আন্তর্জাতিক ডেস্ক : চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাংকে জনসম্মুখে দেখা যাওয়ার চার সপ্তাহ পর পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম মঙ্গলবার জানিয়েছে, সাত মাস দায়িত্ব পালন করা কিনের পূর্বসুরী ওয়াং ই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। তবে এই রদবদলের কোনো কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা বুধবার এক সংবাদ বিশ্লেষণে চীনের চলমান ঘটনার কারণ ও সম্ভাব্য প্রভাব তুলে ধরেছে। তুলনা করা হয়েছে অপসারিত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কেও।
এতে বলা হয়, রহস্যজনকভাবে অনুপস্থিত ৫৭ বছর বয়সী কিন একসময় প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের কাছের লোক ছিলেন। তাঁর এই অনুপস্থিতি ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। চীনা কর্মকর্তারা এর আগে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা না দিয়ে শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘স্বাস্থ্যগত কারণ’ উল্লেখ করেছিলেন।
কে এই কিন গ্যাং?
সদ্য অপসারিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাংয়ের জন্ম ১৯৬৬ সালে উত্তরাঞ্চলীয় শহর তিয়ানজিনে। তিনি বেইজিংয়ে স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটি অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং কূটনীতিক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকটি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ব্রিটেনে চীনা দূতাবাসে কাজ করেছেন।
কিন ২০০৬ ও ২০১৪ সালের মধ্যে দুই মেয়াদে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ছিলেন। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিদেশি নেতাদের সঙ্গে শি জিন পিংয়ের যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রধান প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
আল জাজিরার প্রতিবেদক ক্যাটরিনা ইউর মতে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে (সিসিপি) কিনের উত্থান ছিল ‘দ্রুত’। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ৫৭ বছর বয়সে তিনি কম বয়সী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন।
বেইজিং থেকে ক্যাটরিনা ইউ বলেন, কিন কয়েক বছরে যা অর্জন করতে পেরেছেন তা করতে অন্য কর্মকর্তাদের কয়েক দশক লেগেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিসেবে তিনি চীনের ক্রমবর্ধমান দৃঢ় বৈদেশিক নীতির প্রতিরক্ষায় আক্রমণাত্মকভাবে কথা বলায় এগিয়ে থাকা কূটনীতিকদের একজন হয়ে উঠেছিলেন।
তবে কিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছার কথাও জানিয়েছিলেন। ২০২১ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে ওয়াশিংটনে তাঁর যাওয়ার পরে ঘোষণা করেছিলেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘বিরাট সুযোগ ও সম্ভাবনা’ রয়েছে। যদিও রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার সময়ে দেশ দুটির সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি।
কিন বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর আফ্রিকা ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। এসব সফরে তিনি ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির জন্য চীনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তাঁর প্রথম বক্তব্যে কিন বলেছিলেন, মানবজাতির জন্য সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করার ক্ষেত্রে চীনের কূটনীতি ‘চীনা প্রজ্ঞা, চীনা উদ্যোগ ও চীনা শক্তি’ নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেবে।
চীনের সর্বকনিষ্ঠ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একজন কিন দেশের সবচেয়ে কম সময়ের জন্য দায়িত্ব পালনকারী মন্ত্রী হিসেবে তার মেয়াদ শেষ করেছেন।
কে এই ওয়াং ই
ওয়াং ই চীনের শীর্ষ কূটনীতিক। তিনি দেশটির বৈদেশিক নীতির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থার প্রধানের শ্রেণিবিন্যাসেরও উপরের স্থরের মানুষ।
৬৯ বছর বয়সী ওয়াং ই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আগেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০১৩ সাল থেকে প্রায় এক দশক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং গত মাসে কিনের অনুপস্থিতিতে তাঁর কাজ চালিয়ে নিয়েছেন।
ক্যাটরিনা ইউ বলেন, ওয়াংয়ের দ্বৈত ভূমিকার কারণে কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন তাঁর নিয়োগ অস্থায়ী হতে পারে। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত ওয়াং ই দায়িত্ব থাকবেন।
তিনি উল্লেখ করেন, ওয়াং একজন অভিজ্ঞ, পরিচিত মুখ এবং তিনি একটি অস্থির পরিস্থিতিতে স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে সামনে এসেছেন।
ওয়াং অনর্গল জাপানি বলতে জানা লোক, তিনি অতীতে টোকিওতে চীনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া চীনের তাইওয়ান বিষয়ক নীতিনির্ধারক অফিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
সিসিপি পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিশনের প্রধান হিসেবে, ওয়াংকে চলতি বছরের মার্চ মাসে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি ‘চমকপ্রদ’ শান্তি চুক্তির মধ্যস্থতাযকারী রূপে দেখা গিয়েছিল।
চলতি সপ্তাহে আসলে কি ঘটেছে?
কিন গ্যাংকে শেষবার গত ২৫ জুন জনসমক্ষে দেখা গিয়েছিল। তখন তিনি রাশিয়া, ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কার নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
তারপর থেকে, তিনি ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল করার প্রচেষ্টাসহ বেইজিংয়ের জন্য জোরালো কূটনৈতিক কার্যকলাপ চলার সময়ে দায়িত্ব থেকে স্পষ্টতই অনুপস্থিত ছিলেন।
কিনের ৪ জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু ইইউ কর্মকর্তারা ঘোষণা করেন, চীন মাত্র কয়েক দিন আগে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই আলোচনা বাতিল করেছে।
কিন তখন মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেন ও মার্কিন জলবায়ু দূত জন কেরির সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেননি।
১১ জুলাই কিনের মন্ত্রণালয় বলেছিল, তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত ‘স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে’ ইন্দোনেশিয়ায় একটি বৈঠকে যোগ দিতে অক্ষম ছিলেন। পরে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে আর কোনো মন্তব্য না আসায় একটি তথ্য শূন্যতা তৈরি করে, যাতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
গত সপ্তাহে জাকার্তায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির জোটের (আসিয়ান) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের শীর্ষ সম্মেলনের বৈঠকে কিনের অনুপস্থিতে চীনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ওয়াং ই।
কিন গ্যাংয়ের আসলে কি হয়েছে?
কিন গ্যাংকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে কোনো কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। তাঁর অবস্থান এখনো অজানা। তাঁর অপসারণ সম্পর্কে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে বলা হয়, ‘চীনের শীর্ষ আইনপ্রণেতারা ওয়াং ইকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের পক্ষে ভোট দিয়েছে … এজন্য মঙ্গলবার একটি অধিবেশন আহ্বান করা হয়। কিন গ্যাংকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।‘
আল জাজিরার ক্যাটরিন ইউ বলেন, কিনের অবস্থান ঘিরে থাকা রহস্য চীনা সরকারের গোপনীয় মনোভাবকে তুলে ধরে। কর্তৃপক্ষের কোনো ভুলের পরে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব যেমন ব্যবসায়ী বা সেলিব্রিটিরা জনসাধারণের দৃষ্টি থেকে সাময়িকভাবে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এত ক্ষমতাধর একজন সরকারি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এমনটা হওয়া সত্যিই বিরল।
এই পরিবর্তন কেন ঘটল?
বিশ্লেষকরা বলছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হঠাৎ নেতৃত্বের পরিবর্তন বেইজিংয়ের কূটনৈতিক পদমর্যাদায় গোলমাল তৈরি করবে বলে মনে হচ্ছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পল সাই চায়না সেন্টারের সিনিয়র ফেলো নিকোলাস বেকেলিন আল জাজিরাকে বলেন, এটি চীনের জন্য খুবই বিব্রতকর বিষয়।
তিনি বলেন, চীনের পরিচিত মুখ পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাংয়ের আড়ালের ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মঞ্চে কূটনীতিকদের মধ্যে চীনের নেতিবাচক চেহারা দূর করা একটু বেশিই কঠিন হবে। কারণ কিন গ্যাং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের অন্যতম বিশ্বস্ত উপদেষ্টা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের নীল থমাস আল জাজিরাকে বলেন, গত বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার জন্য আরও অনেক প্রতিষ্ঠিত প্রার্থী থাকা স্বত্ত্বেও শি জিন পিং নিজেই কিন গ্যাংকে পছন্দ করেছিলেন। সুতরাং তিনি সত্যিই শীর্ষ নেতার বাছাই, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টির র্যাঙ্কে অন্যদের উত্থানের গতির দিক থেকে শি জিন পিংয়ের অন্যান্য মিত্রদের চেয়েও বেশি।
বিকিউলিন উল্লেখ করেছেন, শি নিজেই চীনের বৈদেশিক নীতির দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন, ওয়াংকে কৌশল বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কিন গ্যাং প্রতিদিনের কার্যক্রম চালিয়ে নিয়েছেন শুধু। কিন্তু তবুও এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ কূটনীতিকরা বিশ্বাসের উপর, একে অপরকে জানার উপর, একে অপরের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। সুতরাং এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে আপনি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সঠিক ব্যাখ্যা ছাড়াই এক মাসের জন্য নিখোঁজ করবেন।
বিকিউলিন যুক্তি দেন, মানুষের মনে এই ধারণা ফিরে আসবে যে, চীন সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা কঠিন। দেশটিতে যে কোনও সময়ে লোকেরা অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, পরের দিন কী হবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।