জুমবাংলা ডেস্ক : ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনে ২০১০ সালে ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন মিরপুরের কাজী আকতারুজ্জামান। তার পরিবারের অন্তত পাঁচ-সাতজনও এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করেন। সব মিলিয়ে ডেসটিনিতে তাদের বিনিয়োগ ১৫ লাখ টাকারও বেশি। প্রায় ১০ বছর ধরে বন্ধ এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। বড় অঙ্কের এই অর্থ নিয়ে তাই পরিবারটির মধ্যে তৈরি হয়েছে বিবাদ।
শুধু আকতারের পরিবারই নয়। সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ অর্থলগ্নি করেন ডেসটিনির বিভিন্ন প্রকল্পে, কিন্তু সেই অর্থ ফিরে পাননি কেউ। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে ধরা পড়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র। ব্যবসার ধরন নিয়েও ওঠে প্রশ্ন।
সেই ডেসটিনি নিয়ে আবারও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড পরিচালনার হাইকোর্টের গঠন করে দেয়া বোর্ড কার্যক্রম শুরু করেছে। গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার দিকটিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, সার্ভার চালু করাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে বোর্ড।
দায়িত্ব পাওয়ার পর পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডেসটিনির নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শামছুল হক ভুঁইয়া। তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত তিনটি বোর্ড মিটিং হয়েছে। সহসাই শুরু হবে গ্রাহকদের দায়দেনা নিরূপণের কাজ। এ ছাড়া সম্পদ কারা কীভাবে ভোগদখল করছে, সে বিষয়েও নেয়া হচ্ছে খোঁজখবর।’
সচল করতে বোর্ড গঠন
গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড পরিচালনার জন্য বোর্ড গঠন করে দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে সাবেক জেলা জজ হাসান শাহেদ ফেরদৌস, ব্যারিস্টার মাগরুব কবীর ও এফসিএ ফখরুদ্দিন আহমদকে সদস্য করে পরিচালনা বোর্ড গঠন করে দেন আদালত।
বোর্ড গঠনের পর বোর্ডের তিনটি বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকগুলো থেকে এসেছে বিভিন্ন গাইডলাইন। সেই মোতাবেক চিঠিপত্র লেখা, আদালত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কিছু কাজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে যোগাযোগের কাজ চলমান আছে বলে বোর্ড সূত্র জানিয়েছে।
বৈঠকে ব্যবসা শুরু করার বিষয়েও আলোচনা হয়। তবে ব্যবসা শুরুর আগে সম্পত্তিগুলো অবমুক্ত করার ওপরই সবাই গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া আইটি সিস্টেম পুনরুদ্ধার করা, আদালতে সম্পত্তি অবমুক্ত করার জন্য আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে সদস্যরা যুক্তি দেন, ডেসটিনি হলো লিগ্যাল এনটিটি বা আইনি সত্তা। সে হিসেবে ডেসটিনির বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, মামলা আছে ব্যক্তির বিরুদ্ধে। ব্যক্তির বিরুদ্ধে করা মামলায় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ, মামলা নেই। পর্ষদের পর্যবেক্ষণ হলো, ডেসটিনি লিগ্যাল এনটিটি হওয়ায় এটা ফাংশন (সচল) করাতে কোনো বাধা নেই।
টাকা ফেরত পাবেন গ্রাহক
ডেসটিনির গ্রাহকদের শতভাগ টাকা পরিশোধের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে নতুন পর্ষদ। সম্পদ বিক্রি করে বা উদ্ধার করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়া যাবে বলে মনে করছেন পর্ষদের সদস্যরা।
বোর্ডের একাধিক সদস্য জানান, সম্পদ নিরূপণ এবং তারপর তা বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ডাটাবেজ থেকে বিনিয়োগকারীদের নাম এবং কে কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তা খতিয়ে দেখা হবে। তারপর অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়ায় এগোবে বোর্ড।
ডেসটিনির নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামছুল হক ভুঁইয়া জানান, ‘অর্থ ফিরিয়ে দিতে বর্তমান পরিচালকরা কাজ করছেন। যদি কারও কোনো দাবি থাকে সেই দাবিগুলো পরিশোধ করা পর্ষদের বড় লক্ষ্য। ডেসটিনির যে সম্পদ আছে এগুলো দিয়েই সব পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব। অনেকের মনে এটা নিয়ে শঙ্কা, দ্বিধা রয়েছে।’
দায়ের থেকে সম্পদ বেশি
ডেসটিনির সবগুলো প্রতিষ্ঠানের কাছে লাখ লাখ গ্রাহকের যে পাওনা আছে তার চেয়ে সম্পদের মূল্য কয়েক গুণ বেশি ৷ বর্তমানে ডেসটিনির যে সম্পদ আছে তার বাজারমূল্য ১০ হাজার কোটি টাকার ওপর। এমনটি জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘ডেসটিনির সব প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের পাওনা দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এটা মুখে মুখে প্রচলিত, নিরূপিত না। নিরূপিত হওয়ার পর দায়দেনা বোঝা যাবে। সব সম্পদ নিরূপণ হওয়ার পর গ্রাহকের পাওনা দিতে আর সমস্যা হবে না। এটার জন্য সার্ভার খুলে তথ্যভাণ্ডার দেখতে হবে। তখন বোঝা যাবে, ডেসটিনির কাছে কারা কত পান। সার্ভারে এখন কোনো সমস্যা নেই। এটা চালু করতে আইটি ফার্ম নিযুক্ত করা হয়েছে।’
সিইও জানান, সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংক হিসাবে ডেসটিনির সব প্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় শ কোটি টাকা রক্ষিত আছে।
যেভাবে গ্রাহক টাকা পাবেন
মূলত দুভাবে ডেসটিনির টাকা পাবেন গ্রাহক। ডেসটিনির বিভিন্ন প্যাকেজে যারা অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তাদের সেই বিনিয়োগের রসিদ জমা দিতে হবে। যাদের রসিদ নেই তারা অর্থ দাবি করলে ডেসটিনির সার্ভার থেকে তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখা হবে।
বর্তমান বোর্ডের এক কমকর্তা জানান, ‘বিনিয়োগকারী যদি মারা গিয়ে থাকেন তার পরিবারের অন্য সদস্য উপযুক্ত প্রমাণ দিলে অর্থ ফেরতের বিষয়ে সক্রিয় বিবেচনা করা হবে।’
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিতে চিঠি:
জব্দ করা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিতে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে নতুন বোর্ড। ডেসটিনি বোর্ডের সিইও জানান, ‘ডেসটিনির যেসব ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছিল এখন সেগুলো আর বহাল নেই, এমন তথ্য দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকলে সেখানে অ্যাপ্রোচ করতে হবে। আমরা সেটাও করা শুরু করেছি।’
ডেসটিনি বোর্ডের একজন সদস্য জানান, ‘কোম্পানির হেড অব লিগ্যাল, সিইও ও একজন মেম্বার দুদকের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। ডেসটিনি হলো লিগ্যাল এনটিটি এ বিষয়টি দুদককে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা ব্যবস্থাপনায় ছিল, অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে দুদক যেন ব্যবস্থা নেয় সে কথা বলা হয়েছে। কোম্পানি যেহেতু কোনো ক্ষতি করেনি, তাই এটা চালুর ব্যবস্থা করা দরকার। দুদক কিছু কাগজপত্র, নথি চেয়েছে। সেগুলোর ভিত্তিতে এটা চালুর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
বলা হয়ে থাকে, ডেসটিনির সব সম্পদ পুলিশের হেফাজতে আছে। কিন্তু হেফাজতে থাকা সত্ত্বেও মানুষ এটা থেকে আয় করছে, ব্যবহার করছে, সুবিধা নিচ্ছে।
অডিট ফার্ম নিয়োগ
ডেসটিনিতে নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে নিয়োগ দেয়া হবে অডিট ফার্ম। এ ক্ষেত্রে পুরোনো অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনায় যারা ছিলেন তাদের ডেকেছে নতুন বোর্ড। তারা কাজ শুরু করেছেন।
জানা গেছে, অ্যাকাউন্ট প্রস্তুত হলেই দুটি অডিট হবে। একটা গত ১২ বছরের অডিট, আরেকটা ২০১২ সাল পর্যন্ত একটা বিশেষ অডিট। সেই অডিটেই কোথায় কী অনিয়ম, টাকা-পয়সা কোথায় গেছে, কে কী অন্যায় করেছে সেটা দেখা হবে।
ব্যবসা কি আবার শুরু করা যাবে?
নতুন বোর্ড মনে করে, প্রতিষ্ঠান নয়, অনিয়ম করেছেন ব্যক্তি। তাই যারা এই প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ তছরুপ করেছেন, তাদের বিচার চলবে। কিন্তু সরকারের সব আইন-কানুন মেনে ব্যবসা শুরু করা হবে।
ডেসটিনির নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জানান, নতুন পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেবে কোন ধরনের ব্যবসা করবে। সরকারের আইন-কানুন, বিধিনিষেধ মেনে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেবে তারা। ব্যবসা শুরুর আগে ডেসটিনির যে বিষয়গুলো অন্যায়ভাবে বিভিন্ন জায়গায় যুক্ত করে রাখা হয়েছে, বিভিন্নভাবে দখল করা হয়েছে, বিভিন্ন মানুষ ডেসটিনির সুবিধাগুলো ব্যবহার করছে সেগুলো দেখতে হবে।
ডেসটিনির সম্পদ
ডেসটিনি গ্রুপের আয়-ব্যয় এবং দায়সহ সম্পত্তির পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরে তৎকালীন অর্থ উপদেষ্টা রণজিত চক্রবর্তী ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে একটি আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করেন। ‘ডেসটিনি গ্রুপ সম্পর্কিত প্রকৃত তথ্যাবলি’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনটি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়সহ নানা স্থানে সরবরাহ করা হয়।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেসটিনি গ্রুপের মোট ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত মূলধন ছিল ৪ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন ছিল ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। ২০০০ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরুর পর ২০১২ সালের মে পর্যন্ত ডেসটিনি ২০০০, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি (ডিএমসিএসএল) ও ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের (ডিটিপিএল) মোট আয় দাঁড়ায় ৫ হাজার ১২১ কোটি টাকা।
তবে প্রতিবেদনে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের দিকটিও উঠে আসে। বলা হয়, এই অর্থ থেকে কমিশন ব্যয় ১ হাজার ৪৫৬ কোটি এবং ট্যাক্স ও ভ্যাট পরিশোধ খাতে ব্যয় করা হয় ৪১০ কোটি টাকা। পণ্য ক্রয়ে ৪২৫ কোটি টাকা, লভ্যাংশ ও সুদ পরিশোধে ২৬৪ কোটি আর ২০০ অফিসের প্রশাসনিক ব্যয় দাঁড়ায় ৪৩৭ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে উঠে আসে বৃক্ষরোপণে বিনিয়োগ করা হয় ২২৩ কোটি টাকা। সম্পদ ক্রয় ও বিনিয়োগ খাতে ১ হাজার ৮৯০ কোটিসহ মোট ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। ডেসটিনি গ্রুপের এই তিনটি কোম্পানির মোট জমির পরিমাণ ৯৬৮ একর, ঢাকা শহরে অ্যাপার্টমেন্ট ছিল ৭৪ হাজার ৫৮ বর্গফুট।
এ ছাড়া বাণিজ্যিক অ্যাপার্টমেন্ট ছিল ২৪ হাজার ৫৪৭ বর্গফুট। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেসটিনি গ্রুপের মোট সম্পদের তখনকার মূল্য দাঁড়ায় ৯ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা।
পুলিশের তত্ত্বাবধানে সম্পত্তি
আজ থেকে অন্তত পাঁচ বছর আগে আদালতে জমা দেয়া পুলিশের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেসটিনির ৫৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৬টিই দেখানো হয় বেদখল। ১৯টি জমির মধ্যে ৯টি এবং ১৪টি স্থাপনার তিনটি তখন পুলিশ দখলে নিতে পারেনি।
পুলিশের জব্দ করা গাড়ি, বাড়ি ও জমির মালিকানা দাবি করে আদালতে গিয়ে আটটি গাড়ি জিম্মায় নেন কয়েকজন ব্যক্তি। জমির মালিকানা নির্ধারণের কয়েকটি আবেদনও বিচারাধীন ছিল তখন। ঢাকার কাকরাইলে রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলের পশ্চিম পাশে ডেসটিনির জমি পুলিশ দেখভালের দায়িত্ব নেয়ার পরও বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা ওই জমির মালিকানা দাবি করেন।
২০১২ সালের ৩১ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদার ও সহকারী পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন প্রজেক্টের অর্থ আত্মসাতের দুটি মামলা করেন। তার পর থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। শীর্ষ ব্যক্তিরা আছেন কারাগারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।