মারুফ ইসলাম : খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সারা দিন কাজ করা ভালো নাকি সারা রাত জেগে কাজ করে সকালে ঘুমাতে যাওয়া ভালো—এ নিয়ে বিতর্কটি বেশ পুরনো। তবে পৃথিবী যেমন শতকোটি বছরের পুরনো হলেও তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় না, তেমনি কোনও বিতর্ক পুরনো হয়ে গেলেই তার আবেদন ফুরিয়ে যায় না। তাই রাত জাগা মানুষ বনাম ভোরে ওঠা মানুষের বিতর্ক আজও চলছে। চলছে এ নিয়ে গবেষণাও।
সম্প্রতি দ্য ইকনোমিস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, আমেরিকার বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের দুই–তৃতীয়াংশ ভোর ৬টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠেন। এই তালিকায় আছেন অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক থেকে শুরু করে মিডিয়া জায়ান্ট ডিজনির প্রধান নির্বাহী বব ইগারও। তাঁরা প্রত্যেকেই ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠেন। এ থেকে একটি বার্তা বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়—যাঁরা করপোরটে দুনিয়ার সফল হতে চান, তাঁদের ভোরের পাখি হতে হবে।
ভোরের পাখি হওয়ার বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন—আপনি যদি সূর্য ওঠার আগেই দিন শুরু করতে পারেন, তাহলে আপনার প্রতিদিনের নিয়মিত কাজ, যেমন: ইমেইল দেখা, মিটিং করা ইত্যাদি শুরু করার আগেই অন্যান্য জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান আপনি করে ফেলতে পারেন। একটি জটিল কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করার ফলে আপনি শান্তিবোধ করেন এবং আপনার পুরো দিনটিই তখন ভালো কাটে।
যাঁরা ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন, তাঁদের জীপনযাপন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ভোরে জাগা মানুষেরা সকালের শান্ত সময়ে বরফ–পানিতে গোসল করেন, প্রার্থনা করেন এবং মন ভরে কফি পান করেন। এভাবে যাঁরা দিন শুরু করেন, তাঁদের শরীর–মন ভালো না হয়ে উপায় আছে?
আপনি ব্যবসাবিষয়ক পরামর্শক ও প্রশিক্ষক ক্রিস ক্রোনের সেই জনপ্রিয় ভিডিওটি দেখেছেন? ভিডিওটিতে তিনি বলছেন, কেন ভোর ৪ টায় তিনি ঘুম থেকে ওঠেন এবং এতে কীভাবে তাঁর মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে।
ভোরে ঘুম থেকে উঠলে মন তো ভালো থাকেই, শরীরও সুস্থ থাকে। ২০১২ সালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা করেছিলেন রেনি বিস এবং লিন হ্যাশার নামের দুই গবেষক। জরিপভিত্তিক ওই গবেষণায় বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, যারা তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যান এবং ভোর বেলায় ঘুম থেকে ওঠেন তারা সুস্থ ও সুখী বোধ করেন। আর যারা দেরিতে ঘুমাতে যান, তারা বলেছেন, তাদের মেজাজ খিটখিটে থাকে এবং কাজে মনযোগ কমে যায়।
মেজাজ যদি খিটখিটে থাকে, শরীর যদি ঝরঝরে না থাকে, তার নেতিবাচক প্রভাব তো কাজের ওপর পড়বেই। ফলে ওইসব ব্যক্তির আয়–উপার্জনও কমে যায়। ফিনল্যান্ডের ওলু ইউনিভার্সিটির গবেষক অ্যান্ড্রু কনলিন এবং তাঁর সহ-লেখকেরা একটি গবেষণা প্রবন্ধে বলেছেন, যেসব পুরুষেরা দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন, তাঁরা ভোরে ঘুম থেকে ওঠাদের তুলনায় ৪ শতাংশ কম উপার্জন করেন।
আয়–উপার্জন কমে যাওয়ার আরও কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা। যেমন ২০২২ সালে ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক জেসিকা ডাইচ ও তাঁর সহলেখকেরা বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি যে, যারা রাতের পেঁচার মতো নিশাচর, তাদের বেশির ভাগই অলস, বিশৃঙ্খল জীবযাপনকারী ও অপরিণামদর্শী হন।’ অন্যদিকে হংকংয়ের চাইনিজ ইউনিভার্সিটির গবেষক ল্যাপ আহ তসে এবং তাঁর সহকর্মীরা গবেষণায় দেখেছেন, রাত জাগা নিশাচর মানুষেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থুলকায় হন। যাঁরা অলস, বিশৃঙ্খল, স্থুলকায় ও শারীরিক–মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, তাঁরা কাজে–কর্মে অমনোযোগী হবেন, আগ্রহহীন হবেন—এটাই তো স্বাভাবিক।
গবেষকেরা বলছেন, যারা রাতের পেঁচা, তাদের বেশির ভাগকেই দেখা যায়, ঘুমের ওষুধসহ নানা ধরনের ওষুধ সেবন করতে হয়। হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি অফ এডুকেশনের গবেষক র্যান্ডলার ও তাঁর সহকর্মীরা দেখেছেন, রাতজাগা মানুষেরা যৌনকর্মের পেছনে বেশি সময় ব্যয় করেন।
আর ভোরে যাঁরা ঘুম থেকে জাগেন তাঁদের ব্যাপারে গবেষকদের অভিমত হচ্ছে, সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে ওঠার ফলে কেউ কেউ একঘেয়েমিতে ভোগেন ও বিরক্তবোধ করেন। আবার তাড়াতাড়ি ঘুমানোর তাগিদে তারা ঘরেও ফেরেন তাড়াতাড়ি। সে ক্ষেত্রে তারা সন্ধ্যার আড্ডা ও সামাজিক মেলামেশার সুযোগ কম পান।
এসবের বিপরীতে রাতের নিশাচররা কিছু সুবিধা ভোগ করেন। যেমন— রাত জাগলে মানুষের এত ফোন কল ও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ঝক্কি পোহাতে হয় না। একটানা কাজ করা যায়। বেলজিয়ামের লিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এক সমীক্ষায় দেখেছেন, রাতে দেরি করে ঘুমাতে যাওয়া ব্যক্তিরা মানসিকভাবে অনেক বেশি সক্রিয় থাকেন।
অন্যদিকে মিলান বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের করা সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেরিতে ঘুমানো ব্যক্তিরা অনেক বেশি সৃজনশীল হন। চিরাচরিত চিন্তাভাবনার বাইরে বেরিয়ে কাজ করেন।
রিসার্চ গেটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, একদল ব্রিটিশ গবেষক দেখেছেন, সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা ব্যক্তির শরীরে কর্টিজল বা স্ট্রেস হর্মোনের মাত্রা অনেক বেশি থাকে। কারণ তাঁরা দিনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে চান, যা তাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে রাতে দেরিতে বিছানা নেওয়া ব্যক্তিরা জানেন কাজ শেষ করার জন্য অনেকটা সময় রয়েছে তাঁদের হাতে। ফলে তাদের দেহে কর্টিজলের মাত্রা কম থাকে।
তবে চাইলেই কেউ ভোরের পাখি থেকে রাতের পেঁচা কিংবা রাতের পেঁচা থেকে ভোরের পাখি হতে পারেন না। একটি ডিম লাইট আর একটি অ্যালার্মঘড়ি কিনলেই আপনি নিশাচর থেকে ভোরের মানুষে পরিণত হয়ে যাবেন, এমন ভাবাটা ভুল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কে নিশাচর হবে আর কে রাতভর ঘুমাবে, তার সঙ্গে জিনগত কিছু বৈশিষ্ট্যও জড়িত।
তাই কারও জিনের ভেতর যদি ভোরে জেগে ওঠার বিষয়টি না থাকে, তাহলে তিনি হয়তো জোর করে ঘুম থেকে উঠবেন এবং কষ্ট করে ঝাপসা চোখে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকবেন বটে, কিন্তু ফলপ্রসূ কোনও কাজ হবে না।
সুতরাং, সবচেয়ে ভালো উপদেশ হচ্ছে, আপনার দেহঘড়ি নিয়ে দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করুন। পৃথিবীর অনেক মানুষই মাঝামাঝি জীবনযাপন করেন। অর্থাৎ তাঁরা ভোরের পাখিও না, আবার রাতের পেঁচাও না। তারা মাঝরাতে ঘুমাতে যান আর সকাল হওয়ার বেশ পরে ঘুম থেকে ওঠেন। এ কারণে পৃথিবীর বেশির ভাগ অফিসের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকনোমিস্ট, সায়েন্স অ্যালার্ট, সায়েন্স ডিরেক্ট ও রিসার্চ গেট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।