“আমার ছেলেরে গুলি দিছে। গুলি দেওয়ার পর তারে পাছড়াইয়া পাড়ায়া পাড়ায়া মারছে। গলায় পাড়া দি তারে মাইরে ফালাইছে। মাইরে আবার তারে সরায় রাখছে।”
গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীর তীরে ছোট্ট একটি বাজার ভেড়ারবাজার। সেখানে ইমন তালুকদার সম্পর্কে জানতে চাইলে কয়েকজন পথ দেখিয়ে তার বাড়ির দিকে নিয়ে যান। বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই তারা ডাকেন, “ইমনের মা, দেখো আরও সাংবাদিক এসেছে।”
এখন সাংবাদিকদের উপস্থিতি গ্রামবাসীর কাছে আর নতুন কিছু নয়। একজন বলেন, “এত সাংবাদিক এই গ্রামে আগে আসেনি।”
কারণ, ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে সংঘর্ষে নিহত ১৭ বছরের কিশোর ইমন তালুকদারের বাড়ি এখানেই।
ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই রোখসানা বেগমকে ঘিরে ধরেন আশপাশের নারীরা। তারা বলেন, “যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে বুট দিয়ে মাথা চেপে ধরা হয়েছে—সে ইমনই।
ইমনের বাড়ি বলতে একটি মাত্র টিন-কাঠের জরাজীর্ণ ঘর। ১২ বাই ১০ ফুটের ঘরে দুটি চৌকি পাতা—সেখানেই সবার ঘুমানোর ব্যবস্থা।
সেই ঘরের কাত হয়ে থাকা দরজা দিয়ে উঠানে নেমে পেয়ারা গাছের পাশে এসে দাঁড়ান ইমনের মা রোখসানা বেগম। তাকে তখন বেশ দুর্বল লাগছিল।
এক প্রতিবেশী মোবাইলে সেই ছবি দেখান, যেখানে বুটে মাথা চেপে ধরা—দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রোখসানা।
তিনি বলেন, “ছেলেকে গুলি করা হয়েছে। তারপর টেনে মাটিতে ফেলে পেটানো হয়েছে। গলা চেপে হত্যা করে লাশ লুকিয়ে রেখেছে। আমি খুঁজে পাইনি, ক্যাম্পে গেছি, থানায় গেছি।”
“পরে সন্ধ্যায় অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ হাসপাতালের পাশে এনে রাখা হয়। আমি গিয়ে দেখি, ট্রলিতে রাখা হয়েছে। আমার ছেলেকে এভাবে হত্যা করল কেন?”
ভিডিওটি কবে দেখেন জানতে চাইলে রোখসানা বলেন, “সেই ভিডিওতেই ছেলেকে চিনেছি। তখন থেকেই খুঁজতে বের হই। ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, শরীরেও গুলি ছিল।”
তার ভাষ্য অনুযায়ী, এক তরুণী বিকেলে ভিডিওটি দেখালে তিনি ইমনের পোশাক দেখে চিনে ফেলেন এবং শহরের দিকে ছুটে যান।
“একজন মেয়ে এসে বলল, এটা কি ইমন? তখন ভিডিও দেখে আমি ছুটে যাই ছেলেকে খুঁজতে।”
ইমনের ফুফু বানু আক্তার জানান, তার ভাইয়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে একমাত্র রোজগার করত ইমন। বড় ছেলে অতিরিক্ত সহজ-সরল, আর বাবা মানসিকভাবে সুস্থ নন বলেই স্থানীয়দের ধারণা।
ইমন গোপালগঞ্জ শহরের একটি ক্রোকারিজ দোকানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে মাসে ১৩ হাজার টাকা আয় করত। সেই টাকাতেই চলত সংসার।
বানু বলেন, “ভাইয়ের মাথায় সমস্যা আছে। ছেলে মারা যাওয়ার খবর পেয়ে সে ভ্যান ফেলে কোথায় যেন চলে গেছে। লাশও দেখেনি, দাফনেও ছিল না।”
এ সময় রোখসানা বিলাপ করতে করতে বলেন, “ছেলের আয়েই সংসার চলত। ওষুধ লাগলে ও-ই এনে দিত। এখন আমরা কার কাছে যাব?”
তার কান্নায় আশপাশের অনেকে কেঁদে ফেলেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ফুফু বানু বলেন, “সবাই দেখেছে ইমনকে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছে। গুলি করে দিলেও আমাদের হাতে দিত। চিকিৎসা করাতাম। ও তো কোনো রাজনীতি করত না।”
“রাজনীতি করে না এমন একজনকে এভাবে মেরে ফেলবে কেন? নিজেদের জায়গা নেই, অন্যের জমিতে ঘর তুলে থাকি। দেখেন, ঘরটাও পড়ে যাচ্ছে। আমরা টাকা চাই না, ভাইয়ের ছেলেটার জীবন চাই। সে তো পাঁচজনকে খুন করেনি।”
ইমন সংঘর্ষে অংশ নিয়েছিল কি না জানতে চাইলে বানু বলেন, “আমরা তো তাকে দোকানে পাঠিয়েছিলাম। কোথায় গেছে জানি না।”
আরও বলেন, “কেউ এসে সাহায্য করেনি। শুধু কিছু ফোনে বলেছে পাশে থাকবে। কিভাবে থাকবে জানি না। ইমন এক বোনের বিয়ের খরচ দিয়েছে, ছোট বোনের পড়াশোনাও চালাতো।”
পরে হাসপাতাল থেকে লাশ নিতে বলা হলে তা এনে দাফন করা হয় বলে জানান রোখসানা। তার ছেলের উরুতে গুলির চিহ্ন ও মুখে আঘাত ছিল।
ঘটনার দিন এনসিপির কর্মসূচিকে ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে।
এতে চারজন নিহত, অন্তত নয়জন গুলিবিদ্ধ ও অর্ধশতাধিক আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেলে আরও একজন মারা যান।
ইমন ছাড়া নিহত অন্যরা: দীপ্ত সাহা (২৭), রমজান কাজী (১৭), সোহেল রানা (৩০) ও রমজান মুন্সী (৩২)।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২১ ও ২২ জুলাই গোপালগঞ্জে গিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন দেয়। তারা ইমনের বাড়িতেও যান।
সংবাদমাধ্যমে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, “ইমনের পরিবার জানায়, দেড়টার দিকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তারা হাসপাতালে যান। বিকেল ৫টার দিকে হাসপাতাল মরদেহ দ্রুত নিতে চাপ দিলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়।”
“তারা বলেন, ইমনের শরীরে গুলির ও নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। ভাইরাল ভিডিওতে সেনাবাহিনীর একজন সদস্য একজন কিশোরের মাথায় বুট চাপা দিচ্ছেন—সে ইমন বলে তারা নিশ্চিত। সে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না, দোকানে কাজ করত।”
আসকের বিবৃতিতে বলা হয়, “তারা সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সাক্ষাৎ হয়নি। ২২ জুলাই ক্যাপ্টেন সাকিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, তিনি ভিআইপি ডিউটিতে আছেন এবং পরে যোগাযোগের জন্য নম্বর দেন, তবে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।”
আইএসপিআর-এর পরিচালককে বার্তা পাঠানো হলে তিনি বলেন, “সংবাদ বিজ্ঞপ্তির জন্য আইএসপিআর ওয়েবসাইট দেখুন।”
তবে শনিবার রাত পর্যন্ত ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।
রমজানের মা কথা বলছেন না
১৭ বছরের রমজান কাজীও সেদিন গুলিতে নিহত হন। তার পরিবারকে পাওয়া যায় কলিম মুন্সীর বাড়িতে।
ভ্যানচালক কলিম মুন্সীর বাসায় থাকেন রমজানের মা মর্জিনা বেগম। বাইরে এলেও কথা বলেননি। কলিম বলেন, ছেলের মৃত্যুর পর থেকে বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়েন, এখন কথা বলেন না।
ভিডিওতে যে নিথর দেহটি ভ্যানে তোলা হচ্ছে, সেটি রমজান কাজীর বলে জানান কলিম।
তিনি বলেন, “আমার ভাই তাকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় পায়। তিনটার দিকে হাসপাতালে নিয়ে যাই, কোনো চিকিৎসা হয়নি। পরে থানায় নিই।”
“তখন থানার গেট বন্ধ ছিল। পরে আবার হাসপাতালে যাই। তখনই ভিডিওটি তোলা হয়েছে।”
কলিম জানান, হাসপাতাল লাশ নিতে বললে আশপাশের লোকজন বলেন, লাশ গায়েব হয়ে যেতে পারে। তাই লাশ নিয়ে রাতে দাফন করা হয়।
রমজান প্রতিদিন ৫০০ টাকা মজুরিতে টাইলস মিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করত। সংঘর্ষে সে কিভাবে জড়াল, তা জানে না পরিবার। সহকর্মীকেও পাওয়া যাচ্ছে না।
‘হাসপাতালে গিয়ে কথা বলেছিল’ দীপ্ত সাহা
১৬ জুলাই সংঘর্ষে নিহত দীপ্ত সাহাকে পুলিশ মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে মামলা উল্লেখ থাকলেও, আসককে তার স্বজনেরা জানান, হাসপাতালে নেয়ার পরও তিনি জীবিত ছিলেন ও কথা বলেছিলেন।
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, “হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জানান, চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। তবে দীপ্ত সাহার স্বজনদের দাবি, তিনি তখনো জীবিত ছিলেন, অপারেশন থিয়েটারেও নেওয়া হয়েছিল। পরে মৃত্যু হয়। তাই তাকে ব্রড ডেড বলা সঠিক নয়।”
ইমন, দীপ্ত, সোহেল ও রমজান কাজীর মরদেহ সেদিন ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন বা সৎকার করা হয়। তিনজনের কবর থেকে লাশ তুলে ময়নাতদন্তের পর পুনরায় দাফন করা হয়। তবে দীপ্ত সাহার দাহ হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা মেডিকেলে মারা যাওয়া রিকশাচালক রমজান কাজীর ময়নাতদন্ত সেখানেই হয়। পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, তারা সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
এ বছরের সেরা ক্যামেরা ফোন, কোনটি আপনার জন্য পারফেক্ট দেখে নিন
ইমন ছাড়া বাকি চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় গোপালগঞ্জ থানা চারটি মামলা করেছে। মামলাগুলোতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সমর্থিত হামলাকারীদের আসামি করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।