জুমবাংলা ডেস্ক : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সবধরনের সহযোগিতা করতে চান দেশের ব্যবসায়ী সমাজ। এ লক্ষ্যে দেশের অর্থনীতিতে বিরাজমান বর্তমান সংকট তুলে ধরার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে পরামর্শ দেওয়া হবে বর্তমান সরকারকে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মনে করেন, বর্তমান অর্থনীতি গভীর সংকটে নিমজ্জিত।
বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে নির্বাচন ছাড়াই পছন্দের ব্যক্তিদের বসিয়ে দেওয়ার কারণে বিগত দিনে অর্থনীতির সমস্যাগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন হয়নি। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ, বিদেশী ঋণ বেড়ে যাওয়া এবং ডলার সংকট অর্থনীতির আরেক সমস্যা। একদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে অন্যদিকে আস্থাহীনতায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কমে সঙ্কুচিত হচ্ছে কর্মসংস্থানের বাজার।
এ অবস্থায় আজ বুধবার দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়ে এক ব্যবসায়ী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এই সম্মেলন থেকেই ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বর্তমান সরকারকে সবধরনের সহযোগিতা করার ঘোষণা দেবেন।
জানা গেছে, ব্যবসায়ী সম্মেলনের মাধ্যমে অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারকে বেশকিছু পরামর্শ দিয়ে তা বাস্তবায়নে অনুরোধ করা হবে। এরমধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল-বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
বিগত দিনে যারা বঞ্চিত হয়েছেন কিংবা মালিকানা হারিয়েছেন তারা আবার প্রতিষ্ঠান নিজেদের দখলে নিতে সদর্পে ফিরে আসছেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেওয়ায় বেশিরভাগ ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া হয়নি। ফলে বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছিল।
ইতোমধ্যে অনেক ব্যাংক পথে বসার উপক্রম হয়েছে। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে সেই অর্থ অনেকে বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে বছরের পর বছর কোনো নির্বাচন হয়নি। সিলেকশনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করে দেওয়ায় ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলো বিগত দিনে সঠিকভাবে সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়নি। এতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে সংকট আরও বেড়েছে।
ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মনে করেন, অর্থনীতিতে বিরাজমান এ সংকটগুলো দূর করতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে জাপান-বাংলাদেশ চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের উপদেষ্টা আব্দুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করবে ব্যবসায়ী সমাজ।
এজন্য একটি ব্যবসায়ী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। বিগত দিনের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংকসহ আর্থিক খাত গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস! ডলার ও রিজার্ভ সংকটের কারণে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। আস্থাহীনতার কারণে দেশী বিনিয়োগ নেই বললেই চলে।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অর্থনীতির সমস্যাগুলো বিশদভাবে তুলে ধরা হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কি করণীয় সেই বিষয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে পরামর্শ দিয়ে তা বাস্তবায়নে অনুরোধ করা হবে। আশা করছি, সম্মেলনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু হবে। প্রকৃত উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ভালো বার্তা পাবেন।
জানা গেছে, ব্যবসায়ী সম্মেলনে দেশের সকল খাত ও চেম্বারসমূহের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। রাজধানীর প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে বেলা ৩টায় অনুষ্ঠিতব্য এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান।
সম্মেলনে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএ’র সাবেক সকল সভাপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা অংশগ্রহণ করতে পারেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। ব্যবসায়ীরা দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি সরকারের কাছে তুলে ধরবেন।
উল্লেখ্য, বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি অব্যাহত ডলার সংকট, আস্থাহীনতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গত তিন বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতাংশ হিসাবে কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ও জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। দেশে প্রবৃদ্ধির ধীরগতির মধ্যে সম্প্রতি মাসব্যাপী ছাত্র আন্দোলন অর্থনীতির জন্য আরেক বড় ধাক্কা।
এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। অস্থিরতা ঠেকাতে সারাদেশে কার্ফু দেওয়ায় গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ছে। পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের (পিইবি) চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা নিশ্চিতভাবেই বেসরকারি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে ভালো নীতি ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা গেলে বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে, জুলাইয়ের শেষদিকে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে দেখা করে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরে। সংগঠনটির মতে, সম্প্রতি সারাদেশে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় তা অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। ফিকির সভাপতি জাভেদ আখতার জানিয়েছেন, ‘অনেক বিনিয়োগকারী বর্তমানে নিয়মিত কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন। বন্দর থেকে পণ্য খালাস ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনায় সমস্যা ও অদক্ষতার কারণে ব্যবসার খরচ বাড়ছে। জানা গেছে, খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত দেশের ব্যাংকিং খাত। পাশাপাশি তারল্য সংকট, সুশাসনের অভাবসহ একাধিক সমস্যায় ভুগছে অনেকগুলো ব্যাংক। ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, বেশ কয়েকটি ব্যাংকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদত্যাগ করেছেন। তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। ব্যাংকাররা বলছেন, উচ্চ খেলাপি ঋণের অন্যতম প্রধান কারণ ব্যাংক বোর্ডের কার্যক্রমে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ।
এ ছাড়া সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০২৩ এই ১৫ বছরে ২৪টি বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে প্রায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে হবে এবং সময়মতো তথ্যের সততা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সূত্র : জনকণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।