আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বহু শতাব্দী ধরে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সনাতন ধর্মের অনুসারীরা গরুকে পবিত্র প্রাণী বলে বিশ্বাস করে আসছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে এ প্রাণীগুলোকে এতটায় সম্মানের চোখে দেখা হয় যে এবারের বিশ্ব ভালোবাসা দিবস-কে ‘গরু আলিঙ্গন দিবস’ হিসেবে প্রচারের পরিকল্পনা নেয় কর্তৃপক্ষ। তাদের প্রত্যাশা, পদক্ষেপটি নাগরিকদের আবেগ বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবে।
খবরটি মিডিয়ায় দারুণ ভাইরাল হয়। ইন্টারনেট মেম, কার্টুনের পাশাপাশি টেলিভিশন উপস্থাপকদের কৌতুকের হাতিয়ার হয়ে ওঠে এটি। ফলে গুরুত্ব হারাতে শুরু করে উদ্যোগটি।
ভারতের প্রাণী কল্যাণ বোর্ড এক বিবৃতিতে গত সোমবার ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘গরু আলিঙ্গন দিবস’ ঘোষণা করে। বিবৃতিতে গরুকে ‘ভারতীয় সংস্কৃতি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড’ বলে অভিহিত করা হয়।
ভারতের প্রাণী কল্যাণ বোর্ড একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা; যা ভারতের মৎস্য, পশুপালন এবং দুগ্ধজাত মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিতে থাকে। পুষ্টি বিবেচনায় গরুকে ‘সবার দাতা এবং মানবজাতিকে সম্পদ দিয়ে থাকে’ বলে সংস্থাটির বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
সেখানে আরও বলা হয়, ‘বৈদিক’বা পবিত্র হিন্দু ঐতিহ্যের প্রচারের একটি প্রচেষ্টার অংশ এই উদ্যোগ। এর ফলে ভারতের সংস্কৃতিতে পশ্চিমা প্রভাব অনেকটায় কমবে বলা আশা করা হচ্ছে।
‘সময়ের সঙ্গে পশ্চিমা সংস্কৃতির অগ্রগতির কারণে বৈদিক ঐতিহ্য প্রায় বিলুপ্তির পথে। পশ্চিমা সভ্যতার চমক আমাদের শারীরিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে প্রায় বিস্মৃত করে দিয়েছে।’
তবে এ ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে অনলাইনে বিষয়টি ব্যাপক হাস্যরসের খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় ভারত সরকার।
গত কয়েকদিন ধরেই মিডিয়া আউটলেটগুলো সরকারের এমন পরিকল্পনা নিয়ে উপহাস করছে, ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ করছে; যেখানে দেখানো হয়েছে প্রেমিক পুরুষদের থেকে পালিয়ে যাচ্ছে গরু। অন্যদিকে পশু এবং মানুষের মধ্যে হিংসাত্মক সংঘর্ষের ভিডিও পোস্ট করছেন অনেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।
ভারতের নেতৃস্থানীয় ইংরেজি ভাষার নিউজ চ্যানেল এনডিটিভির একজন উপস্থাপককে দেখা গেছে কয়েকটি গরুকে আলিঙ্গন করার চেষ্টায় ব্যস্ত আর গরুগুলো তাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। এ সময় উপস্থাপককে রসিকতা করে বলতে শোনা যায়, ‘আলিঙ্গনের আগে সম্মতি নেয়া গুরুত্বপূর্ণ’।
‘গরু বিজ্ঞান’
ভারতে গরু হত্যা করা বা খাওয়াকে অনেক সনাতন ধর্মের অনুসারী পাপ মনে করে। দেশটির ১৩০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশই সনতান ধর্মীয় অনুসারী।
গরু বিক্রি ও জবাই ভারতে বেশিরভাগ অংশে নিষিদ্ধ। ফলে প্রায়শই গরুগুলোকে রাস্তায় মুক্ত অবস্থায় বিচরণের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে বিপাকে পড়তে হয় গাড়ির চালকদের।
গরুর নিরাপত্তার খাতিরে রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ (আরকেএ) নামে একটি সংস্থা ২০১৯ সালে চালু করে মৎস্য, পশুপালন এবং দুগ্ধজাত মন্ত্রণালয়।
২০২১ সালে রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ ঘোষণা করে যে তারা ভারতজুড়ে ‘কামেধনু গো বিজ্ঞান প্রচার-প্রসার পরীক্ষা’নামে একটি পরীক্ষা নেবে।বিষয়টি নিয়ে গোটা দেশে শোরগোল পড়ে গেলে, তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় সরকার। কারণ পাঠ্যক্রমটিতে প্রাণী সম্পর্কে ব্যাপক অবৈজ্ঞানিক দাবি ছিল।
পাঠ্যক্রমের ৫৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়, বিশালাকার গোয়ালঘর বড় ভূমিকম্প ডেকে আনে। এর যুক্তিতে বলা হয়, হত্যার সময় গরু যে ব্যথা অনুভব করে, তা ভূমিকম্প সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট চাপ তৈরি করতে পারে।
প্রমাণ উপস্থাপন না করে পাঠ্যক্রমে আরও বলা হয়, দেশি (ভারতীয়) গাভী ‘বিদেশিগাভী’রতুলনায়সেরামানেরদুধউৎপাদনকরে।
রাজনৈতিক পশু
২০১৪ সালে হিন্দু-জাতীয়তাবাদের ঢেউয়ের তোড়ে নরেন্দ্র মোদির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে গরু নামে প্রাণীটি ক্রমশ রাজনৈতিক বিষয় হয়ে ওঠে।
মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) রক্ষণশীল হিন্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমালোচকরা বলছেন, মুসলিমদের ভয় দেখানো, হয়রানি এবং এমনকি হত্যার জন্য একটি হাতিয়ার হিসেবে গো-পূজাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে গো-রক্ষা নামে যেসব অপরাধ হয়, সেগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে বা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনি প্রচারের সময় ‘গোলাপী বিপ্লব’ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদি।গোলাপী বিপ্লব শব্দটি গবাদিপশু হত্যার বর্ণনা দিতে ব্যবহার করেছিলেন তিনি।
বিজেপি অন্য বিধায়করা বিষয়টিকে আরও এক ধাপ এগিয় নিয়েছেন।
উত্তর প্রদেশের বিধায়ক বিক্রম সাইনি ২০১৭ সালের মার্চে একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে যারা গরুকে তাদের মা মনে করবে না, তাদের হাত-পা ভেঙ্গে মেরে ফেলব।’
ভারতে নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার খবর প্রায়ই শিরোনাম হয়। এই প্রেক্ষাপটে এমন বিবৃতি ভারতে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। সমালোচকরা বলছেন, সরকারের মধ্যে একটি দ্বৈত মান রয়েছে, বিজেপি দুর্বল গোষ্ঠীগুলোকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট কাজ করছে না।
২০১৭ সালে ফটোগ্রাফার এবং অ্যাক্টিভিস্ট সুজাত্রো ঘোষের একটি ছবির সিরিজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল; যেখানে ভারতীয় নারীদের গরুর মুখোশ পরা অবস্থায় চিত্রিত করা হয়। এটি এমন একটি সমাজকে চিত্রিত করার উদ্দেশ্যে ছিল, যেখানে নারীর চেয়ে গরুর মূল্য বেশি।
সূত্র: সিএনএন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।