মোঃ মাহামুদুল হাসান : বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে বাস্তুচ্যুতি এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি মাটিতে প্রবেশ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও নদী ভাঙনের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকায় আসছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। অন্য শহরেও আশ্রয় নিচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা গৃহহীন মানুষ।
বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ, যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের সামান্য বৃদ্ধি হলেও তা দেশের বৃহৎ অংশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর গড়ে ৩.৩ মিলিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উপকূলীয় অঞ্চলে এই হার আরও বেশি, প্রায় ৫ থেকে ৭ মিলিমিটার পর্যন্ত।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ এই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সরাসরি প্রভাবিত হচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষদের প্রধান জীবিকা কৃষি, মৎস্য এবং লবণ চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে কৃষি জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ছে, যার কারণে ফসল উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে। এছাড়া মিঠা পানির উৎসগুলো লবণাক্ত হয়ে পড়ছে, যা মানুষের পানির চাহিদা পূরণে সমস্যা সৃষ্টি করছে। মৎস্য চাষের ক্ষেত্রেও লবণাক্ততার কারণে প্রজাতির পরিবর্তন ঘটছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে জীবিকার সন্ধানে অনেকই নিজ বসতি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ এবং তীব্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় একটি সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে এবং এর ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবন আরও বিপর্যস্ত হতে পারে। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণেও জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যাও বাড়বে উল্লেখযোগ্যহারে।
বাংলাদেশের বুক জুড়ে রয়েছে ১৩০টি নদী। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি নদী বন্যাপ্রবণ। প্রতি বছর নদী ভাঙনে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জুন থেকে অক্টোবর বাংলাদেশে বর্ষাকাল। এ সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা। এর ফলে নদী তীরে থাকা বাজার, স্কুল, মসজিদ, ঘর-বাড়ি পানিতে ভেসে যায়। ফলে লাখো মানুষের গৃহহীন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। অনেকেই পরিণত হন জলবায়ু শরণার্থীতে৷
২০১৮ সালের বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে যে হারে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে চলে আসবে দেশটি। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর সংখ্যার দিক দিয়ে এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে চলে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভিটেমাটি হারানো বাংলাদেশির সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩৩ লাখে পৌঁছাতে পারে।
২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘গ্রাউন্ডসওয়েল’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসীর সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার মোট অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসীর প্রায় অর্ধেক হয়ে উঠতে পারে, যা সংখ্যার বিচারে ১ কোটি ৯৯ লাখ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, স্বল্প অথবা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অভ্যন্তরে বা দেশের বাইরে স্থানান্তরকে জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি বলে। অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইডিএমসি) তথ্য অনুসারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের বার্ষিক বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা ৯ লাখ ১৫ হাজার। চলতি শতকের শুরুর দশকে এই সংখ্যা ছিল গড়ে সাত লাখ।
আইডিএমসির সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্টে বলা হয়েছে, গত বছর (২০২৪) অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে পঞ্চম। সংখ্যাটা ১৭ লাখ ৯১ হাজার।
সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ১৫ লাখ, ২০২১ সালে প্রায় ১০ লাখ, ২০২০ সালে দুর্যোগের কারণে প্রায় ৪৪ লাখ, ঘূর্ণিঝড় ফণী ও বুলবুলের কারণে ২০১৯ সালে ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আইডিএমসির তথ্য বলছে, উপকূলীয় জেলা, যেমন ভোলা, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরার মতো জেলাগুলো থেকে বাস্তুচ্যুতি বেশি ঘটে। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের বছরগুলোতে বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা বেড়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আধা মিটার (০.৪৮) থেকে ২ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। যে কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে শুধু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই এসব অঞ্চলের ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৯টি শহরের বস্তিতে বসবাসকারী প্রায় ৫২ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে শহরে এসেছে। এর মধ্যে বন্যা, নদীভাঙন এবং ঘূর্ণিঝড় প্রধান কারণ। এই জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ মধ্যম দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ৫০ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের শিকার।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা অভিবাসন নিচ্ছে তাদের প্রায় ৬০ শতাংশ রাজধানী ঢাকা, ২০ শতাংশ চট্টগ্রাম শহরে ও ২০ শতাংশ আন্তঃজেলায় অভিবাসী হচ্ছে।
গবেষকেরা বলছেন, অভিবাসনের ফলে তিন শ্রেণির মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এক. অভিবাসী নিজে, ২. অভিবাসন এলাকায় থেকে যাওয়া মানুষ, ৩. যে এলাকায় অভিবাসন ঘটে, সেই এলাকার মানুষ। গবেষণায় দেখা গেছে, অভিবাসনের ফলে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। অর্থনৈতিক অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয় না; বরং দারিদ্র্যের হার আরও বেড়ে যায়।
জলবায়ু শরণার্থীদের মধ্যে মাত্র ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে জলবায়ু উদ্বাস্তুরা শহরে এসে আর্থিক ও সামাজিক উভয় দিক থেকেই ব্যাপক সংগ্রাম করছেন। এ পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে পুনর্গঠন করে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে এর আওতায় আনতে পারলে তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে। তাদের জন্য লো-কস্ট হাউজিং, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন এবং প্রশিক্ষণব্যবস্থা বাড়াতে হবে। শহর মানে শুধু ঢাকা নয়—স্থানীয় সম্পদের ভিত্তিতে অন্যান্য শহরেও তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে টেকসই জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বহুমাত্রিক সংকট, যার মোকাবিলায় সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারি, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে বাংলাদেশের জনগণ একটি নিরাপদ এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।