আজকের এই উন্মত্ত গতির জীবনে, যান্ত্রিকতার চাকায় পিষ্ট হতে বসেছে আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের বিশ্বাসের ভিত। এমন এক সময়ে, একটি শিশুর কচি হাত যখন প্রথমবারের মতো স্পর্শ করে পবিত্র কোরআনের মাজিদের পাতাগুলো, তখন শুধু একটি বই স্পর্শ করে না – স্পর্শ করে ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং এক অতুলনীয় আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার। সেই স্পর্শে কাঁপে হৃদয়, চোখে ভাসে অশ্রুর বিন্দু। কেননা, এটিই তো সেই মুহূর্ত, যখন শিশুর অন্তরে ঈমানের প্রথম আলোকরশ্মি প্রবেশ করে, জীবনপথের দিশা হয়ে ওঠে মহান আল্লাহর বাণী। ছোটদের কোরআন শিক্ষা শুধু আরবি বর্ণমালা বা আয়াত মুখস্থ করানো নয়; এটি তাদের হৃদয়ে ঈমানের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন, চরিত্র গঠন এবং সত্যিকারের মুসলমান হিসেবে বেড়ে ওঠার অপরিহার্য সূচনা। এই শিক্ষার সূচনাই যদি হয় সুন্দর, সুপরিকল্পিত এবং হৃদয়গ্রাহী, তবে তা সারাজীবনের জন্য একটি মজবুত, আলোকিত পথের নিশানা হয়ে থাকে।
শিশুদের কোরআন শিক্ষার প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ: ভবিষ্যত প্রজন্মের আলোকবর্তিকা
১. কেন এত জরুরি? শৈশবেই হৃদয়ে কোরআনের বীজ বপন
শিশুমন কাদামাটির মতো। যেমন ইচ্ছে গড়ে নেওয়া যায়। এই কোমল, সংবেদনশীল ও গ্রহণযোগ্যতার চরম সময়ে কোরআনের শিক্ষা প্রবেশ করানো মানে তাদের আত্মার গভীরে অমূল্য সম্পদ সঞ্চয় করা। গবেষণা বারবারই প্রমাণ করেছে যে শৈশবকালীন শেখা (Early Childhood Learning) সবচেয়ে স্থায়ী ও গভীর প্রভাব ফেলে। শিশুর মস্তিষ্ক তখন নিউরোপ্লাস্টিসিটির (Neuroplasticity) শীর্ষে থাকে, নতুন তথ্য, ভাষা ও মূল্যবোধ গ্রহণে অত্যন্ত সক্ষম। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যেসব শিশু শৈশবেই কোরআন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ পায়, তাদের মধ্যে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা এবং আত্মবিশ্বাসের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এটি শুধু ধর্মীয় জ্ঞানই দেয় না, বরং:
- আত্মিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা: কোরআনের বাণী শিশুর মনে প্রশান্তি ও আল্লাহর উপর ভরসার অনুভূতি জাগায়।
- নৈতিক কম্পাস গঠন: সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে শেখায়, চরিত্র গঠনের মজবুত ভিত্তি তৈরি করে। হাদিসে এসেছে, “তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে নিজে কোরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।” (সহীহ বুখারী)
- ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি: আরবি ভাষার মৌলিক ধারণা, উচ্চারণ (তাজবিদ) শেখার মাধ্যমে মস্তিষ্কের ভাষা কেন্দ্রের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।
- সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সংযোগ: ইসলামের ইতিহাস, নবীদের কাহিনী, মুসলিম সভ্যতার গৌরবময় অধ্যায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
- অনুশাসন ও নিয়মানুবর্তিতা: নিয়মিত তেলাওয়াত ও পাঠের মাধ্যমে শিশুতে শৃঙ্খলা, ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের গুণাবলী বিকশিত হয়।
২. কখন শুরু করবেন? সোনালি সময় হাতছাড়া করবেন না
একটি বহুল প্রচলিত প্রশ্ন: “আমার সন্তানের বয়স এখন মাত্র ৩ বছর। কোরআন শেখানোর জন্য কি খুব ছোট?” উত্তরটি হলো: না, একেবারেই না! বরং এটিই আদর্শ সময় প্রাথমিক পরিচয় দেওয়ার জন্য। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (IER) শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞ ড. ফারহানা ইয়াসমিন, তার গবেষণায় উল্লেখ করেন, ৩-৫ বছর বয়সটি শিশুর ভাষা, সংবেদনশীলতা ও অনুকরণের ক্ষেত্রে “স্পঞ্জের মতো শোষণ ক্ষমতার” সময়। এই সময়ে:
৩-৫ বছর (প্রাথমিক পরিচিতি):
- কোরআনের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তুলুন: বাসায় কোরআন তেলাওয়াতের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করুন। নিজে নিয়মিত তেলাওয়াত করুন, শিশুকে কাছে বসতে দিন। তার সামনে কোরআনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন (চুমু খাওয়া, মাথায় ঠেকানো ইত্যাদি)।
- গল্প বলুন: নবীদের কাহিনী, সৃষ্টির নিদর্শন সম্পর্কে সহজ-সরল, আকর্ষণীয় গল্প বলুন। রঙিন ছবির বই ব্যবহার করুন। গল্পের মাধ্যমে আল্লাহর মহিমা, ভালোবাসা ও দয়া সম্পর্কে ধারণা দিন।
- সহজ দোয়া ও ছোট ছোট সুরা: “বিসমিল্লাহ”, “আলহামদুলিল্লাহ”, “মাশাল্লাহ”, “সুবহানাল্লাহ”, সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস ইত্যাদি মিষ্টি সুরে শেখান। খেলার ছলে বারবার বলান।
- ইতিবাচক সম্পর্ক: এই সময়ে কোরআনকে শিশুর জন্য আনন্দ, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কখনই জোরাজুরি বা ভয় দেখানো যাবে না।
৬-৮ বছর (মৌলিক শিক্ষার সূচনা):
- আরবি বর্ণমালা: ধীরে ধীরে, আনন্দদায়ক উপায়ে আরবি হরফ (ا, ب, ت…) চেনানো শুরু করুন। রঙিন ফ্লাশ কার্ড, ম্যাগনেটিক লেটার্স, ইন্টারেক্টিভ অ্যাপস (যেমন “নূরানী পদ্ধতি” ভিত্তিক অ্যাপগুলি) ব্যবহার করুন। প্রতিটি অক্ষর শেখানোর সময় তার সঠিক উচ্চারণ (মাখরাজ) ও স্বর (ফাতহা, কাসরা, দম্মা) শেখাতে হবে। এই ভিত্তি যত মজবুত হবে, ভবিষ্যত তেলাওয়াত তত নির্ভুল হবে।
- সংক্ষিপ্ত সুরা মুখস্থ: বয়স অনুপাতে ছোট ছোট সুরা (যেমন: নাস, ফালাক, কাউসার) অর্থসহ বুঝিয়ে মুখস্থ করান। অর্থ না বুঝলে মুখস্থ করা অর্থহীন। সহজ বাংলায় ব্যাখ্যা করুন।
- ওজুর প্রাথমিক ধারণা: নামাজের আগে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব ও সহজভাবে ওজু করার পদ্ধতি শেখানো শুরু করুন।
- নিয়মিত রুটিন: প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য হলেও (১০-১৫ মিনিট) নিয়মিত অনুশীলনের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- ৯ বছর ও তার উপরে (নির্ভুল তেলাওয়াত ও অর্থবোধের দিকে):
- তাজবিদের উপর জোর: উচ্চারণের সূক্ষ্মতা (নুন ও মিমের গুনন, মাদ্দ, ইখফা ইত্যাদি) শেখানোর উপর গুরুত্ব দিন। একজন যোগ্য ও সুরেলা কণ্ঠের শিক্ষক/শিক্ষিকার সন্ধান করুন।
- অর্থ ও তাফসীরের সাথে পরিচয়: শেখা সুরাগুলোর অর্থ, প্রাসঙ্গিকতা এবং সহজ তাফসীর (ব্যাখ্যা) আলোচনা করুন। প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করুন। এতে কোরআনের বাণী তার জীবনের সাথে সম্পর্কিত হবে।
- নামাজের গুরুত্ব: এই বয়সে নামাজের ফরজিয়ত চলে আসে। কোরআনের সাথে নামাজের গভীর সম্পর্ক বোঝান। সহিহভাবে নামাজ আদায় করা শেখান।
- আচরণে প্রতিফলন: কোরআনের শিক্ষা (সত্য বলা, সদাচরণ, ধৈর্য ধরা, মাতা-পিতার সম্মান করা) দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করতে হয়, তার দৃষ্টান্ত নিজের আচরণে ও আলোচনায় তুলে ধরুন।
৩. কিভাবে শেখাবেন? আনন্দ ও ভালোবাসার মাধ্যম হোক শিক্ষা
শিশুদের কোরআন শিক্ষার সাফল্যের চাবিকাঠি হলো পদ্ধতি। ভয়, জোরাজুরি বা শাস্তি দিয়ে কখনও স্থায়ী ভালোবাসা বা জ্ঞান অর্জন করা যায় না। বরং তা ধর্মের প্রতি অনীহা ও দূরত্ব তৈরি করতে পারে। মনে রাখবেন, লক্ষ্য শুধু মুখস্থ করানো নয়, হৃদয়ে স্থান করে দেওয়া।
আনন্দদায়ক পরিবেশ তৈরি করুন:
- খেলার ছলে শেখা: বর্ণ শেখার জন্য মেমোরি গেম, বর্ণ পাজল, গান/ছড়া তৈরি করুন। “আলিফের সাথে আনারস, বা এর সাথে আম…” – এমন ছন্দময় পদ্ধতি।
- স্টিকার ও পুরষ্কার: ছোট ছোট অর্জনের জন্য প্রশংসা করুন, স্টিকার দিন, মাঝে মাঝে ছোট উপহার দিন (বই, শিক্ষামূলক খেলনা)। আর্থিক পুরষ্কার এড়িয়ে চলুন।
- ইতিবাচক শক্তিবৃদ্ধি: ভুল করলে ধৈর্য ধরে শুধরে দিন, কঠোর সমালোচনা করবেন না। “বাহ! চেষ্টা করছিস, এটাই বড় কথা। এবার এভাবে বলো…” – এমন উৎসাহ দিন।
- সৃজনশীলতা: ছবি আঁকা (কিবলা, মসজিদ, নবীদের কাহিনী), গল্প বলা, রোল প্লে (নামাজ আদায় করা) এর মাধ্যমে শেখান।
রোল মডেল হোন: আপনি নিজে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করুন, এর শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করুন। শিশুরা যা দেখে, তা-ই শেখে। আপনার কোরআনের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাই তার জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
নিয়মিততা ও অল্প সময়: প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি ছোট সময় বরাদ্দ করুন (যেমন: নামাজের পর ১০ মিনিট)। দীর্ঘ সময় ধরে একটানা বসিয়ে রাখার চেয়ে অল্প সময়ে নিয়মিত অনুশীলন অনেক বেশি কার্যকর। শিশুর মনোযোগের সীমা মেনে চলুন।
উপযুক্ত শিক্ষা উপকরণ নির্বাচন:
- রঙিন ও আকর্ষণীয় বই: বড় বড় অক্ষর, সুন্দর ইলাস্ট্রেশন সমৃদ্ধ বই বেছে নিন। বাংলাদেশের বাজারে “নূরানী কায়দা”, “ফাতহুল কোরআন” ইত্যাদি জনপ্রিয়।
- অডিও-ভিজুয়াল এইড: কোরআনের সুরেলা তেলাওয়াত (শায়খ মিশারি রশিদ, শায়খ সুদাইস ইত্যাদি), ইসলামিক কার্টুন (যেমন: নাসিহা টুনস, যামজাম কিডস), ইন্টারেক্টিভ লার্নিং অ্যাপস (যেমন: “Quran Kids”, “Bayyinah Kids“, “আয়নামারী” – যদিও বাংলা কনটেন্ট সীমিত) ব্যবহার করুন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ওয়েবসাইটেও কিছু শিশুতোষ রিসোর্স পাওয়া যেতে পারে।
- প্রকৃতির পাঠ: ফুল, পাখি, আকাশ, বৃষ্টি দেখিয়ে আল্লাহর সৃষ্টিরাজির বিস্ময় ও কোরআনে এর উল্লেখের কথা বলুন (যেমন: সুরা আন-নাহলের মৌমাছির কথা)।
- যোগ্য ও ধৈর্যশীল শিক্ষকের সন্ধান: বাড়িতে শেখানোর পাশাপাশি বা পরে, মসজিদের হেফজ স্কুল বা বাসায় প্রাইভেট শিক্ষক রাখার প্রয়োজন হতে পারে। শিক্ষক/শিক্ষিকা নির্বাচনে সতর্ক হোন:
- তার উচ্চারণ (তাজবিদ) যেন নির্ভুল হয়।
- শিশুদের সাথে তার আচরণ কেমন? ধৈর্যশীল, স্নেহপরায়ণ ও উৎসাহদায়ক কি?
- শেখানোর পদ্ধতি আনন্দদায়ক ও কার্যকর কি?
- শিশুর মানসিকতা ও অগ্রগতি বুঝতে পারেন কি?
৪. চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা: ধৈর্য্য ও বুদ্ধিমত্তার সাথে
- মনোযোগের অভাব: শিশুরা দ্রুত বিরক্ত হয়। পদ্ধতি বদলান, খেলার ছলে আনুন, সময় কমিয়ে দিন। শেখার জায়গা যেন ঝকঝকে ও বিক্ষেপমুক্ত হয়।
- ভুল উচ্চারণ: ধৈর্য ধরে বারবার সঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। নিজে বলুন, শিশুকে বলতে বলুন। রেকর্ড করে শুনিয়ে ভুল ধরতে সাহায্য করুন। উচ্চারণের জন্য মুখের মাংসপেশীর ব্যবহার দেখিয়ে দিন।
- অনীহা বা অনাগ্রহ: জোর করবেন না। কারণ খুঁজে বের করুন। হয়তো পদ্ধতি আনন্দদায়ক নয়, বা বোঝার কষ্ট হচ্ছে, বা অন্য কোন চাপ অনুভব করছে। আলোচনা করুন। কোরআনের সৌন্দর্য ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গল্প করুন। তার প্রিয় কোন নবীর কাহিনী বলুন।
- সময় ব্যবস্থাপনা: স্কুল, পড়ালেখা, খেলাধুলার পাশাপাশি কোরআনের সময় বের করা কঠিন। অগ্রাধিকার নির্ধারণ করুন। সকালে উঠে ফজরের নামাজের পর অথবা রাতে ঘুমানোর আগে ১৫-২০ মিনিট স্থায়ী সময় বরাদ্দ করুন। গাড়িতে চলার পথে অডিও তেলাওয়াত শোনানো যেতে পারে।
- ডিজিটাল ডিস্ট্রাকশন: টিভি, মোবাইল, ট্যাবের আকর্ষণে শিশুরা সহজেই বিচ্ছিন্ন হয়। শেখার সময় এই ডিভাইসগুলো দূরে রাখুন। তবে ইসলামিক শিক্ষামূলক অ্যাপস বা ভিডিও কনটেন্ট ব্যবহার করে সেগুলোকেই শেখার মাধ্যম বানানো যায়।
৫. অভিভাবকদের ভূমিকা: সহযাত্রী হোন, শাসক নন
আপনিই আপনার সন্তানের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক। আপনার ভূমিকা অপরিসীম:
- সহযোগিতা ও উৎসাহ: প্রতিদিন তার অগ্রগতি দেখুন, ছোট সাফল্যে আনন্দ প্রকাশ করুন। পড়ার সময় পাশে বসে থাকুন (শুধু তদারকি নয়, অংশগ্রহণ করুন)।
- প্রার্থনা ও দোয়া: আপনার সন্তান যেন কোরআনের হাফেজ ও আমলকারী হয়, সেই দোয়া নিয়মিত করুন। দোয়া কবুলের বিশেষ সময়গুলো (সিজদায়, তাহাজ্জুদে, জুমার দিন) কাজে লাগান।
- প্রকৃত উদাহরণ: নিজে কোরআন পড়ুন, এর আদর্শ মেনে চলুন। শিশু দেখবে এবং শিখবে।
- শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ: যদি শিক্ষক থাকেন, তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন, শিশুর অগ্রগতি ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করুন।
- বাস্তবতার নিরিখে প্রত্যাশা: প্রতিটি শিশু আলাদা। কারও মুখস্থ করার ক্ষমতা বেশি, কারও বুঝতে সময় লাগে। তার নিজের গতিতে এগোতে দিন। তুলনা করবেন না। গুরুত্ব দিন তার চেষ্টা ও নিয়মিততাকে।
- কোরআনের শিক্ষাকে জীবনের সাথে যুক্ত করুন: রোজকার ঘটনাবলিতে কোরআনের নির্দেশনা কিভাবে প্রয়োগ হয়, তা সহজভাবে বুঝিয়ে বলুন। উদাহরণ: কারো সাহায্য করলে বলা “এটা কোরআনে আল্লাহর আদেশ”; ধৈর্য ধরে সমস্যা মোকাবেলা করলে বলা “কোরআন তো ধৈর্যধারণের কথা বলে”।
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: আমার শিশুটি খুব অল্প বয়সী (২-৩ বছর)। তাকে কি কোরআন শেখানো শুরু করা উচিত?
উত্তর: হ্যাঁ, শুরু করা উচিত, তবে শেখানোর ধরণ ভিন্ন হবে। এই বয়সে মুখস্থ করানোর চেয়ে পরিচিতি ও ভালোবাসা গড়ে তোলাই মুখ্য। আপনার তেলাওয়াত শোনানো, ছোট ছোট ইসলামিক গান/ছড়া শোনানো, নবীদের গল্প বলা, কোরআনকে সম্মানের সাথে দেখানো (চুমু খাওয়া, মাথায় ঠেকানো) – এসবের মাধ্যমে কোরআনকে তার পরিচিত ও প্রিয় একটি বস্তু হিসেবে গড়ে তুলুন। তার সামনে নিজে কোরআন পড়ুন। এটি ভবিষ্যতের জন্য দারুণ ভিত্তি তৈরি করবে।প্রশ্ন: আমার সন্তান আরবি বর্ণ শিখতে খুব কষ্ট করছে। আমি কি করব?
উত্তর: এটিই সবচেয়ে সাধারণ চ্যালেঞ্জ। ধৈর্য ধরুন। পদ্ধতি বদলান। রঙিন ফ্লাশ কার্ড, ম্যাগনেটিক লেটার্স, বর্ণের ছবি এঁকে দেওয়া, বর্ণ দিয়ে শব্দ বানানোর খেলা (যেমন: ب + ا + ت = বাত [ঘর]) – এগুলো চেষ্টা করুন। প্রতিদিন এক বা দুটি বর্ণ নিয়ে কাজ করুন, বারবার রিপিট করুন। উচ্চারণে জোর দিন। খেলার ছলে শেখান। তার প্রচেষ্টার প্রশংসা করুন, ভুল হলে হালকা মেজাজে শুধরে দিন। অতিরিক্ত চাপ দেবেন না।প্রশ্ন: কোরআন শিক্ষার জন্য কি মাদ্রাসায় বা হেফজ স্কুলে ভর্তি করানো জরুরি?
উত্তর: বাড়িতে সঠিক পরিবেশ, সময় ও জ্ঞান থাকলে প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই দেওয়া সম্ভব এবং কার্যকর। তবে, নির্ভুল উচ্চারণ (তাজবিদ) এবং পরবর্তীতে হিফজ (মুখস্থ) করার জন্য একজন যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষক/শিক্ষিকার তত্ত্বাবধান প্রয়োজন। মাদ্রাসা বা হেফজ স্কুল একটি কাঠামোগত পরিবেশ, সহপাঠী এবং নিয়মিত অনুশীলনের সুযোগ দেয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, শিক্ষকদের দক্ষতা ও শিশু-বান্ধব কিনা ভালো করে যাচাই করুন। বাড়ির কাছাকাছি ভালো শিক্ষক থাকলে বাড়িতেও শেখানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।প্রশ্ন: আমার সন্তান কোরআন পড়তে চায় না, জিদ করছে। কিভাবে তাকে আগ্রহী করব?
উত্তর: জোর করা কখনই সমাধান নয়, বরং বিরূপতা বাড়াবে। প্রথমে কারণ খুঁজে বের করুন। কি তাকে নিরুৎসাহিত করছে? পদ্ধতি কঠিন? বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? শিক্ষকের সাথে সমস্যা? নাকি অন্য কোন চাপ? তার সাথে খোলামেলা কথা বলুন। পদ্ধতিকে আরও আনন্দদায়ক করুন। তার পছন্দের সুরা দিয়ে শুরু করুন। ইসলামিক কার্টুন বা অ্যানিমেশন দেখান। গল্পের মাধ্যমে কোরআনের শিক্ষা বোঝান। ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন এবং পূরণে উৎসাহিত করুন। নিজে নিয়মিত পড়ে রোল মডেল হোন। ধৈর্য্য রাখুন, ভালোবাসা দিয়ে পাশে থাকুন। আগ্রহ ধীরে ধীরে ফিরে আসবে।প্রশ্ন: অর্থ না বুঝে শুধু মুখস্থ করার কি কোন উপকারিতা আছে?
উত্তর: মুখস্থ করা (হিফজ) একটি মহান সওয়াবের কাজ এবং কোরআন সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি। শুধু মুখস্থ করলেও সওয়াব পাওয়া যায়। তবে, কোরআনের পূর্ণ সৌন্দর্য, গভীরতা ও জীবন-পরিবর্তনকারী শক্তি উপলব্ধি করতে হলে অর্থ ও মর্ম বোঝা অপরিহার্য। অর্থ না বুঝলে সেই জ্ঞান দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করা যায় না, চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখে না। তাই, বয়স ও বুদ্ধি অনুযায়ী অর্থ সহযোগে শেখানোই আদর্শ। প্রাথমিক স্তরে সহজ সুরাগুলোর অর্থ বোঝানো শুরু করুন, বড় হলে ধীরে ধীরে গভীর তাফসীরের দিকে যান।- প্রশ্ন: কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার ভারসাম্য কিভাবে রাখব?
উত্তর: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। দুটোর জন্যই সময় বরাদ্দ করুন। মনে রাখবেন, কোরআন শিক্ষা আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিকাশের ভিত্তি, আর সাধারণ শিক্ষা পার্থিব জীবনে সফলতা ও সমাজে অবদানের হাতিয়ার। একটি সুষম রুটিন তৈরি করুন। অল্প সময় নিয়মিত অনুশীলনই যথেষ্ট (যেমন: দিনে ৩০-৪৫ মিনিট কোরআন, বাকি সময় স্কুলের পড়া ও অন্যান্য)। ছুটির দিনে একটু বেশি সময় দিতে পারেন। কোরআনের শিক্ষা যে জীবনকে ভারসাম্যপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ করে, সেই ধারণা দিন। দুটোর মধ্যে সাংঘর্ষিক কিছু নেই, বরং পরিপূরক। সন্তানের সামর্থ্য ও আগ্রহের দিকে খেয়াল রাখুন, তাকে অতিরিক্ত চাপে না ফেলুন।
বিসমিল্লাহ বলে শুরু হোক পথচলা…
শিশুদের হাতে কোরআন তুলে দেওয়া মানে শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ দেওয়া নয়; তা দেওয়া হয় এক মহাসমুদ্রের চাবি, এক আলোকবর্তিকা, এক অনন্ত জীবনের দিশা। এই দায়িত্ব অপরিসীম, এই দায়িত্ব মধুর। ছোটদের কোরআন শিক্ষার প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলো যদি আমরা সঠিকভাবে, ধৈর্য্য, ভালোবাসা ও দূরদর্শিতার সাথে গ্রহণ করি, তবে আমরা শুধু একটি শিশুকেই আলোকিত করব না, গড়ে তুলব একটি সুন্দর, ন্যায়পরায়ণ ও আল্লাহভীরু প্রজন্ম, যে প্রজন্ম নিজেদের জীবনকে আলোকিত করার পাশাপাশি পুরো সমাজ ও জাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে উঠবে। আজই শুরু করুন। আপনার সন্তানের হাত ধরে বসুন। ‘বিসমিল্লাহ’ বলুন। সেই মিষ্টি কণ্ঠে ফুটে উঠুক আল্লাহর কালামের প্রথম শব্দগুলো। এই ছোট্ট পদক্ষেপটিই হতে পারে তার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া, আপনার সবচেয়ে বড় সাফল্য। আপনার সন্তানের হৃদয়ে কোরআনের আলো জ্বালানোর এই পবিত্র যাত্রায় শুভকামনা রইল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।