জুমবাংলা ডেস্ক : আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ধরনের করই বাড়তে যাচ্ছে। ব্যক্তি খাতের আয়কর (প্রত্যক্ষ কর) বাড়ানোর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির দুর্দিনে করমুক্ত আয়ের সীমাও বাড়ছে না। তবে সবচেয়ে বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে পরোক্ষ কর, যাতে বেশি চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ। পরোক্ষ কর হিসাবে আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর চিন্তা চলছে। অনেক পণ্যে ভ্যাটহার ১৫ শতাংশ করায় এর প্রভাব পড়বে বাজারে। এর মধ্যে চাল, গম, জ¦ালানি, সার, বীজ, ওষুধ ও শিল্পের কাঁচামালসহ তিন শতাধিক মৌলিক পণ্যে এতদিন ধরে চলে আসা শুল্কছাড় সুবিধাও তুলে দেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি ভ্যাট ও শুল্কের দায় ভোক্তাকেই বহন করতে হবে। এ ছাড়া আসন্ন বাজেটে বাড়তে যাচ্ছে ব্যাংকে রাখা অর্থের ওপর আবগারি শুল্কও। বাড়বে মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্কও। সব মিলিয়ে বাড়তি করের চাপে পড়তে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার ব্যয়ের প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ। ফলে আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও বড় হচ্ছে। এতে চাপ তৈরি হয়েছে রাজস্ব আহরণকারী সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর। আর এই আয় বাড়াতে গিয়ে আয়ের উৎসও খুঁজতে হচ্ছে। আর মানুষের কাছ থেকেই সেই টাকা নিতে নানা পন্থা বের করা হচ্ছে। মূলত মানুষের কাছ থেকে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও আমদানি শুল্কের নামে টাকা আদায় করা হয়। বিশেষ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তপূরণে রাজস্ব বাড়াতে আগামী অর্থবছরে বিভিন্ন খাতের ভ্যাট সুবিধা তুলে দিয়ে ভ্যাট আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। একই শর্তের কারণে তিন শতাধিক মৌলিক পণ্যের ওপর শূন্য শুল্ক সুবিধাও প্রত্যাহার হতে যাচ্ছে।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে এনবিআরকে আহরণ করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণ বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে থাকছে আগামী বাজেটে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের পরামর্শে কর ব্যয় কমিয়ে আনতে আমদানি শুল্ক খাতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। শূন্য শুল্কহারবিশিষ্ট প্রায় তিন শতাধিক পণ্যের ওপর ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। এ তালিকায় রয়েছে চাল, গম, ভুট্টা, সরিষা বীজ, পরিশোধিত সয়াবিন, পাম অয়েল, সানফ্লাওয়ার বীজ, তুলাবীজ, বিভিন্ন শাক-সবজির বীজ, ক্রুড অয়েল, সার, প্রাকৃতিক গ্যাস, বিটুমিন, কয়লা, জিপসাম, ভিটামিন, ইনসুলিন, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অত্যাবশ্যক ওষুধ এবং ভ্যাকসিন ও ওষুধের কাঁচামাল, বিভিন্ন ধরনের দরকারি রাসায়নিক ইত্যাদি। বর্তমানে ৩৩৫টি আইটেমের পণ্য আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না।
এনবিআর মনে করে, করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ালে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী আয়করের আওতার বাইরে চলে যাবে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে মানুষের আয়ও বেড়েছে। তাই করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোকে যৌক্তিক মনে করে না সংস্থাটি। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এনবিআর কখনোই টানা করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ায়নি। সাধারণত দুই-তিন বছর বিরতিতে আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। এর আগে ২০২০-২১ সালে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করা হয়।
এ ছাড়া পুঁজিবাজারের জন্য আসছে বড় দুঃসংবাদ। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর ক্যাপিটাল গেইন কর আরোপের সিদ্ধান্ত থাকতে পারে। এই হার হতে পারে ১৫ শতাংশ। কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ন্যূনতম কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে।
আগামী অর্থবছরে বড় করদাতারাও থাকবে চাপে। বাজেটে বিত্তশালীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়ের
পদক্ষেপ থাকছে। বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ। বছরে সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় থাকলে ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। বছরে সাড়ে ৪৬ লাখ টাকার বেশি আয় থাকলে ৩০ শতাংশ আয়কর দিতে হবে।
অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়াতে পরোক্ষ কর (আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট) খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আসন্ন বাজেটে স্থানীয় শিল্পের কর অবকাশ ও ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা সংকুচিত করে আনা এবং সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ও মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। বর্তমানে মোবাইল ফোনে কথা বলায় ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত আছে। অন্যদিকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আছে। এর সঙ্গে ভোক্তাদের ১ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। আসন্ন বাজেটে আরও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে মোবাইল সেবার দাম বাড়তে পারে।
বর্তমানে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে প্রবেশে এবং রাইডে চড়তে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত আছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে পার্কে ঘোরার খরচ বাড়বে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোমল পানীয়, কার্বোনেটেড বেভারেজ, এনার্জি ড্রিংকস, ফলের জুস, আমসত্ত্বের দাম বাড়তে পারে। কারণ সরবরাহ পর্যায়ে এসব পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। এটি বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।
নতুন ভ্যাট আইনে একটি স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাটহার (১৫ শতাংশ) ছিল। নানা কারণে সেটি রাখা সম্ভব হয়নি। এ জন্য বর্তমানে একাধিক হারে ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে এই হার যৌক্তিক করা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ভ্যাটহার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। ২০২৬ সাল নাগাদ পর্যায়ক্রমে সব পণ্য ও সেবার ওপর স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাটহার আরোপ করা হবে।
ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্কের স্তর ও হারে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছে রাজস্ব বিভাগ। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ-সংক্রান্ত ঘোষণা আসতে পারে। বর্তমানে ১০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত স্তরটি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে ১০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত আগের মতোই তিন হাজার টাকা আবগারি শুল্ক বসবে। ৫০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত তিন হাজার টাকার পরিবর্তে পাঁচ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক বসতে পারে।
এক কোটি টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত স্তরটিও ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে এক কোটি টাকা থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ১০ হাজার টাকা এবং দুই কোটি টাকা থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা করা হতে পারে। এখন এক কোটি টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক বসে। কারও ব্যাংক হিসাবে বছরে একবার যদি স্থিতি পাঁচ কোটি টাকা অতিক্রম করে, তাহলে আবগারি শুল্কের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা করা হতে পারে। এখন এই স্তরে ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান এবং উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। যেহেতু করদাতা বাড়ছে না, ফলে যারা কর দিচ্ছেন তাদের ওপরই চাপ বাড়বে। আর পরোক্ষ কর তো সব শ্রেণির মানুষের ওপর পড়বে। তিনি বলেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে সম্পূর্ণ আলাদা একটি করনীতি ইউনিট গঠন করা প্রয়োজন। এতে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তি জরুরি। এই ইউনিটের প্রধান লক্ষ্য হবে, কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা এবং ক্ষেত্র নির্ধারণের পাশাপাশি কীভাবে নতুন ধরনের শিল্প ও সেবা খাত তৈরি করে ভবিষ্যতে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব আহরণের উৎস তৈরি করা। – আমাদের সময়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।