জুমবাংলা ডেস্ক : সারাদেশে সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ বইছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে আমাদের দেশে এই হিটওয়েভ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে। বর্তমানে কিছু কিছু স্থানে তা প্রায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের ইতিহাসে রাজধানী ঢাকায় ১৯৬০ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ১৯৬৫ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দুই সিটি করপোরেশনেই বেড়েছে তাপমাত্রা
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) করা ২০১৭ ও ২০২৪ সালের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকার তাপমাত্রার তারতম্যের মূল্যায়ন সম্পর্কিত একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। ২০১৭ সালে রাজধানীর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৬.৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে ২০১৭ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩.৩৯ ডিগ্রি। ২০২৪ সেটি এসে দাঁড়িয়েছে ৩৭.৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়।
যেসব এলাকায় বেড়েছে তাপমাত্রা
ক্যাপসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গ্রীষ্মের সময়ে ২০১৭ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মতিঝিল এলাকায় তাপমাত্রা ছিল ৩৫.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা কিনা ২০২৪ সালে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। অর্থাৎ গত ৭ বছরের ব্যবধানে মতিঝিল এলাকায় তাপমাত্রা বেড়েছে ৩.৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জনবহুল এলাকা গুলিস্তানে ২০১৭ সালে তাপমাত্রা ছিল ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২৪ সালে এসে দেখা গেছে এ এলাকার বর্তমান তাপমাত্রা ৪০.০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ধানমণ্ডিতে ২০১৭ সালে তাপমাত্রা ছিল ৩২.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, চলতি বছরে তাপমাত্রা আগের তুলনায় বেড়ে হয়েছে ৩৮.০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ৭ বছরের ব্যবধানে ঢাকায় সবচেয়ে গরম বেড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে। সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে মহাখালীতে। এ এলাকায় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৭ ডিগ্রি। মহাখালীতে ২০১৭ সালে তাপমাত্রা ছিল ৩৩.৫০ ডিগ্রি, যা ২০২৪ সালে ৪১.০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে তেজগাঁও, মিরপুর ১০, ফার্মগেট এলাকায় গত ৭ বছরের তুলনায় তাপমাত্রা বেড়েছে সাড়ে ৩ ডিগ্রির বেশি।
পরিবেশ বিপর্যয় কী মানবসৃষ্ট?
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা যে ভাবেই বলি না কেন পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল কারিগর হল মানুষ। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সকল প্যারামিটার আমরা মাত্রারিক্ত ভাবে বেড়েই চলেছি। সারা বিশ্বের জীবশ্ম জ্বালানীর পোড়ানোর কাজ প্রতিদিন বেড়েই চলছে। এই সাথে আমাদের দেশের তো কথাই নেই। ১৯৫০ সাল থেকে আজ পযর্ন্ত তা কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন রেফ্রিজেরেটর এবং এসি ব্যবহারের পরিমাণ এক্সপোনেনমিয়ালভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বনায়ন ধ্বংসের পরিমাণ, অকল্পনীয় ভাবে এবং অপরিকল্পিত ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কনক্রিটের বাড়ী ঘর। এতগুলো বৃদ্ধির কবলে পড়ে যে মূল্যবান জিনিসটি হারিয়ে ফেলেছি তা হলো গ্রিন হাউজ গ্যাস গুলোকে গ্রহণ করে বাতাসকে বিশুদ্ধ ও পরিশুদ্ধ করে সেই সবুজ গাছপালাকে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্ম পরিকল্পনার তথ্য অনুসারে কোন আইডিয়াল শহর হলো যে শহরে ২৫ শতাংশ বনায়ন বা গাছপালা আছে। ২০২০ সালের এক জরিপে দেখা যায় ঢাকা শহরে বনায়নের পরিমান ৮ শতাংশ। বর্তমানে তা আারও কমে যাচ্ছে বিপরীত দিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইট পাথরের ইমারত আর ইট বানানোর ভাটা। ঢাকা শহরের প্রতিটি সিগন্যালে প্রতিদিন পড়ছে বিশাল বিশাল জ্যাম যা অকল্পনীয়ভাবে গ্রিন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যা এমন এক ট্র্যাপ তৈরি করছে যার মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে কিছু কিছু ওয়েভ লেন্থ বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করে আর সেই ট্র্যাপ থেকে বের হতে পারছে না। যার ফলে প্রতিনিয়তই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় কী?
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: রাজধানীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ নিতে হবে, তা হলো শহরের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে গাছ লাগাতে হবে।
রাস্তার বিভাজনে শোভাবর্ধনকারী গাছ ছাড়াও ভূমির ধরনের ভিত্তিতে বিভিন্ন রকম উপকারী বৃক্ষ; যেমন-বিভিন্ন ফলের গাছ, ঔষধি গাছ, কাষ্ঠল গাছ রোপণ করতে হবে। ছাদবাগান বৃদ্ধি করতে হবে। একটি বনাঞ্চল সরাসরি তাপ ও কার্বন নির্গমন হ্রাস করে।
রাজধানী ঢাকার জলাভূমির পরিমাণও বৃদ্ধি করতে হবে। দখলকৃত জলাভূমি উদ্ধার করতে হবে। জলাভূমি ভরাট করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও সচেতন হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং শহরাঞ্চল থেকে মানুষের আধিক্যতা কমাতে হবে। যত্রতত্র প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্লাস্টিক বর্জ্যকে যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। শহরের স্থানীয়, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
কাঙ্খিত বৃষ্টি আসলেই আসছে কিনা?
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন: আগামী ৭২ ঘণ্টায় যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, পাবনা, রাজশাহী, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর ও খুলনা জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যত্র মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি ভাব বিরাজমান থাকতে পারে। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া, দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। বৃহস্পতিবার ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে এবং সেই সাথে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলা বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া, দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। বিরাজমান তাপপ্রবাহের তীব্রতা হ্রাস পেতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।