সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জের শিবালয়ে ‘ইছামতী জেনারেল হাসপাতাল’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রসূতি অস্ত্রোপচারের পর নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বুধবার এ দুর্ঘটনা ঘটে। মৃত নবজাতকের পিতা ফরিদুর রহমানের দাবি, চিকিৎসকের ভুলে তার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ফরিদুর রহমান শিবালয় ইউনিয়নের অন্বয়পুর গ্রামের শাখাওয়াত হোসেনের ছেলে। তিনি একজন ডেকোরেশন ব্যবসায়ী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৩ জানুয়ারি ৩৭ সপ্তাহের অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী সোনিয়া আক্তারকে (৩০) নিয়ে শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনী চিকিৎসকের কাছে যান স্বামী ফরিদুর রহমান। চিকিৎসক তাকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার পরামর্শ দিলে সোনিয়াকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিপরীত পাশে অবস্থিত ‘ইছামতী জেনারেল হাসপাতাল’ নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক শাহ আলমগীর তার আল্ট্রাসনোগ্রাফি, রক্ত ও ডায়াবেটিক পরীক্ষা করেন। আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে বাচ্চার ওজন দেখানো হয় দুই কেজি ৯০০ গ্রাম আর ডায়াবেটিক সাড়ে ৭।
ফরিদুর রহমান জানান, রিপোর্ট আসার পর চিকিৎসক জানান, বাচ্চার ওজন মাত্র দুই কেজি ৯০০ গ্রাম, কাজেই এক সপ্তাহ পরে সিজার করলে ভালো হবে। তবে যেহেতু একটু সমস্যা আছে, আপনারা রোগীকে ভর্তি করান, অক্সিজেন দিয়ে রাখেন, দেখেন সুস্থ হয় নাকি। এরপর রোগীকে ভর্তি করে অক্সিজেন দেওয়া হয়। এর ঘন্টা খানেক পর রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এরপর আমরা রোগীকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. মমিনূল ইসলাম ওই হাসপাতালেই সিজার করতে বলেন। রোগীর ডায়াবেটিক থাকায় আমরা জেলা শহরের কোন হাসপাতালে সিজার করতে চাই। কিন্তু ওই চিকিৎসকের পীড়াপীড়ীতে সিজার করতে রাজি হই।
ফরিদুর রহমান বলেন, গত বুধবার বেলা পৌঁণে একটার দিকে সোনিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নেওয়া হয়। ২০-২৫ মিনিট পর তাকে ওটি থেকে বের করে চিকিৎসক চলে যান। সিজারের পর বাচ্চা কোনো শব্দ না করে খিঁচুনি দিতে থাকে। এরপর তাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। আমরা বাচ্চাকে অন্যত্র নিয়ে যেতে চাইলে চিকিৎসক মমিনূল বারবার আমাদের আশ^স্ত করে বলেন, আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি, বাচ্চার কিছু হবে না। এরপর বেলা তিনটার দিকে আমরা নিজেরাই এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে বাচ্চাকে নিয়ে প্রথমে মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সেখান থেকে ফিরোজা জেনারেল হাসপাতাল ও পরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে যাই। শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, বাচ্চার আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে, শিশু হাসপাতালে আইসিইউ সিট খালি নেই। সেখান থেকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে দৈনিক ২২ হাজার টাকা চুক্তিতে আইসিইউ সিট পাওয়া যায়। তবে সেখানে নেওয়ার আগেই বাচ্চা মারা যায়।
রোগীর পরীক্ষা-নিরিক্ষার কাগজপত্র ঘেটে দেখা যায়, আল্ট্রাসনোগাফিতে বাচ্চার ওজন দেখানো হয়েছে দুই কেজি ৯০০ গ্রাম কিন্তু সিজারের পর বাচ্চার ওজন ছিল ৫ কেজি ১০০ গ্রাম।
ফরিদুর রহমান জানান, শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাদের জানিয়েছেন, ডায়াবেটিক আক্রান্ত রোগীকে ওই হাসপাতালে সিজার করা ঠিক হয়নি।
এদিকে, নবজাতকের মৃত্যুর পর প্রসূতি সোনিয়া আক্তারেরও শারীরিক অবস্থা অবনতি হতে থাকে। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভালো কোন হাসপাতালে রেফার্ড করার অনুরোধ জানান স্বজরা। তবে স্বজনদের অনুরোধ উপেক্ষা করে ইছামতী জেনারেল হাসপাতালেই সোনিয়ার চিকিৎসা দিতে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপর সোনিয়ার স্বজনরা জোরপূর্বক তাকে সেখান থেকে নিয়ে এসে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে ভর্তি করেন। এসময় ইছামতী জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর রাখেন। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা হয়। প্রসূতি সোনিয়া আক্তার বর্তমানে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় লেবার ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে ইছামতী জেনারেল হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. মুমিনূল ইসলাম বলেন, নবজাতক আধা ঘণ্টার মতো ভালো ছিল, এরপর শরীরের রং নীল হয়ে যায়। পরে তাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও কাজ না হলে মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। পরে সেখান থেকে চিকিৎসক ঢাকা শিশু হাসপাতালে পাঠান। সেখানেই শিশুটি মারা গেছে। এরপর প্রসূতি সোনিয়া আক্তারের শারীরিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। তারা এখান থেকে চলে যেতে চাইলে একটি কাগজে তাদের স্বাক্ষর রাখা হয়েছে।
হাসপাতালের অনেক ত্রুটি রয়েছে। জনবল ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সরঞ্জামেরও ঘাটতি রয়েছে বলে জানান এই চিকিৎসক।
এ বিষয়ে প্রসূতি সার্জন ডা. সালমা আক্তার বলেন, সাধারণত অপারেশনের পর বাচ্চা ও তার মায়ের অবস্থা ভালো থাকলে আমরা চলে আসি। ওই ঘটনায়ও বাচ্চা ও তার মা ভালো ছিল। এজন্য অপারেশন শেষ করেই আমি চলে এসেছি। বাচ্চাটার গ্রোথ একটি বেশি ছিল, যা অ্যাবনরমাল। বাচ্চার অবস্থা খারাপ হলে রেফার্ড করার কথা বলে এসেছি আমি।
বিষয়টি নিয়ে ইছামতী জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মো. আবু দাউদের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি নিজেকে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম এর সাংবাদিক পরিচয় দেন এবং বহু সাংবাদিকের সাথে সখ্যতা রয়েছে বলে দাবি করেন। হাসপাতালের বৈধ কাগজপত্র, জনবল ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তড়িঘরি করে হাসপাতালের লাইট ও দরজা বন্ধ করে সেখান থেকে চলে যান।
এ নিয়ে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আপনার কাছ থেকেই জানলাম। হাসপাতালটির বিষয়ে খোজঁখবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন ড. মকছেদুল মোমিন বলেন, নবজাতক মৃত্যুর বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর হাসপাতালের বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সাথে কথা বলে খোজঁখবর নেয়া হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।