জুমবাংলা ডেস্ক : আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রথম দফায় যে ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছিল, সেসব ব্যাংকে অস্বাভাবিক বেড়েছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় তিনগুণ বা ১ লাখ কোটি টাকার বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানান, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তা সামনে আসতে শুরু করেছে। ফলে লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।
জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহাসন এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করেছেন। এই ১৪ ব্যাংকের মধ্যে প্রথম দফায় ১১টি এবং দ্বিতীয় দফায় আরও তিনটি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দফায় পুনর্গঠন করা ১১ ব্যাংকে ছয় মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা বা প্রায় তিনগুণ। আর দ্বিতীয় দফায় পুনর্গঠন করা তিনটির মধ্যে একটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুন শেষে এই ১৪ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪৯ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। সূত্রগুলো বলছে, এই ব্যাংকগুলো থেকে এস আলম, বেক্সিমকোসহ কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপ ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হলে এসব ব্যাংকের অনিয়ম সামনে আসতে শুরু করে। এতে ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহক টাকা তুলে নেন। আবার কিছু ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহকের টাকা দিতে না পারায় ব্যাংক খাতে অস্থিরতা শুরু হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার পর ব্যাংক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ইসলামী ব্যাংকের। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩২ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ২১.০৮ শতাংশ। ছয় মাস আগে এর খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। ফলে ছয় মাসে খেলাপি বেড়েছে ২৫ হাজার ৯২ কোটি টাকা। গত আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় এই শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকটির পর্ষদে আধিপত্য বিস্তার করেছিল বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। এর হাতে ব্যাংকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে এই ব্যাংকটি ১৩ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে ভুগছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৬০.৫০ শতাংশ। ছয় মাস আগে জুনে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২০ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংকটির সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। কিন্তু ব্যাপক ঋণ অনিয়ম, সুশাসনের অভাব ও পরিচালকদের দ্বন্দ্বের কারণে এটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংকটিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সিকদার গ্রুপের। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসায়ী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হন। এই ব্যাংকটি এখন ১৮ হাজার ৭২০ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে ভুগছে।
ছয় মাসে ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২৪ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। গত জুন শেষে ছিল ১ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। এই রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের আগে এই ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের হাতে। এস আলম এই ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা সরিয়েছে। এসব ঋণ এখন খেলাপি হচ্ছে। একই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। গত বছরের জুন শেষে তা ছিল ২ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। এই ছয় মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এ ছাড়া সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। আর জুন শেষে ছিল ১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।
বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকেও ছয় মাসে খেলাপি ঋণে বড় লাফের তথ্য মিলেছে। তথ্য অনুযায়ী, এই ছয় মাসে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৩ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ছিল ১৭ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। গত বছরের জুন শেষে ছিল ৩ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। এই ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৭ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা।
ছয় মাসের ব্যবধানে ইউসিবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৪ হাজার ১১৫ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ঋণ ১ হাজার ৬৮৪ কোটি বেড়ে ৪ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা হয়েছে। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়ে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। এ ছাড়া শরিয়াভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের ১২৯ কোটি টাকা বেড়ে ডিসেম্বরে হয়েছে ১ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় দফায় গত সপ্তাহে আরও তিনটি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এদের মধ্যে একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে অপর দুটি ব্যাংকের কমেছে। তথ্য অনুযায়ী, ছয় মাসে মেঘনা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ১৯ কোটি টাকা ও এনআরবিসি ব্যাংকের ৩৩৯ কোটি টাকা। তবে এই সময় এনআরবি ব্যাংকের ১১৩ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।