জুমবাংলা ডেস্ক : নদীর বুকে চর, সেই চরই এখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। গড়ে উঠেছে ডিসি ইকোপার্ক। পার্কের মধ্যেই চোখজুড়ানো লেক। তৈরি করা হয়েছে বিশ্রামাগার। শিশুদের চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। উপকূলী জেলা ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার বিষখালী নদীর তীরে জেগে ওঠা এ চরটি ‘ছৈলারচর’ নামে পরিচিত। পর্যটকদের কাছে এটি ‘এক টুকরো সুন্দরবন’।
নয়নাভিরাম এই চরকে ঘিরে দেখা দিয়েছে পর্যাটনের বিপুল সম্ভাবনা। পর্যটকরাও আসছেন নিয়মিত। ছৈলারচরকে পর্যটন করপোরেশেনের আওতায় নিয়ে স্থানটির উন্নয়ন করার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র এক শ’ কিলোমিটার দূরে ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার হেতালবুনিয়া গ্রামে বিষখালী নদীতে এক যুগ আগে ৪১ একর জমি নিয়ে জেগে ওঠে বিশাল চর। যা এখন ৬১ একরে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ছৈলা গাছ থেকে চরটি পরিচিতি পেয়েছে ‘ছৈলার চর’ নামে। ছৈলা ছাড়াও এখানে কেয়া, হোগল, রানা, এলি, মাদার, আরগুজিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে।
ছৈলা একটি লবন সহিষ্ণু বন্য প্রজাতির বৃক্ষ। উপকূলীয় নদী তীরবর্তী চরে প্রকৃতিগতভাবে জন্মে গাছটি। ছৈলা গাছের শেকড় মাটির অনেক গভীর অবধি যায়, তাই সহসা ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে কিংবা উপড়ে পড়ে না। ফলে উপকূলীয় এলাকায় প্রকৃতিবান্ধব গাছ হিসেবে ছৈলা বনবিভাগের সংরক্ষিত বৃক্ষ। এই গাছের টক জাতীয় ফল কাঁচা, পাকা ও রান্না করে খাওয়া যায়।
ছৈলা গাছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিশেষ করে শালিক, ডাহুক আর বকের বসবাস। এখানে কোনো হিংস্র প্রাণী না থাকায় এবং সহজ ও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সারা বছর ধরেই ভ্রমণ পিপাসুদের ভিড় থাকে। পর্যটকদের কাছে চরটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে রোপণ করা হচ্ছে নানা প্রজাতির গাছ। একইসাথে তৈরি করা হয়েছে বিশ্রামাগার, শিশুদের চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে।
২০১৫ সালে ছৈলার চর স্থানটি পর্যটন স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চরের একদিকে ২০ একর জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ডিসি ইকোপার্ক। এ পার্কের মধ্যে রয়েছে একটি নয়নাভিরাম লেক। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ভ্রমণ পিপাসুদের নদীর দৃশ্য উপভোগ করার জন্য করেছে বিভিন্ন ব্যাবস্থা। ইতোমধ্যে ছৈলার চরে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত দু’টি রেস্ট হাউজ।
প্রত্যেক শীত মৌসুম শুরু হলেই বিভিন্ন এলাকা থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী পিকনিক করতে আসেন ছৈলার চরে। এছাড়া, পরিবার-পরিজন নিয়েও প্রতিবছর চরটিতে পিকনিক করতে আসেন অসংখ্য মানুষ। এ চরকে কেন্দ্র করে কয়েক শ’ বেকার মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে। তবে, এই চরকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন পর্যটন করপোরেশনের সহযোগিতা।
কিভাবে যাবেন
ঝালকাঠি জেলা শহর থেকে কাঁঠালিয়া উপজেলায় যেতে পাড়ি দিতে হবে ৩৫ কিলোমিটার পথ। সেখান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পরেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ছৈলার চর। যেকোনো যানবাহনে ছৈলার চর যাওয়া যাবে। সড়ক ও নৌ পথে প্রতিদিনই শত শত মানুষ যাচ্ছে ছৈলার চরের নৈসর্গ দেখতে।
চরে বেড়াতে আসা পর্যটক নুরনবী তালুকদার বলেন, ছৈলার চরে প্রায়ই ঘুরতে আসি। এখানে রয়েছে মৌমাছির মৌচাক ও ছৈলার বাগান। নদীর মনোরম পরিবেশ দেখে মনটা ভরে যায়। রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ছৈলার বাগান। এখন আর সুন্দরবন যেতে হবে না। আমাদের এক টুকরো সুন্দরবন হচ্ছে এই ছৈলার চর।
বনের মধ্যে ঘুরছিলেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা মেহের আফরোজ মিতা। তার সাথে ছিলেন আরো কয়েকজন। মেহের আফরোজ বলেন, ঝালকাঠি জেলার মধ্যে এতো সুন্দর একটি স্থান রয়েছে, এটা আগে জানতাম না। এখানে এসে ভালোই লাগল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ছৈলার চরের চারপাশে নদী ও খাল রয়েছে। নদীও দেখা যায়, বনের সৌন্দর্যও উপভোগ করা যায় একসাথে। এখানে বন থাকলেও হিংস্র কোনো প্রাণি নেই। নান্দনিক এ স্থানটিতে বেশি করে পর্যটকদের আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
ঝালকাঠির পাশ্ববর্তী বরগুনা জেলার বাসিন্দা প্রবাসী মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি বিদেশে বসে ছৈলার চরের বিষয়ে জানতে পেরেছি। তখন থেকেই এখানে ঘুরতে আসার ইচ্ছা ছিল। দেশে এসে পরিবার নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছি। অনেক ভালো লাগল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে গেলাম।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ বরগুনার পর্যটকদের নিয়ে কাজ করা যুবক আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, এখানে দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের নিয়ে এসেছি। নদীর বুকে জেগে ওঠা চরকে এতো সুন্দর করে সাজানোর জন্য প্রশাসনকে ধন্যবাদ। নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে কাজ করলে এখানে অনেক পর্যটক আসবে বলে আমার ধারণা।
ছৈলার চর এলাকার বাসিন্দা মো: মনির খান বলেন, একসময় অবহেলিত একটি জায়গা ছিল এটি। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ডিসি লেক, একাধিক গোলঘরসহ অনেক স্থাপনা ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা সুন্দর একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ছৈলার চরকে দেখতে পাব। আমরা এলাকাবাসী পর্যটকদের সেবায় সব সময় নিয়োজিত আছি।
অপর বাসিন্দা মো: হেমায়েত আকন বলেন, এখানে আগে তেমন কিছু ছিল না, এখন বসার জন্য বেঞ্চ, দোলনা, টয়লেট, খাবার বিশুদ্ধ পানি রয়েছে। আমি এখানে সবসময় থাকি। এখানের যাবতীয় কাজ করি ও ফুলের গাছে নিয়মিত পানি দেই। ইউএনও স্যার ছৈলার চরে ‘আশার আলো যুব সমাজ কল্যাণ সমবায় সমিতি’ করে দিয়েছেন। যেখানে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা এই সংগঠনের সদস্য। তারাও চরটিকে সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। সাধারণ মানুষ বা কোনো পর্যটক আসলে তাদের গাইড হিসেবে কাজ করে এবং তাদের সহযোগিতা করে। প্রতিদিন এখানে তিন শ’ থেকে চার শ’ মানুষ ঘুরতে আসেন।
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম বলেন, ছৈলার চরকে আকর্ষণীয় করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্থানীয় লোকজন ছাড়াও আশেপাশের অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ছৈলার চরে বেড়াতে আসেন। তাদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। এই ছৈলার চর এক সময় দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আমি মনে করি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।