নাসির উদ্দিন রকি : ‘দালাল না ধরে নিজে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর ভুল ধরে কর্মকর্তারা সেটি গ্রহণ করেন না। আবার সংশোধন করে জমা দিলেও আরেকটি ভুল ধরা হয়। এভাবে ভুল শুধরে আবেদন জমা দিতে দিনের পর দিন ছোটাছুটি করতে হয়। তবে দালাল ধরে আবেদন করলে আবেদনপত্রে বিশেষ চিহ্ন দেওয়া থাকে। তখন ভুল ধরা হয় না। এতে একদিনেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ছবি তোলার সুযোগসহ দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়া যায়।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা কার্যালয়ে গিয়ে এমন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন নগরীর মোহরা রাস্তারমাথা এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল হোসেন। শুধু রুবেল নন, দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে গেলে এমন বিড়ম্বনায় পড়ার কথা জানিয়েছেন অন্তত ১০ জন ভুক্তভোগী।
তারা বলেছেন, বিভাগীয় এই পাসপোর্ট কার্যালয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন আবেদনকারীরা। প্রতিদিন গড়ে হাজারো ব্যক্তি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ দালালের শরণাপন্ন হন। এতে সরকারি ফির অতিরিক্ত খরচ হয় দুই হাজার টাকা। কোনও জটিলতা থাকলে পাসপোর্ট পেতে আরও বেশি টাকা দিতে হয়। দালাল না ধরে নিজে পাসপোর্টের আবেদন করলে জমা দেওয়া এবং ডেলিভারি বুথে হয়রানির শিকার হতে হয়। হয়রানির অভিযোগ জানাতে কর্মকর্তাদেরও সাক্ষাৎও পান না তারা।
রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দিই। সকাল ১০টায় আবেদনপত্র নিয়ে লাইনে দাঁড়াই। দুপুর ২টার দিকে আবেদন জমা দিয়ে ছবি তোলাসহ বাকি কাজ সম্পন্ন করেছি। একইভাবে পাসপোর্ট ডেলিভারি নেওয়ার সময় সকাল ৯টায় লাইনে দাঁড়াই। বিকাল ৩টায় পাসপোর্ট হাতে পাই। অর্থাৎ পাসপোর্টের আবেদন জমা দেওয়া এবং ডেলিভারি নেওয়ার সময়ে দিনের অধিকাংশ সময় চলে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আবেদন জমা দেওয়ার দিন সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ও দালালরা কিছুক্ষণ পরপর এসে বলেন, কষ্ট করে দীর্ঘ সময় লাইনে না দাঁড়িয়ে আমাদের দেন। দ্রুত কাজ হয়ে যাবে। ডেলিভারি দ্রুত পাবেন। এ জন্য প্রথমে দুই হাজার টাকা চাওয়া হয়। পরে এক হাজার টাকা চান। আমি তখন তাদের বলেছি, কষ্ট হলেও নিজেই জমা দেবো। তবে অনেকে তাদের মাধ্যমে পাসপোর্ট করিয়েছেন।’
নগরীর মোহরা রাস্তারমাথা এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল বলেন, ‘দালাল ছাড়া এখানে কোনও কাজ হয় না। আবেদন জমা দিতে দালালদের সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা দিতে হয়। তাদের মাধ্যমে গেলে অফিসের কর্মকর্তারা আবেদনপত্রে বিশেষ চিহ্ন দেখে বুঝতে পারেন। কারণ আবেদনে বিশেষ সংকেত দেওয়া থাকে। তখন দ্রুত কাজ হয়। অন্যথায় নানা ভুল ধরেন। ফরম নিতে গড়িমসি করেন। এতে হয়রানির শিকার হতে হয়।’
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে বিভাগীয় এই পাসপোর্ট কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ‘প্রবেশপথে লোকজনের জটলা। এখানে এলেই কে কোন কারণে এসেছেন, তা জানতে চান দালালরা। তারা আবেদনকারীদের বলছেন, দ্রুত সময়ে পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করতে পারবেন। এ জন্য এক থেকে দুই হাজার টাকা চান।
পাসপোর্ট কার্যালয়ের পাশের দুই জন দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গেটের সামনে বসে থাকা ব্যক্তিরা দালাল। প্রতিদিন সেবাপ্রার্থীদের নানা কাজে সহায়তা করে অর্থ নেন। আগে এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান জোরদার ছিল। তখন কার্যালয়ের আশপাশে আসতো না তারা। নতুন পরিচালক যোগদানের পর দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এতে পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তিরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
গেট থেকে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেলো, কার্যালয়ে আসা সেবাপ্রার্থীদের দুটি দীর্ঘ লাইন। এর মধ্যে একটি লাইনের লোকজন পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দেবেন। অপর লাইনের লোকজন পাসপোর্ট ডেলিভারি নেবেন। এর মধ্যে ডেলিভারি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন মো. নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি।
তিনি বলেন, ‘পাসপোর্ট ডেলিভারি নেওয়ার জন্য মঙ্গলবার সকাল ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়েছি। এখন দুপুর ১২টা। এখনও আমার সামনে অর্ধশতাধিক লোক দাঁড়ানো। একটু পরপর পুলিশ সদস্য ও দালালরা এসে বলছেন, ৫০০ টাকা দেন, দ্রুত পাসপোর্ট এনে দেবো। এর আগে সকাল থেকে অনেকে টাকা দিয়ে আগেভাগে পাসপোর্ট নিয়ে গেছেন। ফলে আমরা যারা টাকা দিইনি, তারা পেছনে পড়েই আছি।’
এসব অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করার জন্য পরিচালকের দফতরে গেলে তিনি দেখা দেন না উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিভাগীয় পরিচালকের তদারকির অভাবে কার্যালয়ের কর্মকর্তারা অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন। হয়তো তিনিও এই কাজে জড়িত, এ জন্য অভিযোগ দিতে গেলেও সাক্ষাৎ দিচ্ছেন না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট কার্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এই কার্যালয় থেকে ১০ লাখ ১৬ হাজার ৫৩৪টি মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি), দুই লাখ ৭৬ হাজার ৫৪৬টি ই-পাসপোর্ট ও ৬১ হাজার ৬৮৪টি মেশিন রিডেবল ভিসা ইস্যু করা হয়। কার্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর সময় ৩১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। একযুগ পরও জনবল বাড়েনি বরং কমেছে। আগে যেখানে ৩১ জন ছিলেন, বর্তমানে আছেন ২৮ জন।
কার্যালয়ে জনবল কম ও আবেদনকারী বেশি হওয়ায় দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে বলে জানালেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা কার্যালয়ের পরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এখানে আমার কিছুই করার নেই। আবেদনকারী বেশি হওয়ায় এটি সমাধান করা যাচ্ছে না।’
দালাল না ধরলে পদে পদে হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে লাইনে দাঁড়ানো কারও পাসপোর্টের আবেদন জমা কিংবা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা আমার জানা নেই। এ ধরনের অভিযোগ কেউ করেননি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো।’
আবেদনপত্রে অযথা ভুল ধরার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যাদের আবেদনে ত্রুটি দেখিয়ে ফেরত দেওয়া হয়েছে, তা টাকার বিনিময়ে নয় বরং ত্রুটি সংশোধন করার পরই আবেদন জমা নেওয়া হয়।’ সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।