সোহরাব আলম : বিশ্বের বৃহত্তম জঙ্গল দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নতুন প্রজাতির দানবাকৃতির অ্যানাকোন্ডা সাপের সন্ধান পেয়েছে অস্ট্রেলীয় জীববিজ্ঞানীদের একটি দল। দৈর্ঘ্য ও ওজনের বিচারে এটি বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম সাপ। স্বশাসিত তাইওয়ান দ্বীপের সঙ্গে আমাজন জঙ্গলের সেই সাপের সম্পর্ক নাই। প্রতীকী মিল রয়েছে বটে। কারণ,গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এই দ্বীপকে ভয়ানকভাবে চেপে ধরে রাখার রণকৌশল নিয়েছে। এই চাপে কার্যত হাঁসফাঁস অবস্থা সরকারিভাবে চীন প্রজাতন্ত্র তাইওয়ানের।
বলা ভালো, অ্যানাকোন্ডা একটি নির্বিষ প্রজাতির সাপ। তবে এই সাপের সবচেয়ে বড় অস্ত্র এর শক্তিশালী দেহ ও চাপ। অ্যানাকোন্ডা শিকার ধরার পর প্রথমে কয়েলের মতো জড়িয়ে ধরে সেটিকে, তারপর দেয় ভয়াবহ শক্তিশালী চাপ। সেই চাপেই শিকারের হাড়-গোড় ভেঙে অভ্যন্তরীণ সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। তারপর শিকারকে গিলে খায় সাপটি। চীন এভাবে তাইওয়ানকে চেপে ধরতে চাইছে। সাম্প্রতিক তথ্য‑উপাত্ত তুলে ধরে তাইওয়ানের এক নৌ‑কমান্ডার এমন আশঙ্কাই প্রকাশ করলেন।
আমাজনে নতুন সন্ধান পাওয়া অ্যানাকোন্ডার নারী সাপদের গড় দৈর্ঘ্য ২০ ফুট বা তার কিছু বেশি। ওজন ১৫০ কেজি থেকে ১৮০ কেজি। পুরুষ সাপ দৈর্ঘ্যে ও ওজনে কিছুটা পিছিয়ে। তাইওয়ানের আয়তন ৩৫ হাজার ৮০৮ বর্গকিলোমিটার। আর চীনের আয়তন ৯৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। এর সাথে সামরিক ও বাণিজ্যিক শক্তিও আকাশ‑পাতাল। ফলে তাইওয়ানের পাশে বৃহৎ আয়তনের ও ব্যাপক সামরিক শক্তির অধিকারী চীন যেন সাক্ষাৎ অ্যানাকোন্ডা। যদিও শিকারে পরিণত হওয়ার ভয়ে ভীত দ্বীপটির কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশে সতর্ক।
তাইওয়ান দ্বীপকে নিজের বিদ্রোহী অঞ্চল বলেই বিবেচনা করে আসছে চীন। তাইপের সঙ্গে বহির্বিশ্বের কারও কূটনৈতিক যোগাযোগকে স্বীকৃতি দেয় না বেইজিং। চীন সব সময়ই চূড়ান্ত আক্রমণের রাস্তায় না গিয়ে একটি অবস্থানে থেকে তাইওয়ানকে হুমকি-ধমকি দিয়ে যায়। এটি মূলত কোনো গুলি খরচ না করে চাপ দিয়ে তাইওয়ানের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার কৌশল।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে চীনের অপছন্দের তালিকায় রয়েছেন– এটি কোনো গোপন বিষয় নয়। চীনা কর্তৃপক্ষ তাঁকে একগুঁয়ে, দ্বন্দ্বে উন্মুখ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে অভিহিত করে। সম্ভবত তাইওয়ান প্রণালীতে যুদ্ধ উসকে দিতে চাচ্ছে চীন।
চলতি বছরের মে মাসে লাই চিং-তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) তাইওয়ানের চারপাশে আরও বিমান ও নৌযান মোতায়েন করে সংঘর্ষের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। তাইওয়ানের নৌবাহিনীর কমান্ডার অ্যাডমিরাল তাং হুয়ার ভাষ্য, ‘পিএলএ তাইওয়ান দ্বীপ রাষ্ট্রটি দখলের জন্য এক “অ্যানাকোন্ডা রণকৌশল” ব্যবহার করছে।’
সম্প্রতি ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যাডমিরাল তাং হুয়া সতর্ক করেন, চীনা বাহিনী ‘ধীরে ধীরে, তবে নিশ্চিতভাবে’ তাঁর দেশের চারপাশে উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। এই নৌ কমান্ডার বলেন, ‘তারা (চীন) যেকোনো সময় তাইওয়ানকে অবরোধ করতে প্রস্তুত।’ তাঁর এই উদ্বেগের স্বপক্ষে কিছু তথ্য‑উপাত্তও মিলছে।
তাইওয়ান প্রণালীর মাঝখানে পৃথককারী সীমানার মধ্যরেখাজুড়ে পিএলএর যুদ্ধবিমান ওড়ানোর সংখ্যা পাঁচগুণেরও বেশি বেড়েছে। গেল জানুয়ারিতে যেখানে ৩৬ বার যুদ্ধবিমান ওড়ানো হয়েছে, আগস্টে তা করা হয়েছে ১৯৩ বার। তাইওয়ানের আশপাশে চলাচলকারী পিএলএর জাহাজের সংখ্যাও ক্রমাগত বেড়েছে। জানুয়ারিতে ১৪২টি জাহাজ চলাচল করেছিল। আগস্টে তা দ্বিগুণ হয়ে ২৮২-তে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, এই নৌযানগুলো তাইওয়ানের কাছাকাছি; অর্থাৎ, তার সংলগ্ন অঞ্চল বরাবর বা এর উপকূল থেকে ২৪ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। তাইওয়ানের নৌ-কমান্ডারের মতে, তারা (চীনের নৌবাহিনী) টানা কয়েক দিনের জন্য কয়েক ঘণ্টা করে টহল দিচ্ছে।
এ ধরনের কর্মকাণ্ড তাইওয়ান সীমান্তে চীনের কার্যক্রমের তুলনামূলক নতুন ধারা। ২০২২ সালের আগস্ট মাস অবধি পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) তাইওয়ানের দক্ষিণ ও পশ্চিমে এবং ফিলিপাইন থেকে দ্বীপটিকে আলাদা করা বাশি চ্যানেলের চারপাশে বেশির ভাগ মহড়া চালিয়েছিল। তাইওয়ানের দুর্গম পূর্ব উপকূল ও পাহাড়ের নিচে নির্মিত উড়োজাহাজ নির্মাণ কারখানায় চীনের পৌঁছানো কঠিন হবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সেই বছর উচ্চপদস্থ আমেরিকান কর্মকর্তা (মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের তৎকালীন স্পিকার) ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর তা বদলে যায়। এই সফরটি চীনকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এরপরই পিএলএ তাইওয়ানের পূর্বাঞ্চলের ওপর এক ধরনের ‘মক’ অবরোধ আরোপ করে। এর মধ্য দিয়ে সংকেত দেওয়া হয় যে, অঞ্চলটি আর নিরাপদ নয়। এখন পিএলএ সেখানে টহল নিয়মিত করেছে এবং সমুদ্র ও আকাশপথে দ্বীপটিকে ঘিরে রেখেছে। অন্যদিকে তাইওয়ান ও জাপানের মধ্যকার ইয়োনাগুনি চ্যানেলের মাধ্যমে নৌবাহিনীর ট্রানজিটের সংখ্যাও বেড়েছে।
দ্য ইকোনমিস্টকে অ্যাডমিরাল তাং জানান, তাইওয়ানের খুব কম লোকই জানে পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) টহল কতটা কাছাকাছি ও নিয়মিত হয়ে আসছে। ২০২০ সাল থেকে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় চীনা যুদ্ধবিমানগুলোর অবস্থানের মানচিত্রসহ দ্বীপের চারপাশে বৈমানিকদের কার্যকলাপের দৈনিক হালনাগাদ তথ্য (আপডেট) প্রকাশ করেছে। ২০২২ সালে ‘তাইওয়ানের চারপাশে’ পিএলএ পরিচালিত নৌযানের সংখ্যার হালনাগাদ তথ্যও যোগ করে তারা। তবে কী ধরনের জাহাজ, কোথায় যাবে বা কতক্ষণ যাবে,তার কিছুই এই আপডেটে উল্লেখ করা হয়নি। অ্যাডমিরাল তাং বলেন, ‘[তাইওয়ান] সরকার সম্ভবত এই ভেবে উদ্বিগ্ন, খুব বেশি তথ্যের প্রকাশ তাইওয়ানের জনসাধারণের মনোবল বা অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’
পিএলএর বর্ধিত টহল তাইওয়ানের নৌবাহিনীর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। কারণ, তাইওয়ানের তুলনায় চীনের রণতরীর (ফ্রিগেট) সংখ্যা দ্বিগুণ ও দশগুণ যুদ্ধজাহাজ (ডেস্ট্রয়ার) রয়েছে। তাইওয়ানের দুই প্রতিরক্ষা গবেষক চেং-কুন মা ও ত্রিস্তান তানের মতে, তাইওয়ানকে প্রায়শই চীনের টহলের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তার ২৫ থেকে ৫০ ভাগ যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে হয়।
অ্যাডমিরাল তাং বলেন, ‘তারা (চীন) কঠিন থেকে কঠিনতর চাপ দিচ্ছে। তারা (আমাদের) ক্লান্ত করে তোলার চেষ্টা করছে।’ এক সরকারি নিরীক্ষায় দেখা গেছে, তাইওয়ানের প্রধান যুদ্ধজাহাজের অর্ধেকেরও বেশি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণে রাখার কারণে মহড়া প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে।
পিএলএ নৌবাহিনী দ্বীপ রাষ্ট্রটির কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে তাইওয়ান সংঘর্ষ এড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করছে। অ্যাডমিরাল তাং বলেন, ‘পিএলএ তাইওয়ানকে ভুল করতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে এবং অবরোধ শুরুর অজুহাত খুঁজছে। এই কারণেই তাইওয়ানের সামরিক নেতারা চলতি বছর চীনের সঙ্গে বিরোধে জড়িত থাকার বিষয়ে নতুন নিয়ম জারি করেছে, ‘আমরা আমাদের ছেলেদের সংযত করি, উসকানি দিই না।’ এটি আত্মরক্ষায় শক্তির নৈতিক ও আইনগত ব্যবহারকে সংজ্ঞায়িত করে।
এমনকি তাইওয়ানের সশস্ত্র বাহিনী সংযমের চর্চা করলেও দেশটির নেতারা অবরোধের ক্ষেত্রে কীভাবে সমুদ্রে চলাচলের পথ উন্মুক্ত রাখা যায়, সে বিষয়ে মিত্রদের সঙ্গে কাজ করছে। তাইওয়ান চীনের চাপ প্রতিহত করতে আন্তর্জাতিক সাহায্যও চাইছে। জাপানের নৌবাহিনী অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও জার্মানির মতোই সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো তাইওয়ান প্রণালীর মধ্য দিয়ে একটি ট্রানজিট মহড়া চালিয়েছে। আমেরিকার নৌবাহিনী বছরে কয়েকবার এর মধ্য দিয়ে যায়। এই মহড়ার মধ্য দিয়ে চীনকে একটি সংকেত দেওয়া হয় যে, প্রণালীটি আন্তর্জাতিক অঞ্চল। চীনা কর্তৃপক্ষ এর প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু তারা ‘অ্যানাকোন্ডা রণকৌশলে’ চাপ দেওয়ার ব্যাপারে কোনো শৈথিল্যের লক্ষ্যণ দেখায়নি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, তাইওয়ান গত মাসে রেকর্ডসংখ্যক চীনা বিমান তার আকাশসীমা অতিক্রম করেছে বলে অভিযোগ করেছে। জবাবে বেইজিংয়ের ভাষ্য ছিল, তাইওয়ান ও চীনকে পৃথককারী কোনো রেখার অস্তিত্ব নেই।
প্রকৃতপক্ষে হুমকি-ধমকির মধ্য দিয়ে তাইওয়ানকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে চীন। বিপুল সামরিক শক্তিধর বৃহৎ প্রতিবেশীকে তাইওয়ানের কাছে ‘অ্যানাকোন্ডা’ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। সূত্র : ইনডিপেনডেন্ট টিভি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।