বিনোদন ডেস্ক : ‘সবাই অভিনয় শিল্পী নয়, কেউ কেউ অভিনয় শিল্পী’ এমন একটা অকাট্য বাক্য যদি কারো অভিনয় প্রতিভার ক্ষেত্রে খাটানো যায় তখন অধিকাংশের চোখের সামনেই ভেসে উঠবে চঞ্চল চৌধুরীর নাম। একজন সহজাত অভিনয় শিল্পী হিসেবে ইতোমধ্যেই নিজের পথ পরিষ্কার করে নিয়েছেন বরেণ্যদের তালিকায়। এখন তিনি জীবনঘনিষ্ঠ নির্মাতাদের প্রথম ভরসার নাম। এগিয়ে আসছেন পশ্চিমবঙ্গের ডাক সাইটে নির্মাতারাও। যখন তার বয়স আরও পরিণত হবে তখন এই শব্দটি যে তার নামের সঙ্গে অনিবার্য শর্তেই অহরহ বসবে সেটা এখন থেকেই রীতিমতো আন্দাজ করা যাচ্ছে।
মঞ্চ ও ছোটপর্দার অভিনয় শিল্পী হিসেবে শুরুতেই নিজের জাত চেনাতে সক্ষম হন চঞ্চল চৌধুরী। টিভি নাটক দিয়ে দর্শকের কাছে অত্যন্ত সুবিদিত হয়ে ওঠেন। এমন বৈচিত্র্যমুখী প্রতিভা দেশে খুব বেশি দেখা যায়নি। দুই বাংলা মিলিয়ে অসংখ্য নির্মাতা সিনেমা বানিয়েছেন কিন্তু সত্যজিৎ রায় একজনই হয়েছেন। অভিনয়েও খুব বেশি এমন প্রতিভাবান দেখা যায় না। স্রোতের বিপরীতে ব্যতিক্রম হিসেবে যারা নিজের জাত চিনিয়েছেন নিঃসন্দেহে চঞ্চল চৌধুরী অন্যতম।
অভিনেতা মামুনুর রশীদের হাত ধরে হাতেখড়ি হওয়া চঞ্চলের অভিনয়ের আঁতুড় ঘর ছিল মূলত নাট্যমঞ্চ আরণ্যকই। গুরু মামুনুর রশীদের ‘সুন্দরী’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। প্রথমে টুকটাক, ছোটখাট রোলে অভিনয় আর শুধু অপেক্ষায় থাকা কিছু একটা করে দেখানোর। এরপর মুঠোফোনের ‘মা’ বিজ্ঞাপনের একটি জিঙ্গেলে ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মা গো কবে শীতল হবো’… এই মডেল হওয়ার জিঙ্গেলটিই তাকে পৌঁছে দেয় এ দেশের প্রতিটি ঘরে-ঘরে।
দেশের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র চিন্তক, গবেষক, অভিনেতা ও নির্মাতা গাজী রাকায়েত হোসেন চঞ্চল চৌধুরীর প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের দেশে চঞ্চল চৌধুরী অভিনেতা হিসেবে কিন্তু ফিল্ম তারকা ছিলেন না। আজ থেকে চার/পাঁচ বছর আগেও তিনি টিভি অভিনেতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এখন সবাই বলতেছে, তিনি ফিল্মের অনেক বড় মাপের অভিনেতা। কাজেই আমাদের দেশে তারকা অভিনয় শিল্পী হয়ে উঠতেও যেমন সময় লাগে তেমনিভাবে আমাদের দেশে চলচ্চিত্র এভারেজ বা গড় ডেভলাপ করতেও সময় লাগবে।’
গাজী রাকায়েত হোসেন বলেন, ‘এক সময়ে বাংলাদেশে যেসব প্রিম্যাচিউর (অপরিপক্ব) সিনেমা হতো তখন গ্রাম-বাংলার এনভায়রনমেন্ট বা পরিবেশ ছিল অন্যরকম, দর্শকও ছিল অন্যরকম, পরবর্তী সময়ে আমরা সেই এনভায়রনমেন্ট বা পরিবেশ ও তার দর্শক হারিয়ে ফেলি। সেই দর্শক কবেই চলে গেছে। ততদিনে অডিয়েন্সের রুচিরও পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন ঢাকা শহরে ২০ লাখ অডিয়েন্স আছে। এই অডিয়েন্সের রুচির পরিবর্তন হলেও আমরা কিন্তু তার রুচি অনুযায়ী সিনেমাটা দিতে পারছি না। তবে এখন বাংলাদেশের সিনেমা একটা গড় উন্নতির দিকে এগোচ্ছে।’
ঢাকাই বাংলা সিনেমা যখন পরিবর্তিত রুচির সঙ্গে খাপ খাইয়ে একটা গড় উন্নতির দিকে এগোচ্ছে তার কারিগর হিসেবে প্রথমেই যাদের নাম নিতে হয় তারা হারুনর রশীদ, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলাম, তানভির মোকাম্মেল, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, অমিতাভ রেজা, গাজী রাকায়েত হোসেনসহ আরও অনেককে। তাদের ডিরেকশনে নতুন নতুন ডায়নামিক অভিনয় শিল্পীও দেখা দিয়েছে। তাদেরই অন্যতম প্রধান হয়ে উঠেছেন হালের চঞ্চল চৌধুরী। শুধু তাই নয়, গায়ক চঞ্চল চৌধুরীও শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন বৈচিত্র্যময় গান দিয়ে।
অভিনয়ের সব মাধ্যমেই বাঁক বদল করা এক দুর্দান্ত অভিনেতা চঞ্চল। ছিলেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। হয়ে গেলেন পুরাদস্তুর ঝানু অভিনেতা! চারুকলার শিক্ষার্থীদের সবাইকে প্রথমেই রেখা বা নকশা আঁকতে জানতে হয়। সেজন্যই হয়ত চঞ্চল যখন কোনো একটা স্ক্রিপ্টের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হাতে পান তখন চরিত্রটিকে কোন রেখায় বা নকশায় আঁকলে যথার্থ ‘চরিত্র’ হয়ে ওঠবে খুব সহজেই বুঝে নিতে পারেন। চরিত্রটিকে হুবহু রূপ দিতে পারেন।
এক সময়ের থিয়েটারের অভিনেতা ছোটপর্দা থেকে শুরু করা চঞ্চল চৌধুরী পরবর্তী সময়ে সিনেমা, ওটিটি সর্বত্রই সমান দাপটে শাসন করা এক লড়াকু অভিনেতা। ওটিটির যুগেও নির্মাতাদের সবচেয়ে পছন্দ এবং ভরসার নাম চঞ্চল।
‘কারাগার’ এ চঞ্চলের অভিনয় দেখে রীতিমতো হইচইয়ের ঝড় বয়ে যায়। বইবেই না কেন। যেভাবে তিনি সব চরিত্রের সঙ্গে সহজেই মানিয়ে যেতে পারেন সেরকম চরিত্র নিয়ে নিবিড় নকশা আঁকতে পারার মতো আর কোন অভিনেতা আছেন! একেবারে নিরাভরণ ও আটপৌড়ে অভিনয় প্রতিভার জন্যই তো তার এতদূর আসা। সময় যেভাবে তার দিনকে দিন বর্ণিল হয়ে উঠছে কে জানে তিনিও আগামী দিনের মহানায়ক হয়ে ওঠেন কিনা! এবার তাকে দেখা যাবে সুন্দরবন নিয়ে গল্পের নতুন ওয়েব সিরিজে।
পরিচালনায় থাকছেন সুকর্ণ সাহেদ ধীমান। এদিকে চঞ্চল শেষ করেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালনায় ‘লাস্ট ডিফেন্ডার অব মনোগামি’র কাজ। সিনেমাটি সম্পর্কে চঞ্চল বলেন, ‘ফারুকী ভাইয়ের সঙ্গে আমার ২০০৫ সালে কাজের শুরু। আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্টই সেই কাজটি। এবার মনোগামি সিনেমার গল্পটাও একদম আলাদা। এখানে আমার চরিত্রের লুক, গেটআপ একদম ভিন্ন।’
ফলে চরিত্রের অঙ্কন শিল্পী হিসেবে চঞ্চল তার চারুশিল্পীগত গুণ এবং অভিনয় গুণের মিশেল দিয়ে নিজের ব্যক্তি নামকে ছাপিয়ে দর্শকের কাছে হয়ে ওঠেন কখনো রুপালি পর্দার ‘সোনাই’ কখনো ‘কালু’ কখনো বা ‘সোলেমান’, কখনো বা শরাফত করিম আয়না বা ‘চান মাঝি’।
‘বোঝ নাই ব্যাপারটা’খ্যাত চঞ্চল আরও কত চিত্তাকর্ষক সংলাপ দিয়ে দর্শকের মন ভোলাবেন কে জানে। তার এই সংলাপটিই মনে করিয়ে দিয়েছিল দক্ষিণী সিনেমার আরেক দাপুটে অভিনেতা রজনীকান্তের সেই সংলাপটিকেও, ‘কীভাবে বা কখন কী করব, তা কখনোই তোমাকে বলব না। যখন করব, তখনই বুঝবা।’
রজনীকান্তের মতো চঞ্চল চৌধুরীরও অভিনয় শৈলীগত সংলাপ ছোড়ার এই সক্ষমতার কথা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী দেশেও।
চঞ্চলের প্রধান গুণ অভিনয়ে সব রকমের কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত হয়ে শেঁকড়ের মানুষের কাছাকাছি থাকা। ফলে গ্রামজীবনের ওপর নাটকের অভিনয়ে তার প্রকাশভঙ্গিতে বাস্তব প্রতিচ্ছবিটিই ফুটে ওঠে। এভাবে গ্রামের মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারাই হচ্ছে তার অভিনয়ের বিশেষ গুণ। তখন তাকে ‘অভিনেতা’ও মনে হয় না। গল্পের হুবহু চরিত্র মনে হয়। তাই তো তার অভিনয়ের শুরুতে গ্রামের লাখ লাখ মানুষ তার নাটকের সিডি কিনে দেখত। পাবনার আঞ্চলিক ভাষাকেও মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলেছেন তিনি। যেখানেই তিনি শিল্পী হিসেবে অভিনয়ের আছেন সেখানেই সোনা ফলে। সর্বত্রই কী এক জাদুতে যেন বাঁকবদল আসে।
একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া চঞ্চল এবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার-২০২২ এ শিল্পীদের মধ্যে সর্বোচ্চ দুটি পুরস্কার পেলেন। এখানে ‘হাওয়া’ সিনেমায় ‘চান মাঝি’ চরিত্রটিই তার টার্নিং পয়েন্ট। তারকা জরিপে সেই চরিত্রটিই এ পুরস্কার এনে দিয়েছে তাকে। অন্যদিকে, ওয়েব সিনেমা ‘দুই দিনের দুনিয়া’তে অভিনয়ের জন্য সমালোচকদের রায়ে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান তিনি।
এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে উজ্জ্বল চোখদীপ্ত চঞ্চল বলেন, ‘এই পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমি প্রথমেই বলব, ‘হাওয়া’ টিম ও সিনেমাটির পরিচালক সুমন, তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা। আর পিন্টু দাদা, অজয় দাদা, তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা। আমরা বাংলাদেশ থেকে অনেক ভালো সিনেমা করতে চাই। আমাদের সিনেমা সারা বিশ্বে সমাদৃত হোক। এগিয়ে যাক আমাদের সিনেমা।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।