বাংলাদেশের পতঙ্গের তালিকায় যুক্ত হলো নতুন একটি ঝিঁঝিঁ পোকা। এর নাম বালিয়াড়ি ঝিঁঝিঁ পোকা। ইংরেজিতে ডুন ক্রিকেট (Dune Cricket) বা মন্সটার ক্রিকেট (Monster Cricket)। বৈজ্ঞানিক নাম Schizodactylus monstrosus। সরল বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, বালিয়াড়ির ঝিঁঝিঁ পোকা বা দৈত্যাকার ঝিঁঝিঁ পোকা। এরা বালিতে গর্ত করে থাকে, আকৃতিতে বেশ বড় হয়। এ জন্যই এমন নাম।
পৃথিবীতে অর্থপটেরা বর্গের স্কিজোড্যাক্টিলিডি (Schizodactylidae) পরিবারভুক্ত এই পতঙ্গের মাত্র ৯টি প্রজাতি আছে। এ পরিবারের অন্য কোনো প্রজাতি বাংলাদেশে থাকার রেকর্ডে নেই। অর্থাৎ, বাংলাদেশে এই পতঙ্গ পরিবারের রেকর্ডটি একদম নতুন। তবে ভারত ও পাকিস্তানের আসাম, বিহার, কর্ণাটক, সিন্ধু এবং পাঞ্জাবে এ পতঙ্গ পাওয়া যায়। এরা নিশাচর এবং নরম বালিতে গর্ত করে থাকে। গর্তগুলো বেশ গভীর হয়।
কয়েক মিটার পর্যন্ত গর্ত হয়ে থাকে। ৯ বার খোলস বদলানোর পর এরা পূর্ণবয়স্ক হয়। পরিণত বয়সে ডানা থাকে। তবে ডানা থাকলেও উড়তে পারে না। এদের পাগুলো বালির ওপর দিয়ে দ্রুত চলার জন্য বিশেষায়িত এবং অনেক দ্রুত চলতে পারে। এরা মাংসাশী এবং অন্য ছোটখাটো কীটপতঙ্গ শিকার করে খায়।
এই গবেষণায় কাজ করেছেন তিন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের আশিকুর রহমান সমী এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা দুই লেখক (মো. ফজলে রাব্বি ও আজিজুল ইসলাম বরকত)। এ ছাড়াও গবেষণায় যুক্ত ছিলেন পাকিস্তানের জামশোরোর সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক রিফফাত সুলতানা।
আমরা কীভাবে এই পতঙ্গটি শনাক্ত করলাম, সেই কাহিনিটা বলি। বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে সংরক্ষিত বনগুলোর মধ্যে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান অন্যতম। এখানকার বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে পাখি দেখার জন্য প্রতিবছর অনেক ফটোগ্রাফার, প্রকৃতিবিদের সমাগম ঘটে। ২০২৩ সালে আমরা এই বনে যাই।
তবে উদ্দেশ্য পাখি দেখা নয়, আমরা উভচর ও সরিসৃপবিষয়ক গবেষণাকাজে নাইট সার্ভে করার জন্য যাই। এ ধরনের গবেষণা কাজে বর্ষাকাল উপযুক্ত সময়। আমাদের ঢাকা থেকে বাসভ্রমণে শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছাতে সন্ধ্যা নামে। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। সাতছড়ি যেতে আরও প্রায় ৩০ কিলোমিটার। যেতে হবে সিএনজিতে। বাসস্ট্যান্ডে রাতের খাবার সেরে বৃষ্টির মধ্যেই রওনা হই আমরা।
ডরমিটরিতে পৌঁছে ব্যাগ রেখে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি। বনের ভেতরে ট্রেইলে হাঁটার সময় বালুর ওপরে একটা ভিন্নধর্মী পতঙ্গ দেখতে পাই। পতঙ্গটি দেখতে ঝিঁঝিঁ পোকার মতো হলেও এর আকৃতি ও গড়ন ভিন্ন। তাই দলের সবাই মিলে পতঙ্গটির কিছু ছবি তুলি।
ঢাকায় ফিরে পতঙ্গটি সম্পর্কে আমরা পুরাতন গবেষণাপত্র খুঁজতে থাকি। বাংলাদেশের পতঙ্গ সংক্রান্ত গবেষণায় এর কোনো উল্লেখ না পেয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির এনসাইক্লোপিডিয়া এবং অনলাইনে প্রকাশিত গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করি। তবে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের কোথাও এর উপস্থিতির তথ্য পাইনি। তাই এটিকে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন নথিভুক্ত প্রজাতি বলে নিশ্চিত করা হয়।
এর পরিচয় সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হতে আমরা পাকিস্তানের সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক এবং প্রজাতি বিশেষজ্ঞ রিফফাত সুলতানার সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ করি। পরে যৌথভাবে একটা গবেষণাপত্র লেখি। গবেষণাপত্রটি জার্নাল অব বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণা অপ্রতুল। পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রাণীবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। বালিয়াড়ির ঝিঁঝিঁ পোকার মতো আবিষ্কার আমাদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রচেষ্টাকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।