিণ্ডের ভাল্বের সমস্যা: মাইট্রাল ভাল্ব প্রোলাপস বা অন্যান্য ভাল্বুলার হার্ট ডিজিজের কারণেও বুক ধড়ফড় হতে পারে, বিশেষ করে শোয়া অবস্থায় বা বাম কাতে শুলে।
- জন্মগত হৃদরোগ: কিছু জন্মগত ত্রুটিও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ধড়ফড়ানির কারণ হতে পারে।
- হৃৎপিণ্ডের পেশীর রোগ (কার্ডিওমায়োপ্যাথি): হৃৎপিণ্ডের পেশী দুর্বল বা মোটা হয়ে গেলেও অনিয়মিত স্পন্দন ও ধড়ফড়ানি দেখা দিতে পারে।
- হৃদযন্ত্রের সাথে অপ্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত শারীরিক কারণ (নন-কার্ডিয়াক কজ):
- রক্তশূন্যতা (অ্যানিমিয়া): রক্তে লোহিত রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিন কমে গেলে হৃৎপিণ্ডকে বেশি জোরে ও দ্রুত স্পন্দিত হতে হয় শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের জন্য। এই অতিরিক্ত কাজের ফলেই ধড়ফড়ানি অনুভূত হয়। বাংলাদেশে, বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের মধ্যে আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতা খুবই সাধারণ।
- থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা: হাইপারথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের আধিক্য) হলে শরীরের মেটাবলিজম দ্রুত হয়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং বুক ধড়ফড় করে। হাইপোথাইরয়েডিজমেও (হরমোনের ঘাটতি) কখনো কখনো অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, থাইরয়েডজনিত বুক ধড়ফড়ানির হার নগরী এলাকায় ক্রমশ বাড়ছে।
- রক্তে শর্করার মাত্রার ওঠানামা: ডায়াবেটিস থাকলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে শর্করা অতিরিক্ত কমে যাওয়া) বা কখনো কখনো হাইপারগ্লাইসেমিয়ার (অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া) সময়ও বুক ধড়ফড়, ঘাম, কাঁপুনি হতে পারে।
- নিম্ন রক্তচাপ (হাইপোটেনশন): রক্তচাপ হঠাৎ কমে গেলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ঠিক রাখতে হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হয়, ফলে ধড়ফড়ানি হতে পারে।
- জ্বর: শরীরের তাপমাত্রা বাড়লে হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়।
- ডিহাইড্রেশন বা ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা: শরীরে পানির অভাব বা পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজের ঘাটতি হলে হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক ক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে।
- গর্ভাবস্থা: গর্ভাবস্থায় রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং হরমোনের পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে হৃদস্পন্দন কিছুটা দ্রুত হতে পারে এবং ধড়ফড়ানি অনুভূত হতে পারে।
- মেনোপজ: মেনোপজের সময় হরমোনের ওঠানামার কারণে অনেক মহিলাই হট ফ্লাশ, ঘাম এবং বুক ধড়ফড়ানির অভিজ্ঞতা পান।
- মানসিক ও আবেগজনিত কারণ:
- উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা (অ্যাংজাইটি): মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বা প্যানিক অ্যাটাকের সময় শরীর ‘ফাইট অর ফ্লাইট‘ মোডে চলে যায়। এড্রেনালিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যার ফলে হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে এবং বুক ধড়ফড় শুরু হয়। ঢাকার সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. মেখলা সরকার উল্লেখ করেন, “আমাদের ক্লিনিকে যারা বুক ধড়ফড়ানি নিয়ে আসেন, তাদের প্রায় ৫০% ক্ষেত্রেই মূল কারণটি হয় উদ্বেগ বা প্যানিক ডিসঅর্ডার। এটা মনে রাখা জরুরি যে মানসিক চাপ শারীরিক উপসর্গ তৈরি করতে পারে।”
- প্যানিক ডিসঅর্ডার: এতে হঠাৎ করেই তীব্র ভয় ও শারীরিক উপসর্গ (বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, মৃত্যুভয়) দেখা দেয়।
- ডিপ্রেশন (বিষণ্নতা): দীর্ঘমেয়াদী বিষণ্নতার শারীরিক প্রকাশগুলোর মধ্যে বুক ধড়ফড়ানিও একটি।
- জীবনযাত্রা ও বাহ্যিক প্রভাবক:
- ক্যাফেইন: অতিরিক্ত চা, কফি, কোলা বা এনার্জি ড্রিংকস খেলে ক্যাফেইনের প্রভাবে হৃদস্পন্দন বেড়ে ধড়ফড়ানি হতে পারে।
- নিকোটিন: সিগারেট বা তামাকজাত দ্রব্যে থাকা নিকোটিন হৃদস্পন্দন বাড়ায় এবং রক্তনালীকে সংকুচিত করে।
- অ্যালকোহল: অতিরিক্ত মদ্যপান বা হ্যাংওভারের সময়ও হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হতে পারে।
- অবৈধ মাদকদ্রব্য: কোকেইন, অ্যামফিটামিন, এমনকি গাঁজার মতো মাদক হৃদস্পন্দন দ্রুত ও অনিয়মিত করে তোলে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে।
- কিছু ওভার-দ্য-কাউন্টার ও প্রেসক্রিপশন ওষুধ: কোল্ড অ্যান্ড কফ সিরাপে থাকা সিউডোইফেড্রিন, কিছু অ্যাজমার ইনহেলার, থাইরয়েড ওষুধ, উচ্চ রক্তচাপের কিছু ওষুধ (যেমন ব্লকার বন্ধ করে দেওয়ার সময়), এমনকি কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বুক ধড়ফড় হতে পারে। কোনো ওষুধ শুরু করার পর এমন হলে অবশ্যই ডাক্তারকে জানান।
- অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম: ব্যায়াম করলে স্বাভাবিকভাবেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, যা ব্যায়াম বন্ধ করার পরও কিছুক্ষণ থাকতে পারে।
- অতিরিক্ত খাবার বা নির্দিষ্ট খাবার: খুব ভারী, চর্বিযুক্ত বা মশলাদার খাবার খেলে, অথবা যাদের খাবারে অ্যালার্জি আছে (যেমন গ্লুটেন, MSG) তাদের ক্ষেত্রে খাওয়ার পরপরই ধড়ফড়ানি শুরু হতে পারে।
কখন ডাক্তার দেখাবেন? বিপদের লক্ষণগুলো চিনে নিন
বুক ধড়ফড় অনুভূতি প্রায়ই অস্থায়ী ও নিরীহ। কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই লক্ষণগুলো আপনার হৃদযন্ত্র বা শরীরের অন্য কোনো গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে:
- বুকে ব্যথা বা চাপ/টান অনুভব করা: বিশেষ করে যদি ব্যথা বাম হাত, চোয়াল, ঘাড় বা পিঠে ছড়িয়ে পড়ে (হৃদরোগের ক্লাসিক লক্ষণ)।
- তীব্র শ্বাসকষ্ট: স্বাভাবিক অবস্থায় বা সামান্য পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া।
- অজ্ঞান হওয়া বা মাথা ঘোরা (সিনকোপ বা প্রিসিনকোপ): ধড়ফড়ানির সাথে মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে পড়া খুবই বিপজ্জনক লক্ষণ।
- অতিরিক্ত দুর্বলতা বা ক্লান্তি: অস্বাভাবিক দুর্বল ভাব।
- ধড়ফড়ানির সাথে প্রচণ্ড ঘাম হওয়া বা ঠান্ডা ঘাম দেওয়া।
- হৃদস্পন্দন এক মিনিটে ১২০-এর বেশি হওয়া (বিশ্রামে) বা খুবই অনিয়মিত (যেমন কখনো দ্রুত, কখনো থেমে যাওয়ার মতো) হওয়া।
- আপনার যদি আগে থেকে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকে এবং নতুন করে বা পরিবর্তিত ধরনের ধড়ফড়ানি শুরু হয়।
- ধড়ফড়ানি দীর্ঘ সময় ধরে (কয়েক মিনিটের বেশি) চলতে থাকা বা ঘন ঘন ফিরে আসা।
“আমার তো শুধু ধড়ফড় করে, ব্যথা নাই” – এই ভেবে নিশ্চিন্ত হবেন না। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি, ধূমপায়ী, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চ কোলেস্টেরলের রোগী, বা যাদের পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস আছে, তাদের ক্ষেত্রে যেকোনো নতুন বা অস্বাভাবিক ধড়ফড়ানিকে গুরুত্ব দিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের ডা. আরিফুল ইসলাম বলেন, “অনেক রোগীই শুধু ‘বুক ধড়ফড় করছে’ বলেই ইমার্জেন্সিতে আসেন, পরীক্ষা করে দেখা যায় সত্যিকার অর্থেই হৃদরোগের লক্ষণ। তাই সতর্কতা কখনোই ফেলনা নয়।”
বুক ধড়ফড়ের সমস্যা নির্ণয়: কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে পারে?
যখন আপনি ধড়ফড়ানি নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন, তিনি প্রথমে আপনার বিস্তারিত ইতিহাস নেবেন:
- ধড়ফড়ানি কেমন লাগে (দ্রুত, শক্তিশালী, বাদ দেওয়া, অনিয়মিত)?
- কখন শুরু হয় এবং কতক্ষণ থাকে?
- কোনো ট্রিগার আছে কি (খাবার, ব্যায়াম, মানসিক চাপ, নির্দিষ্ট ভঙ্গি)?
- অন্যান্য উপসর্গ (ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, ঘাম)?
- আপনার মেডিকেল ইতিহাস (রোগ, অপারেশন)?
- পারিবারিক ইতিহাস?
- আপনি কোন কোন ওষুধ, ভিটামিন বা সাপ্লিমেন্ট নিচ্ছেন?
- জীবনযাত্রার অভ্যাস (ধূমপান, অ্যালকোহল, ক্যাফেইন, মাদক)?
এরপর শারীরিক পরীক্ষা, বিশেষ করে হৃদযন্ত্র ও ফুসফুস ভালোভাবে শোনা হবে। এরপর, কারণ নির্ণয়ের জন্য নিচের পরীক্ষাগুলোর মধ্যে কোনোটি বা একাধিক পরীক্ষা করার পরামর্শ দিতে পারেন:
- ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি বা ইকেজি): এটি হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপের একটি মুহূর্তের ছবি। ধড়ফড়ানি চলাকালীন ইসিজি করা গেলে সবচেয়ে ভালো, কারণ তখনই সমস্যা ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
- হল্টার মনিটর: এটি একটি পোর্টেবল ইসিজি ডিভাইস যা ২৪ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় (সাধারণত ২৪-৪৮ ঘন্টা) ধরে আপনার হৃদস্পন্দন রেকর্ড করে। এতে দৈনন্দিন কার্যকলাপের সময় ঘটে যাওয়া অনিয়মিততা ধরা পড়ে।
- ইভেন্ট মনিটর: ধড়ফড়ানি কম ঘন ঘন হলে এটি ব্যবহার করা হয়। আপনি যখন উপসর্গ অনুভব করেন, তখন একটি ছোট ডিভাইস চালু করে রেকর্ড করেন।
- ইকোকার্ডিওগ্রাম (ইকো): এটি একটি আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা যা হৃৎপিণ্ডের গঠন, আকার, পাম্প করার ক্ষমতা এবং ভাল্বের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে। হৃদরোগ আছে কিনা বোঝার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- রক্ত পরীক্ষা: রক্তশূন্যতা, থাইরয়েড ফাংশন, ইলেক্ট্রোলাইট (পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম) এর মাত্রা, রক্তে শর্করার মাত্রা এবং হৃদযন্ত্রের ক্ষতি নির্দেশকারী এনজাইম (ট্রপোনিন) আছে কিনা দেখার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়।
- ট্রেডমিল টেস্ট (স্ট্রেস টেস্ট): ব্যায়ামের সময় হৃদযন্ত্রের কর্মক্ষমতা ও হৃদস্পন্দন পর্যবেক্ষণ করা হয়। ব্যায়ামের সময় ধড়ফড়ানি শুরু হলে এটি বিশেষভাবে উপযোগী।
- কার্ডিয়াক ইভেন্ট রেকর্ডার (ইমপ্ল্যান্টেবল লুপ রেকর্ডার): খুবই বিরল কিন্তু গুরুতর অনিয়মিততা সন্দেহ হলে এটি ত্বকের নিচে বসানো হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে (বছরখানেক) হৃদস্পন্দন রেকর্ড করে।
বুক ধড়ফড়ানির সমাধান: চিকিৎসা ও ঘরোয়া ব্যবস্থাপনা
বুক ধড়ফড় করার চিকিৎসা সম্পূর্ণভাবে এর অন্তর্নিহিত কারণের উপর নির্ভরশীল। কারণ শনাক্ত হওয়ার পরেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
- যদি কোনো নির্দিষ্ট রোগ শনাক্ত হয়:
- অ্যারিদমিয়ার জন্য: ওষুধ (অ্যান্টি-অ্যারিদমিক ড্রাগস), কার্ডিয়াক অ্যাবলেশন (অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক পথ ধ্বংস করার পদ্ধতি), পেসমেকার বা ইমপ্ল্যান্টেবল কার্ডিওভার্টার-ডিফিব্রিলেটর (আইসিডি) বসানো হতে পারে।
- করোনারি ধমনীর রোগের জন্য: জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ওষুধ, অ্যানজিওপ্লাস্টি ও স্টেন্টিং বা বাইপাস সার্জারি।
- থাইরয়েডের সমস্যার জন্য: হাইপারথাইরয়েডিজমের জন্য ওষুধ, রেডিওঅ্যাকটিভ আয়োডিন বা সার্জারি; হাইপোথাইরয়েডিজমের জন্য থাইরয়েড হরমোন রিপ্লেসমেন্ট।
- রক্তশূন্যতার জন্য: কারণ অনুযায়ী আয়রন, ভিটামিন বি১২, ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট বা অন্যান্য চিকিৎসা।
- উচ্চ রক্তচাপের জন্য: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন।
- যদি উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা বা প্যানিক ডিসঅর্ডার কারণ হয়:
- কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি: কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (সিবিটি) উদ্বেগ ও প্যানিক অ্যাটাক মোকাবিলায় খুবই কার্যকর। এটি আপনাকে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা চিনতে এবং সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে শেখায়, সাথে রিলাক্সেশন টেকনিকও শেখায়।
- ওষুধ: ডাক্তার প্রয়োজনে অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি মেডিকেশন বা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস (যেমন এসএসআরআই) লিখে দিতে পারেন। মনে রাখবেন, এসব ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া শুরু, বন্ধ বা মাত্রা পরিবর্তন করা উচিত নয়।
- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: নিয়মিত ধ্যান, মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস, যোগব্যায়াম, প্রাণায়াম (শ্বাসের ব্যায়াম) উদ্বেগ কমাতে এবং হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
- জীবনযাত্রায় পরিবর্তন (লাইফস্টাইল মডিফিকেশন): অনেক ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে যদি কারণটি জীবনযাপন সংক্রান্ত হয় বা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে, এই পরিবর্তনগুলো মূল চাবিকাঠি:
- ক্যাফেইন ও নিকোটিন বর্জন: চা, কফি, কোলা, এনার্জি ড্রিংকস এবং সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য (সিগারেট, জর্দা, গুল) এড়িয়ে চলুন। লক্ষ্য করুন, ক্যাফেইন কাটলেও প্রথম কয়েক দিন মাথাব্যথা বা ধড়ফড়ানি বেড়ে যেতে পারে, পরে ঠিক হয়ে যায়।
- অ্যালকোহল সীমিতকরণ বা বর্জন: অ্যালকোহল, বিশেষ করে অতিরিক্ত মাত্রায়, অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের অন্যতম ট্রিগার।
- নিয়ন্ত্রিত ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস: প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল, গোটা শস্য, লিন প্রোটিন (মাছ, মুরগি) খান। প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত লবণ, চিনি এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বি (ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট) কমিয়ে ফেলুন। রক্তশূন্যতা থাকলে আয়রন ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বাড়ান। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের সুপারিশ মেনে চলুন।
- নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম: সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি ধরনের অ্যারোবিক ব্যায়াম (দ্রুত হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার) হৃদযন্ত্রকে শক্তিশালী করে, রক্তচাপ কমায় এবং উদ্বেগ দূর করে। তবে হৃদরোগ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শে ব্যায়ামের ধরন ও মাত্রা ঠিক করুন।
- পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘন্টা গভীর ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের অভাব উদ্বেগ ও হৃদস্পন্দন বাড়াতে পারে।
- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: দৈনন্দিন জীবনে চাপ অনিবার্য। তাই নিয়মিত রিলাক্সেশন টেকনিক অনুশীলন করুন। গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস (ডায়াফ্রাগমেটিক ব্রিদিং), প্রোগ্রেসিভ মাসল রিলাক্সেশন, মেডিটেশন, প্রিয় শখে সময় দেওয়া—এগুলো চাপ কমাতে সাহায্য করে।
- পর্যাপ্ত পানি পান: ডিহাইড্রেশন এড়াতে সারাদিনে পর্যাপ্ত পানি ও তরল পান করুন।
- কিছু ঘরোয়া বা তাৎক্ষণিক উপায় (যদি চিকিৎসা-বিরোধী না হয়):
- ভেগাল ম্যানুভার্স: এই কৌশলগুলি ভেগাস নার্ভকে উদ্দীপিত করে হৃদস্পন্দন কিছুটা কমাতে পারে। যেমন: জোরে কাশি দেওয়া, মুখ বন্ধ করে নাক চেপে শ্বাস বের করার চেষ্টা করা (ভালসালভা ম্যানুভার), ঠান্ডা পানিতে মুখ ডুবিয়ে রাখা (ডাইভ রিফ্লেক্স), বা বরফের টুকরো চুষে নেওয়া। তবে মনে রাখবেন, এগুলো সব ক্ষেত্রে কাজ নাও করতে পারে এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা গুরুতর বুকে ব্যথা থাকলে এগুলো করার চেষ্টা করবেন না।
- শান্ত হওয়ার চেষ্টা: যদি উদ্বেগ থেকে ধড়ফড়ানি শুরু হয়, তাহলে একটি শান্ত জায়গায় বসে গভীর শ্বাস নিন। ৪ সেকেন্ড নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে, ৭ সেকেন্ড ধরে রেখে, ৮ সেকেন্ডে মুখ দিয়ে ছাড়ুন। বারবার করুন। নিজেকে বলুন যে এটি অস্থায়ী এবং আপনি শান্ত হচ্ছেন।
বুক ধড়ফড় করার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অপ্রীতিকর, কিন্তু এটি সর্বদা বিপজ্জনক নয়। আপনার শরীরের বার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। কারণটি যাই হোক না কেন, সঠিক সময়ে সচেতন হওয়া এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াই হলো মূল চাবিকাঠি। উদ্বেগ বা জীবনযাত্রার কারণে হলে, ইতিবাচক পরিবর্তনই পারে আপনাকে এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে। আর যদি কোনো শারীরিক অসুস্থতার ইঙ্গিত হয়, তবে দ্রুত নির্ণয় ও চিকিৎসাই পারে বড় ধরনের জটিলতা এড়াতে। আপনার হৃদযন্ত্র নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছে আপনার জন্য—একটু যত্ন ও মনোযোগ দাবি করে তার এই ‘ধড়ফড়’ সংকেত।
বুক ধড়ফড় নামক এই হৃদয়ের ভাষা বুঝতে পারাটাই প্রথম পদক্ষেপ আপনার সুস্থতার পথে। এই অনুভূতিকে উপেক্ষা নয়, বরং গুরুত্ব দিয়ে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিকের যত্ন নিন। কারণ, একটি সুস্থ হৃদয়ই তো জীবনযাত্রার সেরা সঙ্গী। আজই আপনার জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিন এবং কোনো চিন্তা থাকলে অবিলম্বে যোগাযোগ করুন একজন যোগ্য চিকিৎসকের সাথে।
জেনে রাখুন (FAQs)
- প্রশ্ন: রাতে শুয়ে থাকার সময় হঠাৎ বুক ধড়ফড় করলে কী করব?
- উত্তর: প্রথমে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করুন। বসে পড়ুন বা শোয়ার ভঙ্গি বদলান। গভীর শ্বাস নিন। যদি সাথে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হওয়ার ভাব হয়, বা ধড়ফড়ানি দীর্ঘক্ষণ (কয়েক মিনিটের বেশি) চলতে থাকে, তাহলে অবিলম্বে নিকটস্থ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যান। বারবার রাতে এমন হলে দিনের বেলায় ডাক্তারের পরামর্শ নিন। রাতের ধড়ফড়ানির পেছনে অ্যাসিড রিফ্লাক্স, ঘুমের সমস্যা (স্লিপ অ্যাপনিয়া), বা নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে শোয়ার কারণেও হতে পারে।
- প্রশ্ন: বুক ধড়ফড় করলেই কি হার্ট অ্যাটাক হবে?
- উত্তর: না, বুক ধড়ফড় করলেই হার্ট অ্যাটাক হবে এমন ধারণা ভুল। ধড়ফড়ানির অনেক সাধারণ ও নিরীহ কারণ আছে, যেমন উদ্বেগ, ক্যাফেইন, বা অতিরিক্ত পরিশ্রম। তবে, ধড়ফড়ানির সাথে বুকে চাপ বা ব্যথা (বিশেষ করে বাম হাত/চোয়ালে ছড়ালে), তীব্র শ্বাসকষ্ট, প্রচণ্ড ঘাম, মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হওয়ার ভাব থাকলে তা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা জরুরি। যে কোনো সন্দেহে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।
- প্রশ্ন: মানসিক চাপ বা উদ্বেগ থেকে বুক ধড়ফড় করলে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করব?
- উত্তর: মানসিক চাপজনিত ধড়ফড়ানি নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো রিলাক্সেশন টেকনিক। গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম (৪-৭-৮ পদ্ধতি), প্রগতিশীল পেশী শিথিলকরণ, মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম নিয়মিত অনুশীলন করুন। ক্যাফেইন ও নিকোটিন এড়িয়ে চলুন। পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন। সমস্যা তীব্র বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে মনে হলে একজন সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, আপনার অনুভূতি বৈধ এবং সাহায্য পাওয়ার অধিকার আপনার আছে।
- প্রশ্ন: আমি গর্ভবতী, প্রায়ই বুক ধড়ফড় করে। এটা কি স্বাভাবিক?
- উত্তর: গর্ভাবস্থায় হালকা মাত্রার বুক ধড়ফড় বা হৃদস্পন্দন কিছুটা দ্রুত হওয়া বেশ সাধারণ ঘটনা। গর্ভাবস্থায় রক্তের পরিমাণ প্রায় ৫০% বেড়ে যায়, ফলে হৃৎপিণ্ডকে বেশি কাজ করতে হয়। হরমোনের পরিবর্তনও এর জন্য দায়ী। তবে, যদি ধড়ফড়ানি খুব তীব্র, দীর্ঘস্থায়ী, বা এর সাথে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হওয়ার ভাব থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার গাইনোকোলজিস্ট বা প্রসূতি বিশেষজ্ঞকে জানান। রক্তশূন্যতা বা থাইরয়েডের সমস্যা গর্ভাবস্থায় ধড়ফড়ানি বাড়াতে পারে, সেটাও পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
- প্রশ্ন: ধড়ফড়ানি কমাতে ঘরোয়া উপায় কী কী?
- উত্তর: কারণের উপর নির্ভর করে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি সাহায্য করতে পারে:
- ট্রিগার এড়ানো: ক্যাফেইন (চা, কফি, কোলা), নিকোটিন (সিগারেট), অ্যালকোহল, ভারী বা মশলাদার খাবার কমিয়ে ফেলুন।
- হাইড্রেশন: পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
- রিলাক্সেশন: গভীর শ্বাস নিন, মেডিটেশন করুন, গান শুনুন, হালকা গরম পানিতে গোসল করুন।
- ভেগাল ম্যানুভার্স (সতর্কতার সাথে): জোরে কাশি দিন, ঠান্ডা পানিতে মুখ ডুবান, বা মুখ বন্ধ করে নাক চেপে শ্বাস বের করার চেষ্টা করুন (শুধুমাত্র যদি আপনি সুস্থ বোধ করেন এবং বুকে ব্যথা না থাকে)।
- ইলেক্ট্রোলাইট: ডাক্তারের পরামর্শে, পটাশিয়াম (কলা, নারিকেল পানি) বা ম্যাগনেসিয়াম (বাদাম, কুমড়ার বীজ) সমৃদ্ধ খাবার খেতে পারেন, তবে সাপ্লিমেন্ট ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নয়।
- ব্যায়াম: নিয়মিত হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম (যেমন হাঁটা) দীর্ঘমেয়াদে হৃদযন্ত্রকে শক্তিশালী করে ও চাপ কমায়। মনে রাখুন, ঘরোয়া উপায় শুধুমাত্র হালকা বা ক্ষণস্থায়ী ধড়ফড়ানির জন্য এবং কোনো চিকিৎসার বিকল্প নয়। বারবার বা তীব্র উপসর্গ হলে ডাক্তার দেখান।
- উত্তর: কারণের উপর নির্ভর করে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি সাহায্য করতে পারে:
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।