আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য খ্যাতি রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের। পূজা হোক আর ঈদ হোক, সব উৎসবে শামিল হন সব সম্প্রদায়। সেই সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই রাজ্যের বারাসাত জেলার একটি হিন্দু পরিবার।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, হিন্দু ভিটায় গড়ে উঠেছে মসজিদ। আর তা রক্ষণাবেক্ষণ করছে একটি হিন্দু পরিবার। শুধু তাই নয়, সে পরিবারের সদস্য পার্থসারথি বোস সিয়াম সাধনার মাসে নিয়ম করে রোজাও পালন করেন। গত ১৫ বছর ধরেই রমজানে রোজা রেখে আসছেন তিনি। হিন্দু হয়েও কেন তিনি রোজা পালন করেন? জবাবে পার্থসারথি বলেন, রোজার মাসে আমি যথেষ্ট উপকার পেয়েছি। তাই আমি নিয়ম করে রোজা রাখি।
তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সালের আগে মসজিদের সঙ্গে আমার অত সম্পৃক্ততা ছিল না। বাবাই দেখাশোনা করতেন। কিন্তু সেবার রোজার মাসেই বন্ধুবান্ধবের সাথে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠি। এরপর মদ্যপ অবস্থায় বাইক থেকে পড়ে ডান হাতটা ভেঙে যায়। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা বলে দেন, এ হাঁড় জোড়া লাগবে না। সারারাত ঘুমোতে পারিনি। মনের মধ্যে অনুশোচনা জাগে, আমি বুঝতে পারি রমজান মাসে আমি অন্যায় করে ফেলেছি। পরদিন সকালেই মসজিদে যায়।
পার্থসারথি বোস আরও বলেন, মসজিদে এসে (স্রষ্টার কাছে) বলি আমার ভুল হয়ে গেছে আর কোনোদিন হবে না। আমাকে তুমি শাস্তি দিয়েছ। আমি সেই ছেলে হব, যে রমজান মাসে রোজা রাখবে। আর কোনোদিন জীবিত থাকা অবস্থায় রোজা ভাঙব না। আমার এই হাত জোড়া লাগিয়ে দাও, এই বলে মসজিদের মাটি আমার হাতে লাগাই। এরপর আমার হাত ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। হাড়ও জোড়া লেগে যায়।
পার্থসারথি বলেন, এই মসজিদ আমাকে এমন শিক্ষা দিয়েছে যে, এই মাসটা আমাকে ভালো থাকতেই হবে। আর ভালো থাকার উপায় হলো রোজা। সারাদিন রোজা রেখে এই সময়টা মসজিদে পড়ে থাকি। এ সময় আমার মনে কোনো শয়তানি আসে না, বাজে চিন্তা পোষণ করতে পারি না। কারণ আমার মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে। যদি আবার ভুল করি বা কিছু অন্যায় করি তাহলে আমার আবার ক্ষতি হবে। তারপর থেকেই রোজা রেখে আসছি।
১৯৬০ সালে সম্পত্তি বিনিময় প্রথার মাধ্যমে খুলনার আলকা গ্রাম থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান পার্থসারথির দাদা নিরদকৃষ্ণ বোস। ওঠেন বারাসাতের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে। বাস্তুভিটাতেই সন্ধান পান এক জীর্ণকায় মসজিদের। ভারত ছেড়ে খুলনায় চলে আসা মুসলিম পরিবারের কাছে নিরদ জানতে চান, বাস্তুতে একটি মসজিদের স্থাপত্য পাওয়া গেছে। কি করা উচিত?
বোস পরিবারকে খুলনার বাসিন্দা ওয়াজউদ্দিন মোড়ল জানিয়ে দেন, এখন সেটা আপনাদের সম্পত্তি। ফলে রাখবেন না ভেঙে দেবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু ধর্মপ্রাণ বোস পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, বাস্তুতেই থাক শতাব্দী প্রাচীন মসজিদটি। এমনটাই জানান, পার্থসারথির বাবা দীপক কুমার বোস।
নিরদ কুমার বোসের ছোট সন্তান দীপক কুমার বোসের বয়স এখন ৮২ বছর। ১৯৬৪ সালের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বিনিময় প্রথার মাধ্যমে বারাসাতে বাবা এই মুসলিম সম্পত্তি কিনেছিলেন। তখন আমি ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি। তখন মসজিদটি ভাঙাচোরা জীর্ণকায় স্তূপে পরিণত ছিল। চারিদিকে ছিল আগাছা এবং সাপেদের বাসস্থান।
দীপক কুমার জানান, সে আমলে মহল্লার লোকেরা বলেছিলেন, মসজিদটা ভেঙে দাও। কিন্তু বাবার ছিল চরম অমত। তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, মসজিদ যেই রকম আছে সেরকমই থাকবে। যদি আমার সাধ্যে কুলায় মেরামত করব। এরপর গঙ্গা পদ্মা দিয়ে বয়ে গেছে বহু পানি। আমার বাবা ছিলেন নিরেট ধার্মিক। নিজের ধর্মকে ভালোবাসতেন বলে অপরের ধর্মকে চিরকাল শ্রদ্ধা করে গেছেন।
দীপক কুমার বোস আরও বলেন, এরপর দেখাশোনা করতেন আমার বড় ভাইরা। দূরদূরান্ত থেকে দু-চারজন করে মুসলিম শুক্রবারে নামাজ পড়তে আসতেন। ধীরে ধীরে এই হিন্দু মহল্লায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মসজিদটি। আমরা নাম দিই আমানতি মসজিদ। একে একে ভাইয়েরা প্রয়াত হন। আমি সকলের ছোট, তাই আমার ওপর পড়ে মসজিদে দায়িত্ব।
তিনি বলেন, আমার এমন ভাগ্য যে, ভাইদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারায় এই জমি ভাগ আমার পড়ে। অন্য ভাইদের মধ্যে পড়লে কে কি করত জানি না। কিন্তু আমি জীবিত থাকতে এই জমি কোনোদিন আর হস্তান্তর হবে না। আক্ষেপের সুরে বলেন, দুঃখ লাগে চারিদিকে এখন শুধু বিভাজন।
বর্তমানে মসজিদের দায়িত্বে আছেন দীপক কুমার বোসের ছেলে পার্থসারথি বোস। তিনি জানান, এই মসজিদের দায়িত্বে এখন আমি আছি। সবার সহযোগিতায় মসজিদ নতুনভাবে গড়ে উঠছে। দুটো মিনার হয়েছে। ঈদের আগে খসে যাওয়া প্লাস্টারগুলো ঠিক করব। আমাদেরই অঞ্চলে হিন্দু মুসলমান মিলেমিশে থাকি।
বারাসাত ৮ নম্বর ওয়ার্ডে হিন্দুদের বসবাস। কোনো মুসলিম ভোটার নেই। ফলে পার্থসারথিদের আমানতি মসজিদে নামাজ পড়তে মুসল্লিরা আসেন দূরদূরান্ত থেকে। পার্থর অভিমত, বাবার দৌলতে ১৯৬০ সাল থেকে এই ওয়ার্ড যথেষ্ট শান্তিপ্রিয়। ওয়ার্ডে এই মসজিদের সাথে এখন সকলের সম্পৃক্ততা আছে। মায়ের পেটে যেমন শিশু থাকে, বলতে পারেন এই মসজিদ আমাদের সন্তান। সেভাবেই আগলে রেখেছি আমরা সকলে।
রোজার মাসে প্রতিদিন শতাধিক মুসল্লিকে ইফতার করায় বোস পরিবার। জুমায় ২০০ বেশি মানুষ নামাজ আদায় করেন। পার্থ জানান, আমার পরিবারে কেউ রোজা রাখেন না। কিন্তু সকলেই আমাকে সহযোগিতা করেন। ফজরের আগেই আমাকে আমার স্ত্রী জাগিয়ে দেয়। কয়েকটা খেজুর আর এক কাপ চিনি ছাড়া রং চা দিয়ে সেহরি সারি। সারাদিন কাজের ফাঁকে পড়ে থাকি মসজিদে। ইফতারিতে রাখি হালকা খাবার। খেজুর, পাঁচ রকম ফল, মুড়ি আর ঘুগনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।