জুমবাংলা ডেস্ক : চুয়াডাঙ্গার ব্লাক বেঙ্গল বিশ্বের সেরা ছাগল। এই ছাগল দেশের সেরা গরিবি দূর করতেও ভূমিকা রাখছে। বিশ্বখ্যাত কালো জাতের ছাগল পালন করে এ জেলার কৃষি পরিবারসহ অস্বচ্ছল পরিবারেও ফিরেছে স্বচ্ছলতা। এ জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দেখা মিলবে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট বা কালো জাতের ছাগল।
বাংলাদেশের স্থানীয় জাত ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল মানের দিক থেকে বিশ্বসেরা হিসেবে স্বীকৃত। জাতিসঙ্ঘ খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইও ২০১৫ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। আন্তর্জাতিক বাজারে এই ছাগল ‘কুষ্টিয়া গ্রেড’ হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমানে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার অংশ চুয়াডাঙ্গা জেলায় এই ছাগল বেশি পালন হওয়াতে জেলা প্রশাসন থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলা ব্র্যান্ডিং হিসেবে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল’ ঘোষণা করা হয়েছে। গুণগত মানের চামড়া ও সুস্বাদু গোশতের জন্য সারা পৃথিবীতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের যেমন খ্যাতি রয়েছে তেমনি যেকোনো পরিবেশে দ্রুত মানিয়ে নেয়া ও বছরে দুবারে ৩-৪টি বাচ্চা প্রদানের কারণে দারিদ্র বিমোচনে বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
শুধুমাত্র (ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট) কালো জাতের ছাগলই নয়, হরিয়ানা, যমুনাপাড়ী, তোতামুখি ও বিটল জাতের ছাগলও পালন করে আসছে এ জেলার মানুষেরা। চুয়াডাঙ্গা জেলাজুড়ে কয়েক প্রজাতির ছাগল দেখতে পাওয়া গেলেও এর মধ্যে ৭০ শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল। এই ছাগল পালনে বাড়তি তেমন খরচ না থাকায় খুব সহজেই এর দেখভাল করতে পারেন পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও। অনেকেরই জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে এই কালো জাতের ছাগল লালন-পালন করে। চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে মূল সড়ক পেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাঘাট এবং মেঠো পথেও দেখা যায় ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের। কোথাও উঠানে, কোথাও বা বাড়ির মাচায় চলছে ছাগল লালন-পালন। অনেক খামারি ২০-৩০টি ছাগল পালন করে বছরে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আয় করছেন।
চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের হাসানুজ্জামান নামের এক ছাগল পালনকারী বলেন, আমি সারা বছরই কৃষি কাজের পাশাপাশি ছাগল পালন করে আসছি। বর্তমানে আমার বাড়িতে ৩০ টির অধিক ছাগল রয়েছে। এই ছাগল দেড় বছরের মধ্যে আট থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। এরা বাড়ির আশপাশের গাছের পাতা, সবজির বর্জ্য, ঘাস ও বিচুলি খেয়েই বড় হয়। তাই এদের পালতে বাড়তি কোনো খরচেরও দরকার হয় না।
কালো জাতের ছাগল পালন করে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন লিমা থাতুন। স্বামী মনোয়ার হোসেন ও তিন সন্তান নিয়ে তার সংসার। চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে তাদের বাড়ি। স্বামীর এক বিঘা জমিতে কৃষিকাজ আর অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে চলে সংসার। এমতাবস্থায় লিমা ওয়েভ ফাউন্ডেশন থেকে ছাগল কেনার জন্য ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দুটি ছাগি ক্রয় করেন এবং ১০টি ছাগলের জন্য মাচাযুক্ত ঘর তৈরি করেন। ছাগি দুটি প্রথমেই একটি করে খাসি বাচ্চা প্রসব করে এবং বছর দেড়েকের মধ্যে লিমা খাসি দুটি ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।
চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের ছাগল খামারী মিনারুল ইসলাম জানান, মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে দুইট ছাগল থেকে বর্তমানে আমি ৫০টির অধিক ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের (কালো জাতের ছাগল) মালিক। তিনি বলেন, ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালন করে আমার জীবন বদলে গেছে। ঋণ নিয়ে মাত্র দুটি ছাগল কিনে পালন করতে শুরু করি। এখন আমার ৫০টির বেশি ছাগল রয়েছে। ছাগল ও দুধ বিক্রি করে প্রতি বছরে ভালো টাকা আয় হয়।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণীসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় বছরে প্রায় পাঁচ লাখ ছাগল উৎপাদন হয়ে থাকে। এর থেকে ২৩ হাজার টন গোশত উৎপাদন হয়। বর্তমানে বাজারে ছাগলের গোশতের দাম প্রকার ভেদে ৯৫০-১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। জেলায় ছাগলের গোশত ও চামড়া বিক্রি করে বছরে আয় হচ্ছে দু’হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও ছাগলের চামড়া বিক্রি করেও মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা ছাগল উন্নয়ন খামারের প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা আরমান আলী জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলার বিশ্ববিখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জাত সংরক্ষণে ১৯৯৬ সালে চুয়াডাঙ্গায় ছাগল উন্নয়ন খামার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর এ খামার থেকে খুলনা বিভাগের ১০টি জেলাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে নির্ধারিত মূল্যে পাঠা-ছাগি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এ খামারে পাঁঠা-ছাগি মিলিয়ে প্রায় এক হাজার ছাগল পালন করা হয়। এর ফলে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাত সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চুয়াডাঙ্গা ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জন্য একটি অভয়াশ্রম বলা যায়। এখানকার জলবায়ু ও অনুকূল আবহাওয়া হওয়ার কারণে ছাগল পালনের ক্ষেত্রে এটা সব থেকে উপযোগী এলাকা। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল (কালো জাত) হলো চুয়াডাঙ্গার ব্রান্ড। চুয়াডাঙ্গা জেলাকে এই ছাগলের অভয়আশ্রম বলে মনে করি। বিশ্বের মধ্যে ১০০টি ছাগল গবেষণা করে দেখা গেছে এই কালো জাতের ছাগলই সব থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। চুয়াডাঙ্গার ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের গোশত অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় দেশে এবং দেশের বাইরে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এটি চুয়াডাঙ্গা জেলার ঐতিহ্য। গ্রামের বেশিভাগ নারীরা তাদের আয়ের উৎস হিসেবেও এই ছাগল পালনে ভূমিকা রয়েছে। এ জেলায় ছাগলের গোশত ও চামড়া বিক্রি করে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।