জুমবাংলা ডেস্ক : বুধবার বিকেল ৩টা ২৫ মিনিট। ঘটনাস্থল রাজধানীর ফুলবাড়িয়া। মাথার ওপর কড়া রোদ। বাসের অপেক্ষায় ইকবাল হোসেন। যাবেন কুড়িল বিশ্বরোড। যাত্রীর চাপে তিনটি বাসে উঠতে পারেননি। ২৫ মিনিট পর উঠলেন আকাশ পরিবহনের বাসে। গাদাগাদিতে দম নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। যানজটে বাস এগোচ্ছিল একটু একটু করে। গুলিস্তান, জিরো পয়েন্ট, পল্টন হয়ে কাকরাইল পৌঁছাতেই লেগে যায় ৫০ মিনিট। অথচ হেঁটেই ১৫ মিনিটে এটুকু পথ পাড়ি দেওয়া যায়।
শুধু ইকবাল হোসেন নন, ঢাকা শহরের সড়কে চলাচলকারী প্রায় সব মানুষেরই যানজট নিয়ে নিয়মিত অভিজ্ঞতা একই রকম।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে কর্মঘণ্টা ও জ্বালানির অপচয় হচ্ছে, বায়ুদূষণও বাড়ছে। আর্থিক ক্ষতির প্রভাব পড়ছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি)।
যানজটের কারণে ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ ধীরগতির শহরে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক গবেষণায় ঢাকার বিষয়ে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণার সূচকে ঢাকার পয়েন্ট ০.৬০।
পরের অবস্থানে নাইজেরিয়ার লাগোস, পয়েন্ট ০.৫২।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘দ্য ফাস্ট, দ্য স্লো, অ্যান্ড দ্য কনজাস্টেড : আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন রিচ অ্যান্ড পুওর কান্ট্রিস’ শীর্ষক ওই গবেষণা গত আগস্টে প্রকাশিত হয়। গবেষণায় পৃথিবীর ১৫২টি দেশের এক হাজার ২০০ শহর নিয়ে কাজ করা হয়। চীন ও উত্তর কোরিয়া গবেষণার আওতায় ছিল না।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ছাড়াও বিশ্বের শীর্ষ ২০ ধীরগতির শহরের তালিকায় বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের নামও আছে। ময়মনসিংহের অবস্থান নবম, চট্টগ্রাম ১২তম। উল্টো দিকে বিশ্বের শীর্ষ ২০ গতিশীল শহরের ১৯টিই যুক্তরাষ্ট্রে।
দরিদ্র ও ধনী দেশের তুলনা করতে গিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, গরিব দেশের তুলনায় ধনী দেশের শহরে গাড়ির গতি অন্তত ৫০ শতাংশ বেশি। যে শহরের গতি বেশি সে শহরের মাথাপিছু আয়ও বেশি।
গবেষণায় ধীরগতির সঙ্গে ঘনবসতির সম্পৃক্ততা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। অ্যালটো ইউনিভার্সিটির গবেষক প্রত্যয় এ আকবর বলেন, একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহর সব সময় ধীরগতির না-ও হতে পারে; আবার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরটিও সবচেয়ে ধীরগতির না-ও হতে পারে।
তথ্য-উপাত্তেও এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ২০ শহরের তালিকার শীর্ষে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা। অথচ এই তালিকায় ঢাকার নামই নেই। আর ঘনবসতিপূর্ণ না হয়েও ধীরগতির, এমন শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়।
সড়কব্যবস্থা, ঢাকার যানজট ও পরিবহন পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশে নিয়মিত গবেষণা করে থাকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এই গবেষণা প্রসঙ্গে এআরআইয়ের সাবেক পরিচালক ও বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘গবেষণার এমন ফলাফল নিয়ে আমরা চিন্তিত, এটা ভয়ংকর। এই গবেষণা অত্যন্ত যৌক্তিক। আমাদের যানজট মূল সড়ক থেকে শাখা সড়কে চলে যাচ্ছে।’
হাদিউজ্জামান বলেন, ‘আমরা আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনা একেবারেই করতে পারিনি। এ কারণেই যখন আমাদের সড়কে গাড়ির চাপ কম থাকে, তখনো বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় আমাদের শহর ধীরগতির হয়ে যায়। অবকাঠামো নির্মাণ করে যানজট কমানো আর সম্ভব না। এখন সময় এসেছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।’
২০২০ সালে করা বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, সড়কে ব্যস্ত সময়ে (পিক টাইমে) চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। ২০২২ সালে এই গতি নেমে এসেছে প্রায় ৪.৮ কিলোমিটারে। উল্টো দিকে শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষের হাঁটার গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় এর চেয়েও বেশি।
বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা প্রকাশনী সংস্থা প্লাস ওয়ান জার্নাল এক গবেষণায় বলছে, ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪.৯ কিলোমিটার। ৩০ থেকে ৫০ ঊর্ধ্ব বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫.১ কিলোমিটার। ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে এই গতি ঘণ্টায় ৪.৮২ কিলোমিটার। আর সত্তরোর্ধ্ব মানুষ ঘণ্টায় হাঁটতে পারেন ৪.৫ কিলোমিটার। এভাবে বিভিন্ন বয়সী মানুষের গড় হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪.৮৩ কিলোমিটার, যা বর্তমানে পিক টাইমে ঢাকার সড়কে চলা গাড়ির গতির চেয়েও বেশি।
ঢাকা শহরের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) আশঙ্কা করা হয়েছিল, ২০৩০ সালের দিকে সড়কে যানের গতি মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কমে আসতে পারে। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে ঢাকার সড়কের পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পরিকল্পনার কমতি দেখছেন না নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, আরএসটিপিতে হাঁটার জায়গা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে গণপরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সড়কের ভূমির সঠিক ব্যবহারেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যার কারণ হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি। সড়কে ৮০ শতাংশ জায়গাই বিলাসিতায় চলে যাচ্ছে।
এদিকে রাজধানীতে একজন মানুষের প্রতিদিন গড়ে দুই ঘণ্টা ৪৬ মিনিট যানজটে নষ্ট হচ্ছে। এভাবে বছর শেষে জনপ্রতি নষ্ট হয় ২৭৬ ঘণ্টা। যানজট বেশি থাকার কারণে পোড়াতে হচ্ছে বাড়তি জ্বালানি।
সব মিলিয়ে উৎপাদনশীলতা নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি বায়ুদূষণে মানুষের স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার চিকিৎসায় বছরে মাথাপিছু চার হাজার টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘রিডিউসিং পলিউশন ফর গ্রিন সিটি’ শীর্ষক এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। মূলত সংস্থাটি চলতি বছরের মে ও জুন মাসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ৫০০ পরিবারের ওপর জরিপ পরিচালনা করে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে। সূত্র : কালের কণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।