সূর্যাস্তের পরও যেন আপনার ইচ্ছাগুলো আলো ছড়ায়। রুমানা আক্তার (৪৫) গত মাসে স্ত্রীর স্মৃতিচারণায় কাঁদছিলেন, কিন্তু চোখে ছিল এক ধরনের স্বস্তি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর স্ত্রী শিল্পী একটি ডিজিটাল উইল তৈরি করেছিলেন। যেখানে শুধু সম্পত্তি বণ্টনই নয়, ডিজিটাল অ্যাসেটের পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে তার পছন্দের কবরের সুরা পর্যন্ত সব নির্দেশনা ছিল। “এই উইলটা না থাকলে হয়তো আজকে আমি ভাইদের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তাম,” বললেন রুমানা। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১.৫ লাখের বেশি মানুষ অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যান (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০২৩)। অথচ মাত্র ৮% বাঙালি কোনো উইল রেখে যান। ডিজিটাল বিপ্লবের এই যুগে, আপনার সমস্ত ইচ্ছাকে চিন্তামুক্তভাবে সংরক্ষণ করার এখনই সময়।
ডিজিটাল উইল কেন ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য?
“স্যার, আপনার ফেসবুক একাউন্টটা কীভাবে এক্সেস করব? মায়ের সব ছবি তো সেখানে!” – এমন হাজারো প্রশ্ন শুনেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সাইফুল ইসলাম। ডিজিটাল সম্পদ এখন শুধু সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট নয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি, ই-কমার্স স্টোর, ডিজিটাল আর্ট, এমনকি ক্লাউড স্টোরেজে থাকা পারিবারিক ছবিও এর অন্তর্ভুক্ত। আইনজীবী অধ্যাপক ড. তাসলিমা হক বলেন, “বাংলাদেশে ডিজিটাল সম্পদের মোট মূল্য ২০২৫ সাল নাগাদ ৮০০ কোটি ডলার ছাড়াবে (বিআইটিআই, ২০২৪)। কিন্তু সনদপত্র উইল শুধু ফিজিক্যাল সম্পত্তির কথা বলে। ডিজিটাল উইল ছাড়া এই সম্পদ আইনি জটিলতায় হারিয়ে যেতে পারে।”
বাস্তব উদাহরণ:
- ঢাকার উদ্যোক্তা রিয়াদের ই-কমার্স ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, কারণ তার মৃত্যুর পর ব্যবসার অ্যাডমিন এক্সেস কারও জানা ছিল না।
- নারায়ণগঞ্জের শিল্পী মিতার ডিজিটাল আর্ট কালেকশন বিক্রি হতে পারত, কিন্তু পাসওয়ার্ড না জানায় হারিয়ে যায়।
গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা:
- তাত্ক্ষণিক এক্সেস: পরিবার জরুরি ডকুমেন্ট পায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে
- সুরক্ষা: বায়োমেট্রিক এনক্রিপশন দিয়ে হ্যাকিং রোধ
- বহুমাত্রিকতা: শুধু টাকা-পয়সা নয়, আধ্যাত্মিক ইচ্ছা বা অঙ্গদানের অনুরোধও যোগ করা যায়
- পরিবেশবান্ধব: কাগজের অপচয় রোধ
ডিজিটাল উইল তৈরির প্রক্রিয়া: ধাপে ধাপে গাইড
ধাপ ১: সম্পদের ডিজিটাল ইনভেন্টরি তৈরি করুন
প্রথমেই তালিকা করুন আপনার সকল ডিজিটাল সম্পদ। যেমন:
- ইমেইল ও সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট
- ফিনটেক অ্যাপ (bKash, Nagad, Upay)
- ক্লাউড স্টোরেজ (Google Drive, iCloud)
- ক্রিপ্টো ওয়ালেট
- ডোমেইন নাম ও ওয়েবসাইট
পরামর্শ: বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী, ফিনান্সিয়াল অ্যাপগুলোতে নমিনি আলাদাভাবে যুক্ত করুন।
ধাপ ২: আইনগত বৈধতা নিশ্চিত করা
ঢাকার জেলা জজ আদালতের আইনজীবী এডভোকেট ফারহানা রহমানের মতে, “ডিজিটাল উইল বাংলাদেশে বৈধ, যদি তা ডিজিটাল সিগনেচার আইন ২০০৬ মেনে তৈরি হয়।” প্রক্রিয়াটি হলো:
- দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে উইল রেকর্ড করুন
- ডিজিটাল সার্টিফিকেট ব্যবহার করে ইলেক্ট্রনিক স্বাক্ষর করুন
- নোটারি পাবলিক বা রেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রেশন করুন (ফি: ২০০ টাকা)
ধাপ ৩: বিশ্বস্ত প্ল্যাটফর্ম নির্বাচন
বাংলাদেশে তিন ধরনের প্ল্যাটফর্ম আছে:
ধরণ | উদাহরণ | মূল্য (৳) | বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|---|
সরকারি | e-Wills (এজিও অফিস) | ৫০০-১০০০ | সর্বোচ্চ নিরাপত্তা, কিন্তু ধীরগতি |
প্রাইভেট সেবাদাতা | SecureWill BD, LegacyLocker | ২০০০/বছর | ইউজার ফ্রেন্ডলি, মাল্টিডিভাইস সাপোর্ট |
হাইব্রিড | LegalDhaka Pro | ১২,০০০ (এককালীন) | আইনজীবী কনসাল্টেশন + ডিজিটাল স্টোরেজ |
সতর্কতা: কোনো প্ল্যাটফর্মই পাসওয়ার্ড সরাসরি সংরক্ষণ করে না। তারা এনক্রিপ্টেড লিঙ্ক তৈরি করে, যা এক্সিকিউটরের কাছে শুধু মৃত্যুর পরই খুলবে।
ধাপ ৪: এক্সিকিউটর নিয়োগ করুন
আপনার “ডিজিটাল প্রতিনিধি” হবেন যিনি:
- প্রযুক্তিতে স্বচ্ছন্দ
- অতি বিশ্বস্ত
- আপনার পরিবারের সদস্য নন (দ্বন্দ্ব এড়াতে)
মোবাইল অ্যাপের সুবিধা: SecureWill BD-এর মতো অ্যাপগুলোতে জরুরি বাটন আছে। অসুস্থ হলে ট্যাপ করলেই এক্সিকিউটরকে অ্যালার্ট যাবে।
ডিজিটাল উইল ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
চ্যালেঞ্জ ১: প্রযুক্তিতে অনীহা
বুয়েটের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ কায়কোবাদ বলছেন, “৫৫+ বয়সীদের ৭০% এখনও ডিজিটাল উইল কনসেপ্টটাই বুঝতে পারেন না। সমাধান হলো স্থানীয় ভাষায় টিউটোরিয়াল।”
উদ্যোগ:
- আইসিটি ডিভিশনের “ডিজিটাল শান্তি” কর্মশালা
- গ্রামীণফোনের USSD সার্ভিস (*২২১# ডায়াল করে গাইডলাইন)
চ্যালেঞ্জ ২: আইনি ধোঁয়াশা
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম সতর্ক করছেন: “কেউ যদি উইলে ডিজিটাল কারেন্সি রেখে যান, তার লিগ্যালিটি এখনও পরিষ্কার নয়।”
পরামর্শ:
- ক্রিপ্টো সম্পদ আলাদা ডকুমেন্টে উল্লেখ করুন
- নমিনি হিসেবে প্রাপ্তবয়স্ক উত্তরাধিকারী যোগ করুন
ভবিষ্যতের দিকে: ব্লকচেইন ও এআই-এর ভূমিকা
বাংলাদেশে প্রথম ব্লকচেইন উইল চালু করেছে স্টার্টআপ “LegalChain”। এর সুবিধা:
- কোনো হ্যাকিং সম্ভব নয়
- স্বয়ংক্রিয়ভাবে মৃত্যু নিশ্চিত হলে উইল খুলবে (জাতীয় ডাটাবেসের সঙ্গে কানেক্টেড)
- স্মার্ট কন্ট্র্যাক্টের মাধ্যমে সম্পদ বণ্টন
এআই টুলস যেমন “BanglaWill Assistant”:
- প্রাকৃতিক বাংলায় উইল ড্রাফট করে
- আইনি ত্রুটি শনাক্ত করে
- উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পরামর্শ দেয়
জেনে রাখুন
ডিজিটাল উইল কি বাংলাদেশে আইনত বৈধ?
হ্যাঁ, ডিজিটাল সিগনেচার আইন ২০০৬ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুযায়ী ডিজিটাল উইল বৈধ। তবে এটি অবশ্যই দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে তৈরি করতে হবে এবং রেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
ডিজিটাল উইল তৈরির খরচ কত?
খরচ নির্ভর করে প্ল্যাটফর্মের উপর। সরকারি সেবায় খরচ ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। বেসরকারি অ্যাপের ক্ষেত্রে বার্ষিক ১০০০ থেকে ৫০০০ টাকা। আইনজীবীর মাধ্যমে করালে ৫০০০ থেকে ২০০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
ডিজিটাল উইল হ্যাক হলে কী হবে?
ভালো প্ল্যাটফর্মগুলো এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন ব্যবহার করে। এছাড়া বাংলাদেশ সাইবার সিকিউরিটি ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিমের (বিডিসিইআরটি) কাছে প্রতিবেদন করলে তারা সহায়তা করে।
কাগজের উইল থাকলে ডিজিটাল উইল দরকার কি?
হ্যাঁ, কারণ কাগজের উইলে ডিজিটাল সম্পদের উল্লেখ থাকে না। অনেক দেশে “ডিজিটাল এজেন্ট” নিয়োগ বাধ্যতামূলক। ডিজিটাল উইল আপনার সমস্ত সম্পদ একসাথে সংরক্ষণ করে।
ডিজিটাল উইল বাতিল বা পরিবর্তন করা যায়?
হ্যাঁ, যেকোনো সময় আপনি উইল আপডেট বা বাতিল করতে পারবেন। প্রতিবার পরিবর্তনের পর নতুন করে ডিজিটাল সিগনেচার ও সাক্ষী প্রয়োজন।
ডিজিটাল উইল তৈরি শুধু সম্পদ রক্ষার হাতিয়ার নয়; এটি আপনার ভালোবাসার চিরন্তন অভিব্যক্তি। যেখানে আপনার পছন্দের গানের প্লেলিস্ট থেকে শুরু করে প্রিয়জনের জন্য রেখে যাওয়া গোপন বার্তাও ঠাঁই পায়। আজই সময় আপনার ডিজিটাল জীবনকে সুসংহত করা শুরু করার। একটি ডিজিটাল উইল শুধু কাগজের টুকরো নয় – তা আপনার অনুপস্থিতিতেও প্রিয়জনকে দেওয়া নিরাপত্তার আলিঙ্গন। ভবিষ্যতের জন্য চিন্তামুক্তি নামক এই সুরক্ষা কবচটি আজই তৈরি করুন, কারণ কালকের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।