জুমবাংলা ডেস্ক : খাদ্য ও কৃষি সমৃদ্ধ অঞ্চল খ্যাত শেরপুরে এবার কলা চাষে ভাগ্যবদল হচ্ছে এখানকার শত শত চাষীর। স্বল্প ব্যয়ে ভাল ফলন, পুষ্টিমান ও বাজার থাকায় অধিক লাভ পাওয়ায় ক’বছর আগে থেকেই কলা চাষে মনোযোগী হয়ে পড়েছেন এ অঞ্চলের অনেক চাষী। ক্রমেই কলা চাষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় বর্তমানে তা বানিজ্যিক চাষাবাদে রূপ নিয়েছে। এ এলাকার উৎপাদিত কলার পুষ্টিগত মান ভিন্ন হওয়ায় অনেক অঞ্চলে তার বিশেষ কদরও রয়েছে। ফলে নিজ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে পাঠিয়ে একদিকে কলা চাষীদের যেমন হচ্ছে ভাগ্যবদল, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে ওঠায় পাল্টে যাচ্ছে কোন কোন এলাকার চিত্রও।
ইতিহাস বলে, প্রাচীনকাল থেকেই কলার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বে যত ধরনের সুমিষ্ট ফল আছে, কলাকে ধরা হয় সবচেয়ে প্রাচীন ফল। শিশু থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবার কাছেই কলা একটি সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর খাবার। হিন্দু ধর্মে দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে তুলনা করা হয় কলা গাছকে। এজন্য যেকোন পূজা-অর্চনায় কলার দেখা মিলবেই। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সৈন্যবাহিনীসহ যখন ভারতে আসেন, ইউরোপিয়ান হিসেবে তারাই প্রথম কলার দর্শন পান।
তবে সারা বিশ্বে কলা চাষ ছড়িয়ে পড়ে মূলত ১৫১৬ সালের দিকে। সে সময় ক্যারিবিয়ান দ্বীপকুঞ্জের বাসিন্দারা কলা চাষ শুরু করে। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ আমেরিকায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত কলা ছিল দুর্লভ ও দামী খাবার। তবে ভারত বর্ষে কলার জনপ্রিয়তা বাড়ে শুধু তার সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে। কলা এমনই এক ফল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছেই তা প্রিয়।
বিশেষ করে পুরো কলা গাছটাই হিন্দু উপাসনায় ব্যবহৃত হয়। কার্যত কলা গাছের কোন অংশকেই ফেলে দেয়া যায় না। এ গাছে বাকল গবাদিপশুর আহার হিসেবে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি প্রাচীন আর্য সমাজ থেকে চলে আসা রীতি অনুসরণ করে এখনও কোন কোন এলাকায় কলা পাতা ও খোল পুড়িয়ে ক্ষার তৈরি করে কাপড় কাচায় ব্যবহারের পাশাপাশি কলা গাছের মোচা ও থোড় দিয়ে রান্না করে খাওয়া হয়।
কৃষিপ্রধান শেরপুরে ধান ও শস্য-সবজি উৎপাদনই কৃষকের প্রধান ফসল হলেও, আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ অঞ্চলে দিন দিন বাড়ছে নতুন নতুন ফসল উৎপাদনের চর্চা। তারই আওতায় শেরপুর সদর ও নকলাসহ সীমান্তবর্তী বিস্তৃত এলাকায় গত প্রায় অর্ধ যুগ ধরে যেমন বেড়েছে সাগর ও সবরী কলাসহ বাহারি কলার চাষ, ঠিক তেমনি আপেলকুল, লটকন, স্টবেরি, ড্রাগনসহ নানা ফলের গড়ে উঠছে বাগান। তবে ক্রমবর্ধমান কলা চাষ এ অঞ্চলের অনেক চাষীর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে। এজন্য শেরপুরের বিভিন্ন এলাকায় একরের পর একর জমি এবং বাড়ির আশপাশ, ডোবা, নালার পাশে বিভিন্ন জাতের সবরি কলা, চিনি চাম্পা কলা, বিচি কলা ও সাগর কলার গাছ লাগানো রয়েছে। গত বছরের জুনের শুরুতেই কলা চাষীরা জমিতে গোবর, ইউরিয়া, পটাশ, ফসফেট সার মিশিয়ে জমি তৈরি করে তাতে ৩ হাত ফাঁকা করে কলার চারা লাগিয়েছেন।
৮ থেকে ৯ মাসের মধ্যে প্রতিটি গাছে কলার মোচা এসেছে। বর্তমানে প্রায় গাছের কলা বাজারজাত করার উপযোগী হয়ে উঠেছে। চাষীরা জানান, এক বিঘা জমিতে কলা চাষ করতে খরচ হয় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। বিঘাতে প্রায় ৩৬০ থেকে ৩৮০টি গাছ লাগানো যায় এবং প্রতিটি গাছে কলার ছড়া ধরে। কলাচাষী বড় ছড়া বিক্রি করছেন বর্তমান সাড়ে ৪শ’ টাকা। মাঝারি ছড়া সাড়ে ৩শ’ টাকা এবং ছোট ২শ’ থেকে ২৫০ টাকায়। ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করে একজন বাগান মালিক কলা বিক্রি করছেন প্রায় ২ লাখ টাকা। প্রথম চালান কলা কাটার পর গাছটি কেটে ফেলেন। সেই কাটা গাছের গোড়া থেকে আবারও কুশি বের হয়ে থাকে। সেই কুশি থেকে আবার দ্বিতীয় চালান কলা ধরে। এভাবে একজন কলাচাষি বাগান থেকে দু’বার কলা বাজারজাত করেন। তবে দ্বিতীয়বারে কলার আকার অনেকটা ছোট আকৃতির হয়।
অন্য যে কোন ফসলের চেয়ে অনেক বেশি লাভ হয় কলা চাষে। ফলে অন্য ফসলের পাশাপাশি এখন কলা চাষ বেশি হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে শেরপুরের বিভিন্ন এলাকায় সাগর ও সবরি কলাসহ বিভিন্ন জাতের কলা চাষ করা হয়েছে। ওইসব জাতের গাছ থেকে অল্প দিনেই ফল পাওয়া যায়। তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ফসলের চেয়ে কলার দামও বেশি। সাধারণত বৈশাখ মাসে কলার চারা রোপণ করলে অগ্রহায়ণ মাস থেকে কলা পাওয়া শুরু হয়।
কথা হয় সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের কলা চাষী আতাব উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, এক বিঘা জমিতে কলার বাগান করেছি। এটা আমার নতুন বাগান। প্রতিটি গাছে কলা ভাল হয়েছে। গত সপ্তাহ থেকে কলা কাটতে শুরু করেছি। বড় ছড়াগুলো সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা দরে বিক্রি করছি এবং মাঝারি ছড়াগুলো ৪শ’ এবং ছোট ৩শ’ টাকায় বিক্রি করছি। একই এলাকার আব্দুল খালেক জানান, এ বছর দেড় বিঘা জমিতে কলার চাষ করেছি। ফলন অনেক ভাল। দামও ভাল। নিমতলা এলাকার লিটন মিয়া জানান, কলা চাষে লাভের পাল্লাই ভারি থাকে। গাছ লাগানো থেকে শুরু করে, ১১ মাসের মধ্যে কলা কাটা বা ছড়ি নামানো যায়। এর মধ্যে কলা পাওয়া যায় ৩শ’ থেকে ৩২০টি। যোগিনীবাগ এলাকার চাষী আব্দুর রহিম বলেন, আমি এবার ২ বিঘা জমিতে কলা চাষ করেছি। এখনও কলা বিক্রি শুরু করিনি। ফলন দেখে মনে হচ্ছে সব খরচবাদে বিক্রি করে ৭০ হাজার টাকা আয় আসবে।
সরেজমিনে আড়তে গেলে কথা হয় কলা ব্যবসায়ী ও আড়তদার হাবিবুর রহমান, বিপুল মিয়া ও শামীম মিয়ার সঙ্গে। তারা জানান, বাগানে কলার ছড়ি আসার পর পরই চাষীদের কাছ থেকে প্রতি ১শ’ ছড়ি ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় ক্রয় করেন তারা। পরে সময় হওয়া সাপেক্ষে সেগুলো কেটে আড়তে নিয়ে এসে প্রাকৃতিক উপায়ে পাকিয়ে প্রতি পুন (২০ হালি বা ৮০পিছ) ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় প্রাইকারিতে বিক্রি করেন তারা। এতে তারাও লাভবান হন।
এ ব্যাপারে শেরপুর খামারবাড়ির ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সুলতান আহম্মেদ জানান, কলা একটি লাভজনক ফসল। সল্প ব্যয়ে অধিক লাভ পাওয়ায় এখন শেরপুরে বাণিজ্যিকভাবে কলা চাষ হচ্ছে। চলতি মৌসুমে প্রায় ১৩শ’ চাষী কলা চাষ করেছেন। কৃষি বিভাগের তরফ থেকে তাদের নানাভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। চাষের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২৯ হেক্টর জমি। তা থেকে উৎপাদন হবে প্রায় ৩ হাজার ২০৫ মেট্রিকটন কলা। কোন রোগবালাই না দেখা দেয়ায় চলতি মৌসুমে জেলায় কলার বাম্পার ফলন হতে পারে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।