সাহাদাত হোসেন পরশ : ফিরোজ হোসেন (২৯), বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপার ধাওড়ায়। ঢাকা কলেজ থেকে ২০১৯ সালে স্নাতকোত্তর শেষে আরএকে সিরামিকসে বছরখানেক চাকরি করেন। চাকরির পাট চুকিয়ে গ্রামে ফিরে হন কৃষি উদ্যোক্তা। কিন্তু পুলিশের গুলিতে তিনি একটি হাত হারিয়েছেন।
ভাগ্যাহত ফিরোজ বললেন, ‘আমার হাত কি পুলিশ ফেরত দিতে পারবে? কী কারণে আমার হাত লক্ষ্য করে গুলি করল? একজন উদ্যোক্তার হাত কেড়ে নিল। আমি এর বিচার চাই।’ সেদিন কী ঘটেছিল বর্ণনা করে তিনি বলেন, ৯ জুন চাচাতো ভাই মুস্তাফিজুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। কেন তাকে নিয়ে গেল– জানতে স্বজনের সঙ্গে শৈলকুপা থানায় যাই। থানার সামনে দায়িত্বরত কয়েক পুলিশ সদস্যের কাছে কী অভিযোগে ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জানতে চাই। এ সময় পুলিশের এক সদস্য বলেন, ‘এত বড় সাহস, গ্রেপ্তারের কারণ জানতে তোরা এতদূর এসেছিস। তোদের মনে হয় বেশি তেল-চর্বি জমে গেছে।’ আরেকজন অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে মারধর শুরু করেন। মাটিতে পড়ে যাই। দেখলাম, এক পুলিশ গুলি করছে। হঠাৎ একটি বড় শব্দ হলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেখলাম, আমার ডান থেকে রক্ত ঝরছে।
ফিরোজ বলেন, হাতটি ঝুলে আছে। তাৎক্ষণিক বললাম, এ কী করলেন? আমার কী অপরাধ? তারা ৪-৫ ফুট দূর থেকে গুলি করে। এর পর সেখানে উপস্থিত স্বজন দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিল। সেখান থেকে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতাল। অবস্থা খারাপ হওয়ায় আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এর পর জাতীয় অর্থপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু) চিকিৎসা করলেও হাতটি রক্ষা হয়নি।
কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, শৈলকুপা থানার সামনে দিয়ে বহুবার যাতায়াত করলেও কখনও ভেতরে যাইনি। কোনো অন্যায় কাজে জড়াইনি। চাচাতো ভাইয়ের ঘটনায় প্রথম থানায় গেলাম। সেদিনই আমার জীবন তছনছ করে দিল পুলিশ। যেখানে আমাকে গুলি করা হয়েছে, সেখানে সিসি ক্যামেরা থাকলে তা পরীক্ষার দাবি জানাচ্ছি। আমার কোনো অন্যায় পেলে মাথা পেতে নেব। আমি তো পুলিশের ওপর হামলা করিনি। পরে শুনেছি, আমাকে গুলি করার ঘটনা জানাজানি হলে অনেকে থানায় চড়াও হয়। সেটির দায় তো আমার নয়। সারাদেশের পুলিশের কথা বলব না। শৈলকুপার পুলিশ মাফিয়া, এটি এলাকার লোকজন বিশ্বাস করে। এখন এর শিকার হলাম আমি।
পঙ্গু হাসপাতালে ১০ জুন অস্ত্রোপচার করে ফিরোজের ডান হাত গিরার ওপর থেকে কেটে ফেলেন চিকিৎসকরা। ২৬ জুন ছাড়পত্র পেলে তিনি উত্তরায় বড় ভাইয়ের বাসায় ওঠেন। ৯ জুন থানায় হামলার অভিযোগে পুলিশের মামলায় অনেকের সঙ্গে তাঁকেও আসামি করায় গ্রামে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন ফিরোজ।
এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই ঘটনায় পুলিশের এসআই লাল্টু রহমান ১১৫ জনের নামসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৪৫ থেকে ৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মামলার ৩২ নম্বর আসামি ফিরোজ শিকদার, বাবা কাশেম শিকদার। তবে হাত হারানো ফিরোজের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বলছে, পুরো নাম ফিরোজ হোসেন; বাবা আবুল কাশেম শিকদার। ভুল নাম-পরিচয়ে ফিরোজকে আসামি করা হলেও পুলিশের এজাহারেই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো তথ্য নেই।
ফিরোজের ছোট ভাই কাইমুন বলেন, আমরা সরকারের কাছে এর বিচার চাই। কেন আমার ভাইকে পঙ্গু করা হলো?
এদিকে যাকে কেন্দ্র করে শৈলকুপায় এত ঘটনা, সেই মুস্তাফিজুর রহমান পুলিশ মহাপরিদর্শকের কমপ্লেন সেলে একটি অভিযোগ দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, শৈলকুপা থানার এসআই মনির আমার চাচাতো ভাইয়ের হাত লক্ষ্য করে গুলি করেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে পৃথক অভিযোগে মুস্তাফিজুর বলেছেন, ‘২২ মে শৈলকুপার বন্দেখালিতে মারামারির একটি ঘটনায় আমাকে অহেতুক ফাঁসানো হয়। ওই মামলায় গ্রেপ্তারের পর শৈলকুপার ওসি আমার ওপর অমানবিক নির্যাতন করেন। এসপি তাঁর পায়ের জুতা চাটান।’ তিনি বলেন, ‘ওসির কক্ষে বসেই এসপি আমাকে দিয়ে তাঁর জুতা চাটান; নির্যাতন করেন।’
জানতে চাইলে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার আজিম উল আহসান বলেন, ‘ঘটনার দিন উত্তেজিত জনতা থানা আক্রমণ করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশ অনেক ধৈর্য নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। নন-লিথ্যাল উইপন ব্যবহার করেছে। থানায় হামলার অনেক ভিডিও ক্লিপ আছে।’
হাত হারানো যুবক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলছেন, পুলিশের ওপর তিনি কোনো হামলা করেননি। তাঁকে গুলি করার পর থানা ঘিরে অপ্রীতিকর কিছু পরিস্থিতি হয়েছে– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কেউ অভিযোগ করতে পারে। তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে।’
জুতা চাটানোর ব্যাপারে পুলিশ সুপার বলেন, ‘এটি সত্য নয়। এ ধরনের কাজ আমি কেন করব? অভিযোগ করলে তদন্ত হোক। সত্য বেরিয়ে আসবে।’ সূত্র : সমকাল
Get the latest News first— Follow us on Zoombangla Google News, Zoombangla X(Twitter) , Zoombangla Facebook, Zoombangla Telegram and subscribe to our Zoombangla Youtube Channel.