মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম : চেকের মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লাগছে বা আদালতগুলোতে মামলার সংখ্যা বেশি হওয়ায় চেকের মামলার দিন-তারিখ নির্ধারণ হচ্ছে বছরে ১ বা ২টি; বিধায় জাতীয় সংসদে নিয়মিত অধিবেশনে স্বতন্ত্র নির্বাচিত সাংসদ ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন এক সম্পূরক প্রশ্ন করে আইনমন্ত্রীর নিকটে জানতে চান এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী? চেকের মামলা বর্তমান আদালতগুলোতে খুব বেশি পরিমাণ দায়ের হওয়ায় চেক সংক্রান্ত আইনকানুন অনেকে জানতে চান। মূলত তাদের জন্যই এই লেখা। শুরুতে একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করছি। বিপ্লব আর তাইজুল দুই জন ঘনিষ্ট বন্ধু। শুধু ঘনিষ্ঠ নয় তাদের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক বিদ্যমান। বিপ্লব একদিন তাইজুলের নিকটে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তিন লক্ষ টাকা ধার নেয় এবং আর বলে যে সে দুই সপ্তাহের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ করবে। বিপ্লব তার নিকট থাকা একটি চেকের পাতা স্বাক্ষর করে দিয়ে তাইজুলকে বললো আগামী সাপ্তাহে সে এই চেক ব্যাংকে জমা দিলে সে এই দুই লক্ষ টাকা ফেরত পাবে। কিন্তু উক্ত চেক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা দিলে তা বিপ্লবের হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় বাউন্স হয়- তার মানে চেকটি ডিজ-অনার হয়। ফলে দুই বন্ধুর মাঝে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও শত্রুতায় পরিণত হয়। তাইজুল এখন চায় বিপ্লবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে এবং তার কষ্টার্জিত টাকা ফেরত পেতে। চেকে উল্লিখিত টাকা ফেরত পেতে তাইজুলের এখন কী করণীয় তা সংক্ষেপে আলেচনা করা হলো।
চেক ডিজ-অনার মামলার মৌলিক বিষয়াদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থাৎ চেক ইস্যু করার তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে জমা দিতে হবে। ব্যাংক হিসাব নম্বরে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেক ডিজ-অনারের সময় থেকে ৩০ দিন-এর মাঝে চেকদাতাকে আইনজীবীর মাধ্যমে টাকা পরিশোধের জন্য লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করতে হবে এবং নোটিশ গ্রহীতার হাতে সরাসরি নোটিশ প্রদান করে। চেক দাতা নোটিশপ্রাপ্তির ৩০ দিনের ভিতরে চেকে উল্লিখিত টাকা চেক গ্রহীতাকে পরিশোধ না করলে তখন চেক গ্রহীতা মামলা করতে পারবে। লিগ্যাল নোটিশ তিনভাবে দেওয়া যেতে পারে। ডাকযোগে চেক প্রদানকারীর ঠিকানায় এবং সর্বশেষ বসবাসের ঠিকানায় প্রাপ্তি স্বীকারপত্রসহ নোটিশ প্রদান করে। সর্বশেষ কোনো জাতীয় বাংলা দৈনিকে নোটিশটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করে। এ তিন পদ্ধতির যেকোনো একটা পদ্ধতি অনুসরণ করলেই হবে।
মামলা করার জন্য যে সকল কাগজপত্র আদালতে দাখিল করতে হয়:
১। মামলার আরজি/ দরখাস্ত।
২। লিগ্যাল নোটিশ-এর ফটোকপি ।
৩। লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণের ডাক রশিদ এবং এ.ডি-এর ফটোকপি।
৪। মূল চেকের ফটোকপি।
৫। ডিজ-অনার স্লিপ-এর ফটোকপি।
৬। অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র।
চেক ডিজ-অনারে মামলা যেখানে দায়ের হয় অভিযোগ বা নালিশি মোকাদ্দমা সি. আর মামলা হিসেবে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। আদালত মোকাদ্দমাটি গ্রহণ করলে বিবাদীর নামে সমন অথবা ওয়ারেন্ট জারি করতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলা গ্রহণ করলেও মামলাটি মূল বিচার করা হয় দায়রা আদালতে।
চেক ডিজ-অনার মামলায় তাইজুলকে যা প্রমাণ করতে হবে:
চেক ডিজ-অনারের মামলায় বাদীকে অনেক বিষয় প্রমাণ করতে হয় এবং সে সকল বিষয় প্রমাণ করতে পারলে আসামীকে শাস্তি দেওয়া যাবে।
১। ঋণ বা দায়-দেনা পরিশোধের আসামি বাদীকে চেক প্রদান করেছে ।
২। আসামি উক্ত ঋণ বা দায়-দেনা আইনুগভাবে পরিশোধ করতে বাধ্য।
৪। ব্যাংক হিসাব নম্বরে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ইনসাফিসিয়েন্ট ‘ফান্ড’ বিবেচনায় চেক ডিজ-অনার হয়েছে।
৫। ৩০ দিন-এর মাঝে আসামিকে টাকা পরিশোধের জন্য লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।
৬। আসামি নোটিশপ্রাপ্তির ৩০ দিনের ভিতরে চেকে উল্লিখিত টাকা বাদীকে পরিশোধ ব্যর্থ হয়েছে।
৭। আসামি ব্যবসায়িক লেনদেনের কারণে বাদীকে চেক প্রদান করলে বাদীকে আসামির সাথে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল প্রমাণ করতে হবে।
চেক হারিয়ে গেলে যা করতে হবে:
চেক হারিয়ে গেলে যত দ্রুত সম্ভব আপনার নিকটস্থ’ থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়ারি (জিডি) করবেন। অথবা আপনার চেক যে স্থানে হারিয়ে গিয়েছে তার নিকটস্থ থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করতে পারেন। জিডির সত্যায়িত কপি হিসাবধারী ব্যক্তিগতভাবে ব্যাংক-এর সংশ্লিষ্ট শাখায় উপস্থিত হয়ে জিডির কপিটি জমা দেবেন। এক্ষেত্রে আপনার হারিয়ে যাওয়া চেক দিয়ে কেউ আপনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারবে না। আর আপনি যদি চেক ডিজ-অনারের মামলা দায়ের করার পর মূল চেক, ডিজ-অনারের রশিদ, পোস্টাল রশিদ, প্রাপ্তিস্বীকার রশিদ হারিয়ে ফেলেন তাহলে যে স্থানে হারিয়ে গিয়েছে তার নিকটস্থ থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়ারি (জিডি) করতে পারেন হবে। আপনার মামলার সাক্ষ্য গ্রহণসহ অনেক ক্ষেত্রে জিডির সত্যায়িত কপি প্রয়োজন হবে। আবার চেক ডিজ-অনার হবার পর ডিজ-অনার স্লিপসহ চেক হারিয়ে গেলে এ বিষয়ে থানায় জিডি করে দি নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট এ্যাক্ট-এর ১৩৮ ধারায় মামলা করা হয় তাহলে মামলার বাদীকে সাক্ষ্যকে সমর্থন করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিলে ধরে নেওয়া হয় যে বাদী তার মামলায় উক্ত বিষয়ে প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন।
চেক ডিজ-অনারের মামলায় বাদী/আসামি মৃত্যু হলে করণীয়:
চেক ডিজ-অনারের মামলায় বাদী/আসামি কোনো এক পক্ষ মারা গেলে মামলাটি শেষ হয়ে যায় অনেকে মনে করেন। দি নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট এ্যাক্ট-এর ১৩৮ ধারায় চেক ডিজ-অনারের মামলায় এমনটি ঠিক নয়। চেক ডিজ-অনারের মামলা অন্য সকল ফৌজদারী মামলা থেকে একটু আলাদা এবং এটি কিছুটা দেওয়ানি প্রকৃতির হওয়ায় বাদী অথবা আসামির মৃত্যুর কারণে মামলা শেষ হয়ে যায় না। বাদীর মৃত্যুর পর তার বৈধ প্রতিনিধি মালার বাদী প্রক্ষভুক্ত হয়ে মামলা পরিচালনা করতে পারবে। মামলা চলমান থাকা অবস্থায় আসামির মৃত্যু হলে মামলার আরজি সংশোধন করে মামলা চলানো যায়। মামলা চলমান অথবা মামলা করার পূর্বে আসামির মৃত্যু হলে বাদীর একমাত্র প্রতিকার হলো আসামীর বৈধ প্রতিনিধি বিরুদ্ধে দেওয়ানি আদালতে টাকা৩ আদায়ের মামলা করে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা।
চেক ডিজ-অনারের মামলার বিচার সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের নতুন রায় নিয়ে কিছু কথা বলে রাখা ভালো। ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৪১ (গ) ধারা অনুযায়ী, চেক ডিজ-অনার-এর মামলার বিচার করতে পারে দায়রা আদালত। অর্থাৎ দায়রা, অতিরিক্ত দায়রা এবং যুগ্ম দায়রা আদালতে সবাই এরূপ মামলার বিচার করতে পারেন এবং এতদিন পর্যন্ত করে আসছেন। তবে সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে- এখন থেকে চেক ডিজ-অনার এর মামলার বিচার করতে পারবে শুধুমাত্র যুগ্ম দায়রা জজ। কারণ হলো চেক ডিজ-অনার মামলা শুধুমাত্র যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে শুনানি হবে এবং যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতেই আপিল করতে হবে। আগে চেক ডিজ-অনারের মামলা দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং যুগ্ম দায়রা জজ আদালত শুনানি করতো। এক্ষেত্রে দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজ বিচার করলে বিচারপ্রার্থীকে চেকের মামলায় আপিল করতে আসতে হতো হাইকোর্টে বিভাগে। এই বিধানটি বৈষম্যমূলক যাহা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ এবং ৩১-এর সাথে সাংঘর্ষিক। রায়ের নির্দেশনা মতে দি নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট এ্যাক্ট-এর ১৩৮ ধারার চেকের মামলার বিচার কেবলমাত্র যুগ্ম দায়রা জজ আদালত করতে পারবে। দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ চেকের মামলার বিচার করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কেইস রেফারেন্স হলো Md. Abul kaher Shahin VS Emran Rashid and others,25 BLC (AD)115, এই মামলার রায়ে আদালত উল্লেখ করেন যে, Where the amount promised shall depend on some other complimentary facts or fulfillment of another promise and if check is issued on that basis, but the promise is not fulfilled it will not create any obligations on the part of the drawer of the check or any right which can be claimed by the Holder of the cheque.
এই মামলার রায়ের আগে চেক ডিজ-অনার হলেই কেবল চেকদাতাকে সাজা দেওয়া হতো। সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ের ফলে এখন থেকে চেকের বৈধ বিনিময় প্রমাণে ব্যর্থ হলে কোনো চেকদাতাকে সাজা দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে চেকপ্রাপ্তির বৈধ কারণ থাকতে হবে। যদি প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারের ভিত্তিতে চেক প্রদান করা হয় এবং সেই প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার যদি বাস্তবায়িত না হয় তাহলে চেক প্রদানকারীর টাকা পরিশোধে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না এবং চেক গ্রহীতার কোনো অধিকার তৈরি হবে না।
চেক ডিজ-অনার হলে দেওয়ানি আদালতে মামলা করার পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে রাখতে যারা এই মামলার সাথে অংশীজন রয়েছে। চেক ডিজ-অনারের মামলা আংশিক দেওয়ানি এবং ফৌজদারী প্রকৃতির। তাই চেক ডিজ-অনার হলে দেওয়ানি আদালতেও মামলা দায়ের করা যায়। দি কোড অব সিভিল প্রসিডিউর-এর ৩৭ আদেশের ১-৭ বিধিতে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে এরকম বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে। অন্যান্য দেওয়ানি মামলার ন্যায় সাধারণ পদ্ধতিতে মামলা পরিচালিত হলে অনেক সময়ের অপচয় হবে। তাই চেক ডিজ-অনারের মামলা দেওয়ানি কার্যবিধির ৩৭ আদেশের অধীনে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে মামলা পরিচালনার সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো, বিবাদীকে এক্ষেত্রে লিখিত জবাব দাখিল করতে হয় না। দি কোড অব সিভিল প্রসিডিউর-এর ৩৭ আদেশের ১ বিধিতে বলা হয়েছে, হস্তান্তরযোগ্য দলিল বিষয়ে মামলা কেবলমাত্র হাইকোর্ট বিভাগ এবং জেলা জজ আদালতে দায়ের করা যাবে। আমরা জানি “চেক” একটি হস্তান্তরযোগ্য দলিল। তাই চেক ডিজ-অনার হলে দেওয়ানি কার্যবিধির ৩৭ আদেশের অধীনে হাইকোর্ট বিভাগ অথবা জেলা জজ আদালতে দেওয়ানি মোকদ্দমা করা যায়। মোকদ্দমা দায়েরের ক্ষেত্রে দি কোড অব সিভিল প্রসিডিউর-এর ১৫ ধারার বিধান বিবেচনায় রাখতে হবে।
দি কোড অব সিভিল প্রসিডিউর-এর ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, বিচার করার এখতিয়ার সম্পন্ন সর্বনিম্ন আদালতে দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে হবে। তাই বাদীকে এই ধরণের মামলা জেলা জজ আদালতে দায়ের করতে হবে। এক্ষেত্রে বাদী হাইকোর্ট বিভাগকে এই ধরনের মামলা আমলে নিতে বাধ্য করতে পারবে না। [Bengal Techno Consult v. Registrar, 2005 BCR 133]
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অনেকেই করে থাকে চেক ডিজ-অনারের কারণে দি নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট এ্যাক্ট এর ১৩৮ ধারায় মামলা না করে দন্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারায় মামলা করা যায় কিনা? ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারার শুরুতে ‘Notwithstanding anything contained in’ শব্দগুলোর অনুপস্থিতি প্রমাণ করে উক্ত ধারায় কোনো ‘Non-obstante clause’ নেই। তাই ১৩৮ ধারার অপরাধের কারণে বাদী শুধুমাত্র হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের অধীনেই মামলা করতে পারবে- এই কথাটা ঠিক নয়। দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারার অধীনে আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রেও বাদীর কোনো বাধা নেই। এ প্রসঙ্গে নুরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র এবং অন্যান্য [49 DLR(HCD) 464] মামলায় উপর্যুক্ত বিষয়ে আলোচনা করে হাইকোর্ট বিভাগ মতামত দেন যে, বাদীপক্ষ ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবে। এখন বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, চেক ডিজ-অনার হলে বাদীপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারায় মামলা করতে পারবে অথবা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারাতেও মামলা করতে পারবে।
চেক ডিজ-অনারের মামলায় অপরাধের শাস্তি ও আপিলের বিধান- সকল সাক্ষ্য প্রমাণ, জেরা, যুক্তিতর্কের পর আদালত রায় প্রদান করবেন। অপরাধ প্রমাণ হলে আইন অনুসারে শাস্তি হিসেবে এক বছর কারাদণ্ড অথবা চেকে উল্লিখিত অর্থের তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। আদালতের রায়ের পরে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। দি নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট এ্যাক্ট-এর ১৩৮ ধারায় চেক ডিজ-অনার মামলায় প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে। এনআই এ্যাক্টের সকল মামলা এখন যুগ্ম দায়রা জজে বিচার হয় এবং যুগ্ম দায়রা জজের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজের নিকট আপিল করার বিধান রয়েছে। দি নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট এ্যাক্ট-এর ১৩৮ ধারায় চেক ডিজ-অনার মামলায় প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা আগে দণ্ডাদেশের উল্লিখিত অর্থের ৫০% আদালতে জমা দিয়ে আপিল করতে হবে। ৫০% টাকা বিচারিক আদালতে জমা দিতে হবে অর্থাৎ যে আদালত শাস্তি প্রদান করেছেন সে আদালতে টাকা জমা দিতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট একটি ক্রিমিনাল আপিল মামলায় বলে দিয়েছেন চেকের মামলায় বাদীকে অবশ্যই ‘কনসিডারেশন’ প্রমান করতে হবে অর্থ্যাৎ কীসের ভিত্তিতে টাকা লেনদেন হয়েছিল তার লিখিত প্রমাণ থাকতে হবে।
আপিল কখন ও কীভাবে করা যায় তা জেনেছি এখন জানবো কখন রিভিশন দায়ের কোথায় করতে হবে। চেক ডিজ-অনারের মামলায় রিভিশন দায়ের করা যায়। শুধু আইনগত প্রশ্নে রিভিশন দায়ের করা যায়। এখানেও ফৌজদারী কার্যবিধির রিভিশনের বিধান প্রযোজ্য হবে। এখানে বলা হয়েছে, আইনগত প্রশ্নে রিভিশন দায়ের করা যায়। এখন কথা হলো আইনগত প্রশ্ন বলতে আমরা কী বুঝি? যেমন: ব্যাংক থেকে চেকটি অপরিশোধিত হয়ে আসার পর ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতাকে নোটিশ না দেওয়া। এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন। আবার মামলা করার কারণ আছে কি না এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন। দি নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট এ্যাক্ট-এর ১৩৮ ধারার মামলা থেকে আইনগত বিষয় উদ্ভূত হলে ফৌজধারী কার্যবিধির ৪৩৯ ধারা মতে হাইকোর্ট বিভাগে অথবা একই আইনের ৪৩৯ক ধারা মতে দায়রা আদালতে রিভিশন দায়ের করা যায়। আগে একমাত্র হাইকোর্ট বিভাগ রিভিশন ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন। ১৯৭৮ সালে Law Reforms Ordinance দ্বারা ফৌজদারী কার্যবিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে দায়রা জজকে রিভিশন ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
কত সময়ের মধ্যে রিভিশন রিভিউ দায়ের করতে হবে?:
তামাদি আইনে ফৌজদারী মামলায় রিভিশন দায়েরের সময়সীমা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের case law-এর সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হবে। উচ্চ আদালত অভিমত প্রকাশ করেন,‘ফৌজদারী আপিল মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে প্রচলিত সময়সীমাই রিভিশন মামলা দায়েরের সময়সীমা বলে গণ্য হবে।’ দি লিমিটেশন এ্যাক্ট ১৯০৮-এর ১৫৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচারিক আদালত রায় প্রদানের ৬০ দিনের মধ্যে ফৌজদারী আপিল দায়ের করতে হয়। রিভিশন দায়েরের ক্ষেত্রেও একই সময়সীমা প্রযোজ্য হবে। তার মানে বিচারিক আদালত কর্তৃক রায় প্রচারের ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশন দায়ের করতে হবে। রিভিশন নিষ্পত্তির সময়সীমা হলো-দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর-এর ৪৪২ ক (২) ধারায় বলা হয়েছে, পক্ষগণের উপর নোটিশ জারি হওয়ার তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে রিভিশন আদালত রিভিশন কার্যক্রম নিষ্পত্তি করবেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর এর ৪৩৯ক (২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো পক্ষ কর্তৃক দায়রা জজের নিকট রিভিশন দায়ের করা হলে, এই বিষয়ে দায়রা জজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। তার মানে ফৌজদারী মামলায় দ্বিতীয় রিভিশনের কোন সুযোগ নেই।
রিভিউ (জবারব)-এর বিধান এবং উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত:
সিভিল মোকদ্দমায় রিভিউ (Review) করার বিধান রয়েছে। দি কোড অব সিভিল প্রসিডিউর-এর ১১৪ ধারা এবং ৪৭ আদেশে রিভিউ করার বিধান রয়েছে। ক্রিমিনাল মামলায় রিভিউ করার কোনো বিধান নেই। দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরে রিভিউ সংক্রান্ত কোন বিধান রাখা হয়নি। তাই ক্রিমিনাল মামলায় রিভিউ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ১৩৮ ধারার চেক ডিজ-অনারের মামলা আংশিক ফৌজদারী এবং দেওয়ানি প্রকৃতির। ফলে তার আলোকে চেক ডিজ-অনারের মামলায় রিভিউ করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে Nizam Uddin Mahmood v. Abdul Hamid Bhuiyan and another [24 BLD (2004)(AD)239] মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চেক ডিজ-অনার সংক্রান্ত মামলায় রিভিউ সংক্রান্ত বিধানের অনুমতি দিয়েছেন।
পরিশেষে এ কথা বলা যায়- চেকের মামলার বিচার দ্রুত সময়ে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। মানুষের টাকাপয়সা লেনদেনকে আরও গতিশীল ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে চেকে ডিজ-অনার-এর মামলা অল্প সময়ে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা জরুরি। সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক হয়ে আদালত সংখ্যা বৃদ্ধি করাসহ প্রয়োজনে বিচারক এবং জনবল নিয়োগ দিয়ে চেকের মামলাসহ অন্যান্য মামলা নিষ্পত্তি করে মামলাজট কমাতে ভুমিকা রাখতে পারে।
মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম: কলামিস্ট ও আইন গবেষক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।