সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধ্বগতির ফলে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষের। সংসারের খরচ মেটাতে বাধ্য হয়ে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে। তবে কেউ কেউ আবার সহজ আয়ের মাধ্যম হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তিকেই মূল পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ফলে সময়ের ব্যবধানে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে অধিক আয়ের আশায় হাতিয়ার হিসেবে শিশুদের ব্যবহার করছেন মানিকগঞ্জের অনেক ভিক্ষুক।
শিশু আইন- ২০১৩ অনুসারে, কোনও ব্যক্তি যদি শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, বা শিশুকে দিয়ে ভিক্ষা করান, অথবা শিশুর হেফাজত, তত্ত্বাবধান বা দেখাশোনায় নিয়োজিত কোনও ব্যক্তি শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগদানে প্রশ্রয়দান বা প্রদান করেন, তাহলে সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। শিশুদের ভিক্ষা বন্ধে এ ধরনের কঠোর আইন থাকলেও আইনের বাস্তবায়ন না থাকায় প্রকাশ্যে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহারের ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর আগে ভিক্ষুক পুর্নবাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্পের জন্য সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একদিনের বেতনের সমপরিমান টাকা চাঁদা তুলে তহবিল গঠন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পাওয়ার পরেও এখনো সম্পন্ন হয়নি ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কমংসংস্থান কার্যক্রম। তহবিলের অল্প কিছু টাকা ভিক্ষুকদের মাঝে বিতরণ করা হলেও অধিকাংশ টাকাই এখনও ব্যাংকে পড়ে রয়েছে ।
ভিক্ষুকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়লেও এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন ভিক্ষুকদের কল্যাণে কাজ করা ব্যক্তিরা। জেলায় কি পরিমাণ ভিক্ষুক রয়েছে এবং এদের মধ্যে কতজন মানিকগঞ্জ জেলার স্থায়ী বাসিন্দা, কতজন অন্য জেলা থেকে মানিকগঞ্জে এসে ভিক্ষাবৃত্তির সাথে জড়িত রয়েছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যানও নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে।
শুক্রবার (১৮) অক্টোবর মানিকগঞ্জ শহরের উত্তর সেওতা এলাকায় জুমআ’র নামাজ শেষে একটি মসজিদের সামনে দেখা যায়, দশ-বারো জন ভিক্ষাবৃত্তি করছেন। ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই নারী। তাদের সাথে রয়েছে নানাবয়সী শিশুরাও।
উত্তর সেওতা এলাকার মতই মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড, সদর হাসপাতাল, টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (টিটিসি), ওয়্যারলেছ গেট, কালেক্টরেট জামে মসজিদ, নয়াকান্দি, দাশড়া, বান্দুটিয়া,পোররা, বেউথাসহ বিভিন্ন এলাকার মসজিদের সামনে একই চিত্র দেখা যায়। এছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিনে বাসস্ট্যান্ডের ওভার-ব্রীজ, ফুটপাতে অসংখ্য ভিক্ষুকের দেখা মিলে। সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুকের দেখা মিলে বৃহস্পতিবার।
ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে কোন কোন ভিক্ষুক বলছে, শারীরিক অক্ষমতা, অভাব-অনটন, পরিবারের অসুস্থ সদস্য, সহায় সম্বলহীন এবং পরিবারে কোনো কর্মক্ষম সদস্য না থাকা। কেউবা বলছে সন্তানরা দেখাশুনা করেনা। আবার কেউ কেউ বলছে স্বামী কোন খোঁজখবর নেয়না। আবার অনেকেই জানিয়েছেন, সন্তানরা যে টাকা আয় করে তা দিয়ে তাদেরই সংসার চলে না, তাই বাধ্য হয়েই ভিক্ষা করতে হচ্ছে তাদের।
ভিক্ষাবৃত্তির সময় শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে কেন জানতে চাইলে ভিক্ষুকরা জানান, ছোট ছোট বাচ্চাদের বাসায় কারো কাছে রেখে আসার মত লোক নেই। অনেকে আবার সাথে বাচ্চা দেখলে মায়া করে টাকা-পয়সা একটু বেশি দেয়। তাই বাচ্চাদের সাথে নিয়েই ভিক্ষা করেন তারা।
উত্তর সেওতা এলাকার ওই মসজিদের সামনে তিনটি শিশু বাচ্চাকে সাথে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির সময় আকলিমা আক্তার নামের এক ভিক্ষুকের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। আকলিমা আক্তার জানান, তার তিন বাচ্চার মধ্যে সবচেয়ে ছোট সন্তানের বয়স দেড় বছর, মেজো সন্তানের চার বছর এবং বড়টির বয়স সাত বছর। ঘরে স্বামী অসুস্থ থাকায় শিশু বাচ্চাদের সাথে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করেন তিনি।
চার বছর বয়সী আরেক শিশুকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করতে আসা মুক্তা আক্তার নামের আরেক ভিক্ষুক জানান, অন্যের বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করার পাশাপাশি ভিক্ষা করেন তিনি। ঝিয়ের কাজ করে যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলেনা। তাই বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে হচ্ছে।
ননজু নামের আরেক নারী ভিক্ষুকের সাথেও দুইটি শিশুকে দেখা যায়। শিশুদের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিশু দুইটি আমার বাচ্চা। একজনের বয়স চার বছর এবং আরেকটির বয়স দশ বছর। শিশুদের নিয়ে এভাবে ভিক্ষাবৃত্তির ফলে তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে কি’না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ভিক্ষা করে খাই। আমাদের আবার ভবিষ্যৎ কীসের?
মানিকগঞ্জ শহরের শহীদ রফিক সড়কে ভিক্ষাবৃত্তির সময় লাকী নামের এক নারী জানান, তাদের স্থায় বাড়ি নাটোরে। মানিকগঞ্জ পৌরসভার জয়রা এলাকায় ভাড়া থাকেন তিনি। স্বামী নেই, ভিক্ষাবৃত্তি করে কোনরকমে তিন সন্তানকে নিয়ে জীবনযাপন করেন তিনি।
মানিকগঞ্জের বিভিন্ন দোকানী ও ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিনই অনেক ভিক্ষুককে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। ভিক্ষুকদের অধিকাংশই নারী। দোকান খোলার পর থেকে রাত পর্যন্ত ভিক্ষুকেরা দলবেধে দোকানে দোকানে এসে ভিক্ষা করে। তবে বৃহস্পতিবার হলে ভিক্ষুকের সংখ্যা অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। আর শুক্রবারে এসব ভিক্ষুকরা বিভিন্ন মসজিদের সামনে ভীড় করেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে মানিকগঞ্জ জেলা জজ আদালতের আইনজীবী খন্দকার সুজন হোসেন বলেন, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করানো কোনভাবেই কাম্য নয়। প্রশাসনের উচিৎ এই কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরকে আইনের আওতায় আনা। আর শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদেরকে প্রশাসনিক সহায়তায় আয়-রোজগারের জন্য স্থায়ী কোন ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন অ্যাড. সুজন।
এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আব্দুল বাতেন বলেন, ভিক্ষুক পুনর্বাসনের জন্য কয়েকবছর আগে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ ভিক্ষুকদের তালিকা করে কিছু কিছু ভিক্ষুকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল। আর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলের অর্থ ও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থের বিষয়টি ডিসি অফিসের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। তবে শিশু ভিক্ষুকের বিষয়টি তদারকি করে এবং তালিকা প্রস্তত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ইতোমধ্যে আমরা জেলায় ভিক্ষুকের সংখ্যা কমিয়ে তাদেরকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তির বিষয়টি নিয়ে সমাজসেবা অফিসারের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।