ধর্ম ডেস্ক : নবীজির প্রতি দরুদ একটি মর্যাদাপূর্ণ জিকির। দরুদ শুধুই যে নবীজির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যম তা নয়, বরং দরুদের সওয়াব ও ফজিলত আকাশচুম্বী। দুনিয়া ও আখেরাতে সব ধরনের সমস্যা দূর করতে উম্মতের জন্য দরুদ নিয়ামকস্বরূপ। বলা হয়ে থাকে, সকল কল্যাণ দরুদেই নিহিত।
হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (স.) আল্লাহর জিকিরের খুব তাকিদ করলেন। আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি আপনার প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠ করে থাকি। আমি আমার দোয়ার কতভাগ আপনার জন্য নির্ধারণ করব? তিনি বললেন, তোমার যে পরিমাণ ইচ্ছা। আমি বললাম, চারভাগের এক ভাগ? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা, তবে বেশি করলে আরো ভালো। আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক?
তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা, তবে বেশি করলে আরো ভালো। আমি বললাম, তাহলে তিন ভাগের দুই ভাগ? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা, তবে বেশি করলে আরো ভালো।
আমি বললাম, তাহলে কি আমার দোয়ার পুরোটাই হবে আপনার প্রতি দরূদ? তিনি বললেন, তাহলে তো তোমার মকসুদ হাসিল হবে, তোমার গুনাহ মাফ করা হবে।’ (তিরমিজি: ২/৭২) মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১০/২৪৮; মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ৬/৪৫)
আল্লাহর হাবিবের প্রতি দরুদ পাঠের আরেকটি চমকপ্রদ উপকার হলো- গায়েবি সাহায্য লাভ। দরুদের বরকতে খোদায়ি মদদ লাভের অনেক উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন বর্ণনায়। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, একবার এক ব্যক্তি মরুভূমি পার হচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ডাকাতেরা তাকে আক্রমণ করল এবং তার সব সম্পদ লুট করে নিল। সে ভীত হয়ে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করতে শুরু করল। ঠিক তখনই হঠাৎ কোথা থেকে যেন একদল অশ্বারোহী এসে ডাকাতদের আক্রমণ করল এবং তাকে উদ্ধার করল। ডাকাতেরা পালিয়ে গেল।
সে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনারা কারা?” অশ্বারোহীরা বললেন, “তুমি যখন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ওপর দরুদ পাঠ করছিলে, তখন আল্লাহ আমাদেরকে তোমার সাহায্যে পাঠিয়েছেন।” (কিতাবুশ-শিফা, ইমাম কাজি আয়াদ: ২/৬০২)
হজরত উসমান ইবনে হানিফ (রা.) থেকে বর্ণিত— এক অন্ধ ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে বললো, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার দৃষ্টি চলে গেছে, আমি কী করতে পারি?”
রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, “তুমি অজু করে দুই রাকাত নামাজ পড়ো এবং এরপর এই দোয়া করো— “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন ওয়াশফি’নি” অর্থাৎ (হে আল্লাহ! রাসুলুল্লাহর বরকতে আমাকে শিফা দান করুন)। অন্ধ ব্যক্তি এই আমল করলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই অলৌকিকভাবে তার দৃষ্টি ফিরে পেলেন। (তিরমিজি: ৩৫৭৮, নাসায়ি: ১২৫৮)
একবার এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে বলল— “ইয়া রাসূলুল্লাহ (স.)! আমি কঠিন রোগে আক্রান্ত, কিছুতেই সুস্থ হচ্ছি না।” রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন— “তুমি বেশি বেশি দরুদ শরিফ পড়ো, আল্লাহ তোমাকে শিফা দান করবেন।”
সে নিয়মিত দরুদ পাঠ করতে শুরু করলো এবং কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল। (আল-কাওকাবুদ দুররি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ২৪৫)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত— এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে বললো, “আমি প্রচণ্ড ঋণের মধ্যে পড়ে গেছি।”
রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন— “তুমি প্রতিদিন ১০০ বার দরুদ শরিফ পড়ো, আল্লাহ তোমার ঋণ মুক্তির ব্যবস্থা করে দিবেন।” সে নিয়মিত দরুদ পড়তে লাগলো এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা হয়ে গেল। (দারেমি: ২৭৫৫)
ইমাম ইবনে জাওযি (রহ.) তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— এক ব্যক্তি দারিদ্র্যে এতটাই কষ্ট পাচ্ছিল যে, তার কাছে খাবার কেনার মতো টাকাও ছিল না। একদিন সে এক আলেমের কাছে গিয়ে বলল, “হুজুর, আমি প্রচণ্ড অভাবে আছি, কী করলে আমার অভাব দূর হবে?” আলেম বললেন, “তুমি প্রতিদিন ১০০০ বার দরুদ শরিফ পড়ো, আল্লাহ তোমার অভাব দূর করে দিবেন।” সে এই আমল শুরু করলো এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার রিজিকের দ্বার খুলে গেল। সে ধীরে ধীরে এত ধনী হয়ে গেল যে, সে নিজেই গরিবদের দান করা শুরু করল। (কিতাবুল আওরাদ, ইমাম ইবনে জাওযি, পৃষ্ঠা: ২৯৭)
হজরত আবু ইয়াজিদ (রহ.) বলেন— আমি একদিন এক আলেমের কাছে শুনলাম, “যে ব্যক্তি নিয়মিত ১০০০ বার দরুদ পাঠ করবে, সে স্বপ্নে রাসুলুল্লাহ (স.)-কে দেখতে পাবে।” আমি এই আমল শুরু করলাম। একদিন দরুদ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতের বেলা স্বপ্নে আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে দেখলাম।
তিনি আমাকে বললেন, “হে ইয়াজিদ! তুমি নিয়মিত আমার প্রতি দরুদ পাঠ করো, আল্লাহ তোমাকে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত করবেন।” আমি ঘুম থেকে উঠে আনন্দে কেঁদে ফেললাম এবং সারাজীবন দরুদ পাঠকে আমার জীবনের অংশ বানিয়ে নিলাম। (তাফসির কুরতুবি, খণ্ড ১০, আয়াত ৫৬-এর ব্যাখ্যা)
দরুদের আরও অনেক বিস্ময়কর উপকারের কথা বর্ণিত হয়েছে হাদিস শরিফে। পরকালেও দরুদ পাঠকারীরা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হবেন। হজরত আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) একবার জান্নাতের বাগানে বসে ছিলেন। হঠাৎ তিনি বললেন—“যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০ বার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার কবরের আজাব মাফ করে দেবেন এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেবেন।” (মুয়াত্তা মালিক: ৪৮৮)
ইমাম কুরতুবি (রহ.) বর্ণনা করেছেন— এক ব্যক্তি নিয়মিত দরুদ শরিফ পড়তেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে রাসুলুল্লাহ (স.)-কে দেখলেন। ‘রাসুলুল্লাহ (স.) তাকে বললেন, “তোমার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ আছে, কারণ তুমি জীবনে নিয়মিত আমার প্রতি দরুদ পাঠ করেছ।” সকালে সে উঠে আলেমদের কাছে গিয়ে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তারা বললেন, “দরুদ পাঠকারীর জন্য জান্নাতের সুসংবাদ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (স.) দিয়েছেন, তোমার জন্য এটি অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার।” (তাফসির কুরতুবি, খণ্ড ১০, আয়াত ৫৬-এর ব্যাখ্যা)
হজরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন— এক বৃদ্ধ ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি খুব শান্ত ছিলেন এবং বারবার বলছিলেন, “রাসুলুল্লাহ (স.) এসেছেন, তিনি আমাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন।” তার পরিবার বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কী কারণে এই মর্যাদা পেলেন?” তিনি বললেন, “আমি জীবনে কখনও কোনো নামাজ বাদ দেইনি এবং আমি প্রতিদিন ৫০০ বার দরুদ পাঠ করতাম।” কথা শেষ করেই তিনি হাসিমুখে ইন্তেকাল করলেন।
(রুহুল বায়ান, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা: ৩৭৮)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।