সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওরের উপজেলা শাল্লায় সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক চুরির ঘটনায় জনমনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রায়ই কোথাও না কোথাও চুরির ঘটনা ঘটছে। গোটা উপজেলাজুড়ে ধারাবাহিক ও সুসংগঠিতভাবে ঘটে যাওয়া এসব অপরাধ দমন ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিকে চিঠি দিয়েছেন তিনি। গত ১৫ জুলাই রাতে ই-মেইলের মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। আইনজীবী শিশির মনির শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা ও সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনের জামায়েতে ইসলামীর দলীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী।
চিঠিতে শাল্লা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ধারাবাহিক চুরির তথ্য তুলে ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, শাল্লা উপজেলার প্রতিটি গ্রামে একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটছে। যা কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সুসংগঠিত ও ধারাবাহিক অপরাধ-চক্রের পরিচায়ক।
জানা যায়, শাল্লা উপজেলায় কয়েকটি গ্রামের কিছু মানুষ যুগ যুগ ধরে চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। এমন জঘন্যতম পেশা থেকে তাদেরকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার একাধিক চেষ্টা ব্যর্থ বারবার হয়েছে। এমনকি চুরির সঙ্গে জড়িতদের জাতীয় পরিচয়পত্রে পেশা উল্লেখ ছিল চৌর্যবৃত্তি। বিষয়টি নজরে আসায় ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলেন দিরাই-শাল্লার তৎকালীন সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরী।
বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা পর জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে চৌর্যবৃত্তি পেশা পরিবর্তন করে অনেকেই কৃষক-শ্রমিক লেখান। সময় অনেক দূর এগিয়ে গেলেও চুরি ছাড়েনি কিছু মানুষ। সিঁদ কেটে গরু, বাছুর, হাঁস-মুরগি, ধান-চাল, স্বর্ণালংকার, নৌকা, ইঞ্জিন, পানির পাম্প ও মোটরসাইকেল চুরি করছে কিছু লোক। আবার চাহিদামতো অর্থ দিলে ফেরতও দিচ্ছে চুরির মালামাল। এই অবস্থা চলছে যুগযুগ ধরে।
শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম বললেন, সবাই জড়িত না থাকলেও কামারগাঁও, উজানগাঁও, নারকিলা ও চিকাডুপি গ্রামের কিছু মানুষ বংশপরম্পরায় চুরি করছে। যার কারণে অনেকেই এসব গ্রামকে চোরের গ্রাম বলে আখ্যায়িত করেন। এখনও কারো কারো জাতীয় পরিচয়পত্রে পেশা চৌর্যবৃত্তি লেখা রয়েছে। বেশি চোর কামারগাঁও রয়েছে। একটি ঘটনা ছাড়া চুরির বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি বা জানায়নি। যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, আমরা তাদের গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করি। কিন্তু আদালত থেকে জামিন পেয়ে আবারও এরা এই চুরির সাথে জড়িয়ে পড়ে।
শাল্লার প্রতিটি গ্রামই হাওর বা নদী দ্বারা বেষ্টিত। এই উপজেলার ভৌগলিক অবস্থান হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার সীমান্তে। ফলে চোরেরা চুরি করে সহজে আশপাশের জেলায় চলে যায়। চোরাই মালামালও বিক্রি করে সেখানে। তিনটি জেলার সীমান্ত হওয়ায় অভিযান চালাতে আইনশৃখংলা বাহিনীকে বেগ পেতে হয়।
স্থানীয়রা জানান, সম্প্রতি চোরের উৎপাত বেড়েছে। প্রায়ই চুরির ঘটনা ঘটছে। অন্তত ১৬টি গ্রামের সাধারণ মানুষ চুরির আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। চুরি ঠেকাতে বিভিন্ন গ্রামে পাহারাদার নিয়োগ করা হয়েছে। আবারও চুরি করতে পারে, এমন ভয়ে কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ করছেন না। মুক্তিপণ বা চাহিদামত অর্থ দিয়ে ফেরত আনছেন নিজেদের মালামাল।
একাধিক ব্যক্তি জানান, কামারগাঁও, উজানগাঁও, নারকিলা, বল্লভপুর ও চিকাডুপি গ্রামের কিছু মানুষ চুরির সঙ্গে জড়িত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হলে এদের দমন করা সম্ভব। একটি সিন্ডিকেটের প্রধান কামারগাঁও গ্রামের হান্নান মিয়া। তার মাধ্যমে টাকা দিয়ে চুরির মালামাল ফেরত নিয়েছেন অনেকেই। তবে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে হান্নান মিয়ার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
আইনজীবী শিশির মনির চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, টুকচানপুর, মার্কুলি, প্রতাপপুর, আনন্দপুর, মনুয়া, চবিয়া, মেদা, মুছাপুর, খল্লী, সুধন খল্লী, গ্রাম শাল্লা, মুক্তারপুর, হরিপুর, বলরামপুর, মামুদনগর, উজানগাঁওসহ প্রায় প্রতিটি গ্রামের মানুষ চুরি আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। প্রতিটি চুরির ঘটনার তদন্ত করে অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করে গ্রেফতার ও মালামাল উদ্ধার, রাতে পুলিশের টহল ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন, প্রয়োজনে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
আইনজীবী শিশির মনির চিঠিতে দুই মাসে অন্তত ১৬টি চুরির ঘটনা ও মুক্তিপণের মাধ্যমে কিছু মালামাল ফেরত পাওয়ার বিষয়ও উল্লেখ করেছেন। চুরির ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, গেল ২৫ মে মেঘনাপাড়া বড় হাটির রনজিত দাসের ১টি গরু চুরি, পরে ১২ হাজার টাকায় ফেরত আনা হয়। ২৫ মে গোয়ানী গ্রামের লোকেশ দাসের কাছ থেকে জোরপূর্বক ৫ লাখ হাতিয়ে নেওয়া, পরে অর্ধেক টাকা ফেরত আনা হয়। ২৯ মে আব্দা গ্রামের ভুলু দাসের বাড়ি থেকে মহিলার কানের দুল ও দুইটি গরু চুরি হয়। ১ জুন সেননগর গ্রামের রেজেনা আক্তারের ২টি গরু চুরি, ৫ জুন রৌয়া বাগের হাটির ভুষন মেম্বারের ৩টি গরু চুরি, পরে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে উদ্ধার। ৩০ জুন রৌয়া ছোট হাটির রাধাকান্ত দাসের ৮টি মেশিন চুরি। ২ জুলাই আনন্দপুর বাজারে একটি স্বর্ণের দোকান থেকে ৭ লাখ মালামাল চুরি। ৮ জুলাই কাশীপুর গ্রামের মনির মিয়ার ৪টি গরু চুরি। ৯ জুলাই শ্রীহাইল গ্রামে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জামান চৌধুরী ফুল মিয়ার বাড়ি থেকে নগদ ৬ লাখ টাকা, ৫ ভরি স্বর্ণালংকার ও ২টি ব্যাটারি চুরি। ৯ জুলাই কার্তিকপুর বড় হাটির বাতেন মিয়ার একটি বড় নৌকা চুরি। ছোট আব্দা গ্রামের সুষেন দাসের ২টি গরু চুরি, পরে ১৪ হাজার টাকা দিয়ে উদ্ধার।
সম্প্রতি রৌযা গ্রামের বাগের হাটির করুনা দাসের ১৬ টি হাঁস চুরি, একই গ্রামের নিলেশ দাসের ১টি গাভী চুরি। কার্তিকপুর গ্রামের আল মিয়ার নৌকার মেশিন চুরি। দামপুর গ্রামের জুবায়ের মিয়ার ঘর থেকে একটি দামী মোবাইল ফোন, নগদ ৫ হাজার টাকা, একই গ্রামের আমিন মিয়ার ঘরথেকে একটি পানির পাম্প ও সিরাজুল ইসলাম সিরু মিয়ার ঘর থেকে নগদ ৬০ হাজার টাকা চুরি ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকা থেকে ১০টি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে।
শাল্লা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জামান চৌধুরী ফুল মিয়া বলেন, চোরের যন্ত্রণায় মানুষ অতিষ্ঠ। আমার বাড়িও চুরি হয়েছে। বৈশাখ মাস থেকেই চুরি শুরু হয়েছে। এখন দ্রুত গতির নৌকা দিয়ে চুরি করছে। পেশাদার চোরদের সাথে এখন প্রভাবশালী কিছু মানুষ জড়িয়ে পড়ছে বলে জানা যাচ্ছে। প্রশাসনের যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
আইনজীবী শিশির মনিরের চিঠির বিষয়ে থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি কয়েক দিন ধরে ছুটিতে আছি, চিঠিটি দেখিনি। এই বিষয়ে আমরা কাজ করছি। এই লোকগুলোকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব আমরা।
শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়াস চন্দ্র দাস বললেন, চুরি রোধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশদের দিয়ে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাছ চলছে। আইনজীবী শিশির মনির একটি চিঠি দিয়েছেন। আমরা আশা করছি আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ভাল কিছু ফলাফল জানা যাবে।
সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে চৌর্যবৃত্তি পেশা লেখার বিষয়টি নিয়ে সম্ভবত আমি ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে কথা বলেছিলাম। এরপর এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছি, চুরিও কমেছিল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।