সেই মার্চ, ২০২০-এর কথা মনে আছে? রাস্তা ফাঁকা, বাজারে আতঙ্ক, হাসপাতালে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার। ঢাকার বুক চিরে সাইরেনের করুণ সুর। কোভিড-১৯ শুধু একটি ভাইরাস নয়, এটি আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে গভীর দাগ কেটে গেছে। আজ, যখন মুখোশ খুলেছি, ভিড়ে মিশছি, তখনও কি আমরা সেই শিক্ষা ভুলে গেছি? কোভিড-১৯ পরবর্তী স্বাস্থ্য সচেতনতা শুধু একটি স্লোগান নয়; এটি আমাদের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য এক অস্ত্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সংক্রামক রোগের ঝুঁকি কোভিড-পূর্ব অবস্থার চেয়ে এখনও ৩০% বেশি। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য (২০২৩) অনুযায়ী, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার উদ্বেগজনক। কিন্তু কেন? কারণ মহামারীর অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে: স্বাস্থ্য সচেতনতা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার গণ্ডি পেরিয়ে সমাজের নিরাপত্তার ভিত্তি।
কোভিড-১৯ পরবর্তী স্বাস্থ্য সচেতনতা: মহামারীর শিক্ষা ও টেকসই অভ্যাস গঠন
মহামারী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে একটি অদৃশ্য ভাইরাস স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ধ্বসের কিনারে নিয়ে যেতে পারে। ডা. তাসনিম জাহারা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ (আইসিডিডিআর,বি), ব্যাখ্যা করেন: “কোভিড আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যে হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বা মাস্ক পরা শুধু ভাইরাসের বিরুদ্ধে নয়, নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা এমনকি ডায়রিয়ার বিরুদ্ধেও ঢাল।
ভঙ্গুর স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মুখোমুখি হওয়া
- বিছানার অপ্রতুলতা: ২০২০-২১ সালে আইসিইউ বেডের জন্য ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষার করুণ গল্প শুনেছেন নিশ্চয়? বাংলাদেশে প্রতি ১০,০০০ জনে মাত্র ১.১টি হাসপাতাল বেড (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২৩)।
- ঔষধ সংকট: লাইফ সেভিং ড্রাগস-এর ঘাটতি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
- মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা (২০২২) বলছে, ৬৮% তরুণ-তরুণী কোভিড-পরবর্তী সময়ে উদ্বেগ বা ডিপ্রেশনে ভুগছেন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: রিকশাচালক রফিকের গল্প
ঢাকার মোহাম্মদপুরের রিকশাচালক রফিকুল ইসলাম। কোভিডে স্ত্রীকে হারানোর পর বললেন, “ডাক্তার বললেন, সময়মতো হাসপাতালে আনলে বাঁচত। তখন জানতাম না জ্বর-কাশিকে এত ভয় পেতে হয়…” রফিকের মতো হাজারো মানুষ আজও স্বাস্থ্য সচেতনতাকে ‘বিলাসিতা’ ভাবেন। এটাই প্রকৃত সংকট।
টেকসই স্বাস্থ্য অভ্যাস গড়ে তোলার ৫ বিজ্ঞানসম্মত কৌশল
কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে শুধু হাত ধোয়া নয়, চাই সমন্বিত পন্থা। WHO-এর “Building Back Better” গাইডলাইন (২০২৩) এবং বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই রোডম্যাপ:
১. ব্যক্তিগত সুরক্ষার নতুন সংজ্ঞা
- হ্যান্ড হাইজিন: সাবান-পানি ২০ সেকেন্ড বা অ্যালকোহল-ভিত্তিক স্যানিটাইজার।
- শ্বাসব্যবস্থার শিষ্টাচার: হাঁচি-কাশিতে কনুইয়ের ব্যবহার।
- বায়ুদূষণ মোকাবেলা: ঢাকার বাতাসে PM2.5 এর মাত্রা প্রায়ই ‘অস্বাস্থ্যকর’ (AirVisual, 2024)। N95 মাস্ক ব্যবহার অপরিহার্য।
২. প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার প্রসার
- নিয়মিত চেক-আপ: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ স্ক্রিনিং।
- টিকাদান: ফ্লু শট, নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য: ২০২৩ সালে রুটিন টিকাদানের হার ৮৫% এ পৌঁছেছে (COVID-পূর্বে ৭৮%)।
- পুষ্টি ব্যবস্থাপনা: স্থূলতা রোধে ফাস্ট ফুড এড়ানো।
৩. ডিজিটাল হেলথ টুলসের ব্যবহার
- মোবাইল অ্যাপস: ‘সেবা’ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) অ্যাপে ডাক্তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট, টেলিমেডিসিন।
- ওয়েয়ারেবল ডিভাইস: হার্ট রেট, অক্সিজেন লেভেল মনিটরিং।
সমষ্টিগত দায়িত্ব: পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত
পরিবার: প্রথম প্রতিরক্ষা
- বাড়িতে হ্যান্ডওয়াশিং স্টেশন তৈরি।
- অসুস্থ সদস্যকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা।
- পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ভবিষ্যত প্রজন্ম গঠন
- শ্রেণিকক্ষে হাইজিন এডুকেশন।
- মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং সেশন।
- বার্ষিক স্বাস্থ্য ক্যাম্পের ব্যবস্থা।
রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ: অবকাঠামোগত রূপান্তর
- ICU ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি: ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি ১০,০০০ জনে ৩টি বেডের লক্ষ্য (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়)।
- গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র শক্তিশালীকরণ: কমিউনিটি ক্লিনিকগুলিতে ডাক্তার-নার্সের পদায়ন।
- সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন: গণমাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি প্রচার।
মানসিক স্বাস্থ্য: অবহেলিত অধ্যায়
কোভিড শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি আমাদের মানসিকতাকে গভীরভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “লকডাউনের একাকীত্ব, আত্মীয়ের মৃত্যু, চাকরি হারানো – এই ট্রমা থেকে মুক্তি পেতে ৩ বছরের থেরাপি লাগতে পারে।”
করণীয়
- কথা বলুন: পরিবার বা বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করুন।
- পেশাদার সাহায্য নিন: ৩৩৩ (জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হেল্পলাইন)।
- মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস: যোগব্যায়াম, মেডিটেশন।
জেনে রাখুন
১. কোভিড-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য অভ্যাস কোনটি?
হাত ধোয়া ও শ্বাসব্যবস্থার শিষ্টাচার (হাঁচি-কাশিতে মুখ ঢাকা)। এই দুটি অভ্যাস শ্বাসতন্ত্র ও পেটের অসুখ ৫০%-এর বেশি কমাতে পারে (WHO, 2023)। নিয়মিত স্বাস্থ্য চেক-আপও জরুরি।
২. টিকাদান এখনও প্রয়োজনীয় কেন?
কোভিড ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়ার মতো রোগের ঝুঁকি বেড়েছে। বুস্টার ডোজ শরীরে অ্যান্টিবডি লেভেল বাড়ায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশিকা অনুযায়ী, উচ্চঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর (বয়স্ক, ডায়াবেটিস রোগী) টিকা নেওয়া উচিত।
৩. মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেবেন কীভাবে?
দৈনিক ৩০ মিনিট শরীরচর্চা, পর্যাপ্ত ঘুম (৭-৮ ঘণ্টা), এবং সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখুন। উদ্বেগ লাগলে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এ ফোন করুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সেন্টারও বিনামূল্যে সেবা দেয়।
৪. স্বাস্থ্য সচেতনতা বজায় রাখতে কমিউনিটির ভূমিকা কী?
স্থানীয় মসজিদ/মন্দিরে সচেতনতামূলক আলোচনা, স্কুলে হাত ধোয়ার কর্মশালা, এবং অসুস্থ প্রতিবেশীর সাহায্য করা যেতে পারে। কুড়িগ্রামের একটি গ্রাম ‘স্বাস্থ্য সচেতন গ্রাম’ ঘোষণা করে রোল মডেল হয়েছে।
৫. দীর্ঘমেয়াদী কোভিড উপসর্গ (Long COVID) মোকাবিলার উপায়?
ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট বা ব্রেইন ফগ থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। পর্যাপ্ত পানি পান, ব্যালেন্সড ডায়েট এবং ফিজিওথেরাপি সাহায্য করে। আইসিডিডিআর,বি-তে লং কোভিড ক্লিনিক চালু আছে।
কোভিড-১৯ পরবর্তী স্বাস্থ্য সচেতনতা কখনও ‘অতিরিক্ত’ বা ‘বিলাসিতা’ নয়; এটি আমাদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে একমাত্র কৌশল। মহামারী শিখিয়ে দিয়েছে: একটি অসুস্থ শরীর শুধু ব্যক্তিকে নয়, গোটা সমাজকে বিপন্ন করে। হাতের সাবান, টিকার ভায়াল, বা মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন – প্রতিটি পদক্ষেপই আমাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করে। মনে রাখবেন, ২০২০ সালের সেই অন্ধকার রাত ফিরে আসুক – তা আমরা কেউ চাই না। আজই শুরু করুন: পরিবারে স্বাস্থ্য আলোচনা করুন, নিয়মিত চেক-আপে যান, টিকাদান সম্পন্ন করুন। কারণ, সচেতনতাই পারে আমাদের পরবর্তী মহামারী থেকে বাঁচাতে – এটি শুধু বিজ্ঞানের কথা নয়, ইতিহাসের শিক্ষা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।