হাসান মেজর : অক্টোবর মাসের ২ তারিখ। দুপুরের দিকে মেট্রোতে চড়ে একটা জরুরি কাজে আমি উত্তরায় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন স্যারের ফোন। জানতে চাইলেন, আমি মেইল চেক করেছি কি না। সাারণতঃ মেইল চেক করলেও নিউজ সংশ্লিষ্ট মেইল ছাড়া অন্যগুলো আমি তেমন ওপেন করে দেখি না। আমি জানতে চাইলাম কি বিষয়ে স্যার? সঙ্গে সঙ্গে স্যার একটা স্ক্রিনশট পাঠালেন আমাকে। আমি সেটা দেখে যতটা না অবাক হয়েছি তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি একজন জাপানি অধ্যাপকের আন্তরিকতা দেখে। আমাকে মেইল করেছেন জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটির মানবিক অনুষদের অধ্যাপক গিও মিয়াহারা (Gyo Miyahara)। মেইলের সিসি দিয়েছেন আলা উদ্দিন স্যারকে।
মেইলে আমাকে গেস্ট লেকচারার হিসেবে তাদের একটি কোর্সে বাংলাদেশের সমসাময়িক গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লেকচার দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দুই ঘন্টার লেকচার সেসনের প্রথম ঘন্টায় আমার প্রেজেন্টেশন এবং দ্বিতীয় ঘন্টায় প্রশ্নোত্তর। লেকচার দেওয়ার জন্য অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং আগামী জানুয়ারি মাসের কয়েকটি তারিখ ও বাংলাদেশ সময় উল্লেখ করে আমার সুবিধামতো একটি তারিখ বেছে নিতে বলা হয়।
বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি থেকে এমন আমন্ত্রণ পাওয়া সত্যি সত্যিই অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। ভালো লাগার পাশাপাশি আমার মধ্যে নার্ভাসনেসও কাজ করতে থাকে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম লেকচার দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার যে একেবারেই নাই। দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছি। তখন থেকে একাডেমিক চর্চাও তেমন করা হয়ে উঠেনি। পুরো মনোযোগ ছিল সাংবাদিকতায়। বিষয়টি আলা উদ্দিন স্যারের সাথে শেয়ার করলাম। স্যার বললেন, ‘আগে প্রেজেন্টেশন রেডি করো, দেখবে কনফিডেন্স চলে এসেছে।’
যাহোক, আমি ফিরতি মেইলে নভেম্বরের ১৪ তারিখ বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৫টায় লেকচার দেওয়ার জন্য সম্মতি জানাই।
গত ফ্রেব্রুয়ারি মাসের কথা। জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে চারজনের একটি ডেলিগেশন গবেষণার কাজে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে এই ডেলিগেশনে যুক্ত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন স্যার। আমার মেয়ে অনন্যা হাসান অনুর জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহের কথা জানতেন স্যার। তিনি ১২ ফেব্রুয়ারি আমাকে ফোনে জানালেন, ‘যদি সম্ভব হয় তোমার মেয়েকে নিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলায় আসো। সেখানে ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে আসা ডেলিগেশন থাকবে। অনন্যা ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে খুব খুশি হবে।’
১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে অনন্যাকে নিয়ে বইমেলায় গেলাম। সেখানে দেখা হলো ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে আসা তিনজন শিক্ষক ও একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। আলা উদ্দিন স্যার আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বন্ধু রবিনও যুক্ত হলো আমাদের সঙ্গে। আমরা একসাথে পুরো বইমেলা ঘুরলাম। অনন্যা ইতোমধ্যে আধো-আধো জাপানি ও সাবলীল ইংরেজিতে তাদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। পরে আমরা বেইলি রোডে এসে সবাই মিলে একসাথে ডিনারও করলাম।
ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে আসা তিনজন শিক্ষকের মধ্যে একজন ছিলেন মানবিক অনুষদের অধ্যাপক গিও মিয়াহারা (Gyo Miyahara)। ডিনার ও আড্ডার ফাঁকে তিনি বাংলাদেশের মিডিয়া ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চান। আমিও কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করি। পরে গবেষণার কাজ শেষে বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার সময় তাদের সাথে আরও একবার দেখা হয়। সেখানেই শেষ। এরপর আর কোনও যোগাযোগ হয়নি।
প্রায় আট মাস পর হঠাৎ লেকচার দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে অধ্যাপক গিও মিয়াহারার (Gyo Miyahara) পাঠানো মেইল পেয়ে সত্যিই আমি তাঁর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছি। আসলে জাপানিরা এমনই হয়। তাদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সর্বজনবিদিত। তারা কাউকে কোনও কাজের জন্য যোগ্য মনে করলে তাকে মূল্যায়ন করতে কুন্ঠাবোধ করেন না। আমাকে মনে রেখে লেকচার দেওয়ার আমন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি জানিয়ে দিলেন জাপানিরা সহজে কাউকে ভুলে যায় না।
জাপানিদের সম্পর্কে অনেক গল্প শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল চট্টগ্রামে নিযুক্ত জাপানের সাবেক অনারেরি কনসাল জেনারেল শ্রদ্ধেয় মুহম্মদ নূরুল ইসলাম ভাইয়ের কাছ থেকে। আমি তখন চট্টগ্রামে সাংবাদিকতা করতাম। আগ্রাবাদ গেলেই চলে যেতাম নিপ্পন একাডেমিতে। সেখানে বসতেন নূরুল ইসলাম ভাই। ২০১২ সালে তাঁকে জাপানের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান’ প্রদান করা হয়। জাপানিদের গল্প বলার পাশাপাশি আমাকে সেসময় জাপানিজ ভাষা শেখানোরও অনেক চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
গল্পে নূরুল ইসলাম ভাই জাপানিরা কিভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালিত পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি মনেপ্রাণে ধারণ করে তা বলতেন। বলতেন কিভাবে বিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি গুরুত্বের সঙ্গে শিশুদের আচার-আচরণ শেখানো হয়, বয়স্কদের সম্মান, রাস্তা পারাপারে সহায়তা, মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেওয়া, সবাই মিলে কাজ করার শিক্ষা শিশুদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়। সেখানে শিক্ষার পাশাপাশি শৃঙ্খলাবোধ এবং পরিবার, সমাজ আর মানুষের প্রতি উদার ও দায়িত্বশীল করে শিক্ষার্থীদের কিভাবে গড়ে তোলা হয় সে গল্পও শোনাতেন তিনি। তখন থেকে আমি জাপানের একজন ভক্ত। যদিও তাদের ভাষাটা আর শেখা হয়নি।
আলা উদ্দিন স্যার জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেছিলেন। স্যারের কাছেও জাপানিদের সম্পর্কে অনেক গল্প শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। শুধু নিজের জন্য নয় বরং পুরো সমাজের জন্য চিন্তার চর্চা করে জাপানিরা। তাই জাপানিরা অন্যের অলক্ষেও অপরাধ বা অনৈতিক কাজ করে না, যা অপরের বা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) নির্ধারিত সময়ে অনলাইনে যুক্ত হয়ে আমার প্রেজেন্টেশন শুরু করলাম। সেখানে লেকচার গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন ওসাকা ইউনিভার্সিটির মানবিক অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। শুরুতে আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের সংক্ষেপে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করি। এরপর বাংলাদেশের গণমাধ্যম, গণমাধ্যমের মালিকানা, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে সাংবাদিকদের ভূমিকা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কাভারেজ, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ফিলিস্তিন পরিস্থিতির কাভারেজ, গণমাধ্যমে আমার কাজ এবং অনলাইন গণমাধ্যম হিসেবে আমার সম্পাদিত জুমবাংলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে টানা এক ঘন্টা কথা বলি। ১০ মিনিটের একটা সংক্ষিপ্ত বিরতির পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব।
প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরুতে প্রশ্ন আসে শিক্ষকদের মধ্য থেকে। এরপর শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করেন। এই পর্বে সাংবাদিকতাকে কেন আমি ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছি, বাংলাদেশে ক্যারিয়ার হিসেবে সাংবাদিকতা কেমন, কাজ করতে গিয়ে কখনও হুমকির শিকার হয়েছি কি না, অনলাইন গণমাধ্যম ও ভুয়া খবর, বাংলাদেশে সম্প্রতি যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে গেল সেখানে সাংবাদিকদের ভূমিকা কি ছিল, জাপানকে বাংলাদেশিরা কিভাবে দেখে এবং বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।
প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরু থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আলা উদ্দিন স্যারের যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও তিনি ইন্টারনেট সমস্যার কারণে যুক্ত হতে পারছিলেন না। তবে শেষের দিকে যুক্ত হতে সক্ষম হন। স্যারও কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দেন।
বাংলাদেশ এবং এদেশের গণমাধ্যম নিয়ে জাপানের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আমাকে অভিভূত করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে জাপানি শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা আমার হৃদয় ছুঁয়েছে। জাপানিরা বাংলাদেশকে চিনে পতাকার সাদৃশ্যের কারণে। বাংলাদেশের পতাকা গাঢ় সবুজের মধ্যে লাল বৃত্ত আর জাপানের পতাকা সাদার মাঝে লাল বৃত্ত। লাল বৃত্তের দুই দেশের পতাকার এই অদ্ভুত মিলের কারণে বাংলাদেশকে যেমন জাপানিদের অনেক কাছে টেনেছে তেমনি জাপানকেও অনেক আপন মনে করে বাংলাদেশিরা। এছাড়া বিস্তীর্ণ ধানখেতের প্রাচুর্যকে দুই দেশের মানুষের আত্মিক সৌহার্দ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে পরিচিত। আর জাপানকে বলা হয় ‘ধানের দেশ’।
গতকাল (১৫ নভেম্বর) অধ্যাপক গিও মিয়াহারা (Gyo Miyahara) আমার লেকচারের প্রশংসা করে একটি মেইল পাঠিয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি এবং তাঁর শিক্ষার্থীদের অধিকতর পড়াশোনার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। এটা সত্যি সত্যি অনেক ভালো লাগার একটা বিষয় যে জাপানিরা বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও বেশি জানতে চায়।
বন্ধুত্বের সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জাপান এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আস্থা ও নির্ভরশীলতার বড় অংশীদার। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের যেকোনো দুর্যোগ ও বিপদের সময় নিঃস্বার্থভাবে পাশে থেকেছে পূর্ব এশিয়ার দেশটি। বাংলাদেশে যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তার নেপথ্যের বড় নায়কও জাপান। দুই দেশের মানুষের মধ্যে জানাশোনার পরিধিটা বাড়লে আমাদের বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার মেলবন্ধন আরও দৃঢ় হবে-এটা আমার বিশ্বাস।
লেখক : সম্পাদক, জুমবাংলা.কম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।