জুমবাংলা ডেস্ক : ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘জনস্বাস্থ্য সংকট’ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটলে এটি মহামারি পর্যায়ে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় আন্ত মন্ত্রণালয় টাস্ক ফোর্স গঠন ও সমন্বিত পদক্ষেপের তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে এক হাজার ২৪৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।
এ বছর এটাই এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী। একই সময় মারা গেছে পাঁচজন। এই নিয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত মোট মৃত্যু ৮৮ জন। হাসপাতালে মোট ভর্তি ১৬ হাজার ১৪৩ জন।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংজ্ঞা অনুযায়ী ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি মহামারি পর্যায় যায়নি। তবে এটি মহামারির কাছাকাছি। যদি আরো বেড়ে যায়, তাহলে এটাকে আমরা মহামারি বলব।’
অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘রোগ সম্পর্কে যে ধারণা করে থাকি, তার চেয়ে যদি অনেক বেশি বেড়ে যায়, তাহলে সেটাকে আমরা মহামারি পর্যায়ে বলি।
যেমন এবার ঢাকার বাইরে যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটা আমরা আশা করিনি। এটা হলো মহামারিরই নামান্তর। আবার কোনো জায়গায় কখনো কারো ডেঙ্গু হয়নি, কিন্তু সেখানে যদি একটি লোকের ডেঙ্গু হয়, তাহলেও সেটা মহামারি। এর বাইরে আরেকটা হলো, যদি কোনো একটা নিদিষ্ট জায়গায় গত পাঁচ বছরের তুলনায় গড়ে ডেঙ্গু অনেক বেশি হয়, তাহলেও সেটিকে আমরা মহামারি বলব।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি আমাদের দেশে এখন এন্ডামিক পর্যায়ে আছে।
অর্থাৎ রোগটা সারা বছর থাকবে কিন্তু মৌসুমে বাড়বে। তখন হাসপাতালে হাজার হাজার রোগী ভর্তি হবে। আবার কমে আসবে। যেটি আমাদের দেশে কয়েক বছর ধরে চলছে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এক সংবাদ সম্মেলনে ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘জনস্বাস্থ্য সংকট’ ঘোষণা করে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত রোডম্যাপ ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে।
এক দিনে মৃত্যু ৫, ভর্তি ১ হাজার ২৪৬
দেশে ডেঙ্গুতে এক দিনে আরো পাঁচজনের মৃত্যুতে জুলাইয়ের প্রথম ১২ দিনে মৃতের সংখ্যা ৪১ জনে পৌঁছাল। একই সময় মোট ভর্তি আট হাজার ১৬৫ জন। গত এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এক হাজার ২৪৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গতকাল সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৭০৯ জন ঢাকার ও ঢাকার বাইরে ৫৩৭ জন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন ঢাকার ও একজন রাজশাহীর। নতুন ভর্তি রোগীদের নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি তিন হাজার ৭৯১ জন। এর মধ্যে ঢাকায় দুই হাজার ৫৩০ জন ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে এক হাজার ২৬১ জন।
আন্ত মন্ত্রণালয় টাস্ক ফোর্স গঠনের তাগিদ
ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় আন্ত মন্ত্রণালয় টাস্ক ফোর্স গঠনের তাগিদ দিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, যখন কোনো অনিয়ন্ত্রিত রোগ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেটাকে মহামারি বলা যায়। আবার যখন একটা-দুটি এলাকায় থাকে তখন সেটাকে প্রাদুর্ভাব বলা হয়। সে হিসেবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি পর্যায়ে চলে গেছে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু যে জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি বা মহামারি পর্যায়ে, সেটির স্বীকৃতিই তো নেই। এটাকে গতানুগতিক হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ উপদেশ দেয় সিটি করপোরেশনকে, সিটি করপোরেশন উপদেশ দেয় স্বাস্থ্য বিভাগকে।
মুশতাক হোসেন বলেন, ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণের একটি নির্দেশিকা করেছে। সেটি মনে হয় কাগজেই পড়ে আছে। খুবই সুন্দর ছিল নির্দেশিকা। কী কী কাজ হবে, কারা কিভাবে করবে, সব আছে ওই নির্দেশিকায়। এটি কার্যকর করতে আন্ত মন্ত্রণালয় টাস্ক ফোর্স লাগবে। এ ছাড়া জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবার এগিয়ে আসতে হবে।
ডেঙ্গু নিয়েও সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি
চিকিৎসা বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে মহামারি না বলে জনস্বাস্থ্য সংকট’ বলা যায়। কারণ, মোট জনসংখ্যার তুলনায় রোগীর সংখ্যা খুব বেশি না। সে হিসাবে এখনই এটাকে মহামারি বলা যাবে না।
তিনি বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলা করতে হয় একটা কারিগরি কমিটির মাধ্যমে। এটি এখন জরুরি। ঠিক যেমন কভিডের সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে এক ধরনের সমন্বিত কমিটি গঠনের মাধ্যমে মোকাবেলা করেছিলাম। এতে সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, কীটতত্ত্ববিদ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।’
অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, শুধু ঢাকা নয়, জেলা পর্যায়েও এখন মশা নিধন জরুরি। এ ক্ষেত্রে কোন জায়গায় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হবে, কতটুকু ব্যবহার হবে, এ বিষয়টি পরামর্শ নিয়ে করতে হবে। এ ছাড়া জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা আরো জোরদার করতে হবে। যেহেতু ডেঙ্গুর ধরন বদলে গেছে, সুতরাং জেলা পর্যায়ে যাতে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে যেন রক্তের ব্যবস্থা থাকে, যাতে সহজে ও দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করা যায়। একই সঙ্গে জটিল রোগী সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকতে হবে।
সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা ৫০ টাকা
দেশের সব সরকারি হাসপাতালে আগামী এক মাস ডেঙ্গুর যেকোনো পরীক্ষার ফি ৫০ টাকা নির্ধারণ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল দেশের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, সিভিল সার্জন এবং সব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের এ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর এনএসওয়ান, আইজিজি এবং আইজিএম পরীক্ষা করতে ১০০ টাকা দিতে হতো। রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার সুবিধার্থে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের পরীক্ষার ফি ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) শেখ দাউদ আদনান বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি ৩০০ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। এটি গত বছর থেকে চলমান।
ডিএনসিসি কভিড হাসপাতাল ডেঙ্গু ডেডিকেটেড করার সিদ্ধান্ত
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হওয়ায় ডিএনসিসি কভিড হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) শাখার উপপরিচালক ডা. শফিকুল ইসলাম।
লার্ভা পাওয়ায় ছয় লাখ টাকা জরিমানা
ডিএনসিসি এলাকায় মাসব্যাপী মশক নিধন অভিযানের পঞ্চম দিনে গতকাল বুধবার এডিসের লার্ভা পাওয়ায় ১৬টি মামলায় মোট পাঁচ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো ১০টি নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জনগণ সচেতন হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব
তাপস জনগণ সচেতন হলে এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেছেন ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।