লাইফস্টাইল ডেস্ক : নবুয়তের একেবারে গোড়ার দিকের কথা। হেরা গুহায় জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ওহি নিয়ে এসেছেন কয়েক মাস আগে। প্রথম দিকে অবশ্য একটু বিরতি দিয়েই অহি নাজিল হতো। এ বিরতি রাসুলের জন্য ছিল আশঙ্কা আর পেরেশানির।
আশঙ্কা হলো, নবুয়তের মহান দায়িত্ব পালনের কোনো রোডম্যাপ এখনো তৈরি হয়নি। অন্যদিকে মানুষকে কিভাবে আল্লাহমুখী করা যায়, পথ দেখানো যায়—এ চিন্তায় তিনি ছিলেন পেরেশান। এমন সময় ঘটল আরেক বিপত্তি। কুরাইশ নেতারা দারুন নদওয়ায় পরামর্শ সভা ডেকে নবীজি (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন কটু কথা বলল।
তারা বলল, ‘গাছ ছোট থাকতেই উপড়ে ফেলা হোক। আবদুল্লাহর এতিম ছেলে মুহাম্মদকে বেশিদূর এগোতে দেওয়া যাবে না।’ ‘তাহলে কী করণীয়’—একজন জানতে চায়।
‘সমাজে রটিয়ে দাও মুহাম্মদ পাগল হয়ে গেছে।’ আরেকজন বলল, ‘কিন্তু সে তো পাগল না।’
‘তাহলে বলো সে গণক।’
বলা হলো, ‘সে তো গণক না।’
বলো, মুহাম্মদ জাদুকর। বলা হলো—‘সে তো জাদুও দেখায় না।’
একে একে সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হয়। হওয়ারই কথা। রাসুল (সা.) তো বাইরে থেকে আসা কোনো মানুষ নন। তিনি কুরাইশদেরই সন্তান। তাঁর অনুপম চারিত্রিক উত্কর্ষের সাক্ষ্য এতকাল তারাই দিয়েছে। হঠাৎ কিভাবে পরম সত্যবাদী মানুষটিকে তারা পাগল-গণক-জাদুকর বলে! সেদিনের মতো সভা শেষ হয়েছে। কিন্তু সে সভার কার্যবিবরণী কিভাবে যেন নবীজি জেনে ফেলেন। কয়েক দিন হলো দাওয়াতি মিশন শুরু হয়েছে। যে কুরাইশদের সঙ্গে কাজ এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে, তারাই থামিয়ে দিতে চাইছে! মনে মনে নবীজি কিছুটা দমে গেলেন। দূরের মানুষ বিরোধিতা করলে কাছের মানুষজনকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবেলা করা যায়; কিন্তু কাছের মানুষ যদি বিরোধিতা করে তখন কোথাও আর যাওয়ার থাকে না। রাসুল (সা.) মন খারাপ করে চাদর মুড়ি দিয়ে জড়সড় হয়ে শুয়ে রইলেন।
নবীজির মন খারাপ হয়েছে কাছের মানুষরা তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়েছে বলে। আসলে আল্লাহর ফায়সালা অন্য রকম। কাছের মানুষ যাকে দূরে ঠেলে দেয় আল্লাহ তাকে বুকে টেনে নেন। ঘুমিয়ে থাকা সন্তানের কপালে মা যেমন চুমু এঁকে মায়া ভরা কণ্ঠে স্কুলে যাওয়ার জন্য ডেকে তোলেন, আল্লাহও নবীজিকে পরম মমতায় ডাক দিলেন, ‘ইয়া আইয়্যুহাল মুজাম্মিল। কুমিল্লায়লা ইল্লা কালিলা।’ হে চাদর জড়ানো নবী! রাত যত গভীর হোক, ভয় পেয়ো না। দাঁড়াও।’ (তাফসিরে মাজহারি, ১০ খণ্ড, ১০২ পৃষ্ঠা)
‘ইয়া আইয়্যুহাল মুজাম্মিল। কুমিল্লায়লা ইল্লা কালিলা।’ আরবি ভাষাতত্ত্ববিদরা বলেন, ‘মুজাম্মিল’ শব্দটি এসেছে ‘তাজাম্মুল’ শব্দ থেকে। অর্থ চাদর বা কোনো কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা ব্যক্তি। মুজাম্মিল শব্দটি নবীজির ক্ষেত্রে ব্যবহার করলে এর অর্থ হবে, হে চাদরাবৃত নবী! মন খারাপ কিংবা ভয় পাওয়া তোমার চলবে না। ‘কুমিল্লায়লা ইল্লা কালিলা’-এর সহজ অনুবাদ হলো, রাতের কিছু অংশ দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ পড়ো। তবে ভাবার্থ আরো অর্থপূর্ণ। কুম মানে হলো দাঁড়াও। জেগো ওঠো। বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হও। লায়ল মানে রাত। অন্ধকার, বিপদ, বাধা, বিপত্তি, জুলুম, নির্যাতন অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নবীজিকে বলছেন, ‘হে মুহাম্মদ (সা.)! তোমার এখন চাদর জড়িয়ে আরামে ঘুমানোর সময় নয়। তোমার সামনে মহান দায়িত্ব। বিশ্বমানবতার বোঝা তোমার কাঁধে। ভয় পেয়ো না। সাহস করে দাঁড়াও।’ দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই নবীজি দেখলেন চারদিকে ঘোর অন্ধকার। যেনতেন অন্ধকার নয়। একেবারে আইয়ামে জাহেলিয়াতের নিকষ অন্ধকার। এ অন্ধকারের বুক চিরেই তাঁকে আলোর সূর্য আনতে হবে। সামনের দিনগুলো তাঁর জন্য আরো কঠিন। তাই আল্লাহ তাঁকে বলেন, ‘কুমিল্লায়লা ইল্লা কালিলা’—এখন থেকে নিজেকে রাঙিয়ে নাও তাহাজ্জুদের রঙে।
আজকের দুনিয়ায় যাঁরা নবুয়তি মিশনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন, তাঁদের জন্য ‘ইয়া আইয়্যুহাল মুজাম্মিল। কুমিল্লায়লা ইল্লা কালিলা’—এ দুটি আয়াতে রয়েছে অনেক বড় শিক্ষা। নবুয়তি মিশনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আরামের চাদরে ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নেই। সুযোগ নেই মিথ্যা আর মুনাফিকির আড়ালে নিজেকে লুকানোর। হিকমতের দোহাই দিয়ে বাতিলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সুযোগও নেই দায়িত্বশীলদের। সব ধরনের ভয়-জড়তা-নিফাকি ঝেড়ে ফেলে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে হবে।
যেন ইসলামের দুশমনরা সামনে আসতেও ভেবে-চিন্তে আসে। যাদের কাঁধে দাওয়াতি মিশনের দায়িত্ব, তাদের সামনে অবশ্যই অনেক কালো রাত আসবে। বিপদের পাহাড় আসবে। লোভের হাতছানি আসবে। নারীর প্রলোভন আসবে। একজন দায়িত্বশীল দাঈ বিপদে যেমন ভয় পাবে না, তেমনি লোভের ফাঁদেও পা দেবে না। ইসলামবিরোধী শক্তি যুগে যুগে দ্বিনের দাঈদের লোভ ও লাভের প্রলোভন দিয়ে বিপথগামী করতে চেয়েছিল। খোদ নবীজিকেও ধনসম্পদ-ক্ষমতা আর নারীর লোভ দেখিয়ে বলা হয়েছিল—‘হে মুহাম্মদ! সত্যের দাওয়াত থেকে সরে আসো। তুমি যা চাইবে তাই পাবে।’ জবাবে নবীজি বলেছেন, ‘দুনিয়ার সম্পদ তো দূরে থাক, তোমরা যদি চাঁদ আর সূর্যও আমাকে এনে দাও, নবুয়তি মিশন থেকে আমি এক পা-ও সরে দাঁড়াব না।’ হে আল্লাহ! দ্বিনের রাহবারদের ঈমানি শক্তি আপনি বাড়িয়ে দিন। আমিন।
শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।