বনের রাজা সিংহ। তার রাজকীয় চালচলন আর গর্জনে কেঁপে ওঠে বনভূমি। কিন্তু সেই গর্জন যখন বনের বদলে জনবসতি বা শহরের রাস্তায় শোনা যায়, তখন তা হয়ে ওঠে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের ডাক। সম্প্রতি মিরপুর চিড়িয়াখানায় ঘটা ঘটনার রেশ ধরে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে- চিড়িয়াখানার নিরাপত্তা আসলে কতটা মজবুত? তবে ইতিহাস বলছে, খাঁচা ভেঙে বা প্রাচীর টপকে সিংহের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বে বিরল নয়। কখনও মানুষের ভুলের কারণে, আবার কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে হিংস্র এই পশুরা চলে এসেছে লোকালয়ে। বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম হওয়া এমন রোমহর্ষক ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন শামস বিশ্বাস

তিবিলিসির রাজপথ যখন সাফারি পার্ক জর্জিয়া, ২০১৫
বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ চিড়িয়াখানা বিপর্যয়ের ঘটনাটি ঘটে জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিতে। ২০১৫ সালের জুন মাসে প্রবল বন্যা আঘাত হানে তিবিলিসি চিড়িয়াখানায়। পানির তোড়ে ভেঙে যায় অধিকাংশ খাঁচা ও বেষ্টনী। ফলে বাঘ, ভালুক, জলহস্তী এবং অবশ্যই সিংহরা বেরিয়ে পড়ে শহরের রাস্তায়। শহরের কেন্দ্রস্থলে কর্দমাক্ত রাস্তায় সিংহের ঘোরাঘুরির দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় বিশ্ববাসী। সোয়েটার কারখানার গুদামে, সুইমিংপুলের পাশে কিংবা আবাসিক ভবনের সিঁড়িতে আশ্রয় নেয় হিংস্র প্রাণীরা। পুলিশ ও স্পেশাল ফোর্স নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। দুঃখজনকভাবে বন্যার তোড়ে এবং গুলিতে অনেক প্রাণী মারা যায়। একটি সাদা সিংহ শহরের এক চত্বরে এক ব্যক্তিকে আক্রমণ করে হত্যা করেছিল। এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় চিড়িয়াখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর হতে পারে।
নাইরোবির রাস্তায় মোহক
কেনিয়া, ২০১৬
নাইরোবি ন্যাশনাল পার্ক বিশ্বের একমাত্র বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য যা একটি রাজধানী শহরের একদম লাগোয়া। ২০১৬ সালে সেখান থেকে লোকালয়ে চলে আসে ‘মোহক’ নামের একটি বিখ্যাত সিংহ। ১৩ বছর বয়সী এই সিংহটি পর্যটকদের কাছে খুব প্রিয় ছিল। পার্কের সীমানা পেরিয়ে সিংহটি নাইরোবির ইসিনিয়া শহরের জনাকীর্ণ রাস্তায় চলে আসে। উৎসুক জনতা এবং মোটরবাইকচালকরা সিংহটিকে ঘিরে ফেলে এবং উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে। ভীত ও বিভ্রান্ত হয়ে সিংহটি এক ব্যক্তিকে আক্রমণ করে বসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কেনিয়ার বন্যপ্রাণী বিভাগের রেঞ্জার্সরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে সিংহটিকে গুলি করতে বাধ্য হয়। হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে বনের রাজার এই করুণ মৃত্যু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তুমুল সমালোচনার ঝড় তোলে।
লাইপজিগ চিড়িয়াখানায় আতঙ্ক
জার্মানি, ২০১৬
জার্মানির অন্যতম নিরাপদ ও আধুনিক হিসেবে পরিচিত লাইপজিগ চিড়িয়াখানা। কিন্তু ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেখানে ঘটে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। চিড়িয়াখানার ‘লায়ন সাভানা’ এনক্লোজার থেকে দুটি সিংহ, ‘মাজো’ এবং ‘মোতশেগেতসি’ খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়ে।
সকালবেলায় চিড়িয়াখানা খোলার আগেই এই ঘটনা ঘটে, ফলে কোনো দর্শনার্থী তখনও প্রবেশ করেনি। তবে চিড়িয়াখানার কর্মীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষ দ্রুত ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে। একটি সিংহকে বেষ্টনীতে ফেরত পাঠানো সম্ভব হলেও, অন্যটি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ট্রাঙ্কুলাইজার বা ঘুমপাড়ানি গুলি ছোড়া হলেও তাতে কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি সিংহকে গুলি করে হত্যা করতে হয়। আধুনিক নিরাপত্তা বেষ্টনী টপকে কীভাবে তারা বের হলো, তা দীর্ঘদিন তদন্তের বিষয় ছিল।
জেনসভিলের অভিশপ্ত রাত
যুক্তরাষ্ট্র, ২০১১
এটি চিড়িয়াখানা থেকে পালানোর ঘটনা নয়, বরং তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু। আমেরিকার ওহাইও রাজ্যের জেনসভিলে টেরি থম্পসন নামের এক ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত খামারে বাঘ, সিংহ ও ভালুক পুষতেন। ২০১১ সালের অক্টোবরে, আত্মহত্যার আগে তিনি খামারের সব খাঁচা খুলে দেন।
মুহূর্তের মধ্যে ১৮টি বেঙ্গল টাইগার, ১৭টি সিংহ এবং অন্যান্য হিংস্র প্রাণী লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়, হাইওয়ের রাস্তায় সাইনবোর্ডে সতর্কবাণী টানানো হয়- ‘সতর্কতা : রাস্তায় বন্যপ্রাণী।’ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বাধ্য হয়ে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়। রাতের অন্ধকারে পুলিশের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর সেই লড়াই ছিল সিনেমার চেয়েও রোমহর্ষক। এই ঘটনায় প্রায় অর্ধশত প্রাণী মারা যায়, যার মধ্যে ছিল এক ডজনেরও বেশি পূর্ণবয়স্ক সিংহ। এটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যক্তিগত মালিকানার আইনের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তনের সূচনা করে।
প্ল্যাঙ্কেনডেল চিড়িয়াখানায় বিপদ
বেলজিয়াম, ২০১৮
ইউরোপের অন্যতম জনপ্রিয় চিড়িয়াখানা প্ল্যাঙ্কেনডেল। ২০১৮ সালের জুন মাসে সেখান থেকে একটি সিংহী তার এনক্লোজার বা নির্ধারিত এলাকা থেকে বেরিয়ে দর্শনার্থীদের হাঁটার রাস্তায় চলে আসার উপক্রম হয়।
ঘটনাটি ঘটে দিনের ব্যস্ততম সময়ে। সাইরেন বেজে উঠলে শত শত দর্শনার্থী এবং স্কুল থেকে আসা শিশুদের দ্রুত স্যুভেনিয়ার শপ এবং রেস্তোরাঁগুলোর ভেতরে আশ্রয় নিতে বলা হয়। একটি স্কুল বাসে আটকে পড়া শিশুরা জানালা দিয়ে আতঙ্কিত হয়ে দেখছিল সিংহীর ঘোরাফেরা। চিড়িয়াখানার কর্মীরা সিংহীটিকে ঘুমপাড়ানি গুলি দিয়ে কাবু করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত বিপদ এড়াতে পুলিশ সিংহীটিকে গুলি করে। এই ঘটনায় দর্শনার্থীদের মধ্যে কেউ হতাহত না হলেও বন্যপ্রাণীপ্রেমীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
লাডিসপোলির রাস্তায় কিম্বা
ইতালি, ২০২৩
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ইতালির রোমের অদূরে লাডিসপোলি শহরে ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। স্থানীয় একটি সার্কাস থেকে পালিয়ে যায় ‘কিম্বা’ নামের একটি পূর্ণবয়স্ক সিংহ। প্রায় ৭ ঘণ্টা ধরে সিংহটি শহরের রাস্তায় মন্থর গতিতে হাঁটাহাঁটি করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, রাতের নিস্তব্ধ রাস্তায় পার্ক করা গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে সিংহটি। শহরের মেয়র দ্রুত কারফিউ জারি করেন এবং বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেন। পুলিশ, দমকল বাহিনী এবং পশু চিকিৎসকরা দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ট্রাঙ্কুলাইজার গান ব্যবহার করে সিংহটিকে অজ্ঞান করতে সক্ষম হন। তদন্তে জানা যায়, সার্কাসের খাঁচার তালাটি ঠিকমতো লাগানো ছিল না, যা এই বিপত্তি ঘটায়।
করাচির রাস্তায় সিংহের জ্যাম
পাকিস্তান, ২০২৩
শহরের প্রধান সড়কে অফিস ফেরত মানুষের ভিড়, তার মধ্যেই একটি পিকআপ ভ্যান থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল সিংহ! ২০২৩ সালের আগস্টে পাকিস্তানের করাচির ব্যস্ততম শাহরাহ-ই-ফয়সাল সড়কে এই ঘটনা ঘটে। সিংহটিকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাচার বা স্থানান্তর করা হচ্ছিল। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে এবং খাঁচার দুর্বলতার সুযোগে সেটি রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। আতঙ্কিত জনতা গাড়ি ফেলে পালাতে শুরু করে, আবার কেউ কেউ দূর থেকে ভিডিও করতে থাকে। সিংহটি বেশ কিছুক্ষণ রাস্তার আইল?্যান্ডে এবং একটি ভবনের নিচে ঘোরাঘুরি করে। প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর বন্যপ্রাণী কর্মকর্তারা সিংহটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। জনবহুল শহরে এমন অরক্ষিতভাবে বন্যপ্রাণী পরিবহন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
নর্থ ক্যারোলিনার ট্র্যাজেডি
যুক্তরাষ্ট্র, ২০১৮
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় ‘কনজারভেটরস সেন্টার’ নামের বন্যপ্রাণী পার্কে ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। এটি সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত চিড়িয়াখানা ছিল না, বরং একটি সংরক্ষণ কেন্দ্র ছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নিয়মিত খাঁচা পরিষ্কার করার সময় একটি সিংহ বেষ্টনী ভেঙে বেরিয়ে আসে।
২২ বছর বয়সী এক তরুণী ইন্টার্ন তখন খাঁচা পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সিংহটি তাকে আক্রমণ করে এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পুলিশ এবং পার্ক কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সিংহটিকে গুলি করে হত্যা করে। তদন্তে বেরিয়ে আসে, খাঁচা পরিষ্কারের সময় সিংহটিকে যে আলাদা কম্পার্টমেন্টে আটকে রাখার কথা ছিল, তার দরজাটি ঠিকমতো লক করা হয়নি। সামান্য একটু ভুল কেড়ে নেয় একটি তাজা প্রাণ।
আল বারশায় শখের মাশুল
আরব আমিরাত, ২০১৬
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিত্তবানের মধ্যে বাঘ-সিংহ পোষার একটি গোপন প্রবণতা রয়েছে, যদিও এটি আইনত দণ্ডনীয়। ২০১৬ সালে দুবাইয়ের আল বারশা নামের আবাসিক এলাকায় হঠাৎই দেখা মেলে একটি সিংহীর।
বিলাসবহুল ভিলা এবং হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের মাঝে সিংহীকে ঘুরতে দেখে বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ দ্রুত এলাকাটি ঘিরে ফেলে। সৌভাগ্যবশত, সিংহীটি আক্রমণাত্মক ছিল না। পরে জানা যায়, এটি ওই এলাকারই কোনো এক বাসিন্দার বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল। কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও এই ঘটনাটি লোকালয়ে বন্যপ্রাণী পোষার ভয়াবহ ঝুঁকির বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে।
আরাকে জোড়া সিংহের পলায়ন
ইরান, ২০২২
ইরানের আরাক শহরের চিড়িয়াখানায় ২০২২ সালে ঘটে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। দুপুরের খাবার দেওয়ার সময় একটি পুরুষ সিংহ খাঁচার দরজা খোলা পেয়ে তার কেয়ারটেকার বা রক্ষককে আক্রমণ করে। ৪০ বছর বয়সী ওই রক্ষক ঘটনাস্থলেই মারা যান। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, রক্ষককে হত্যার পর সিংহটি এবং তার সঙ্গিনী সিংহী- উভয়েই খাঁচা থেকে বেরিয়ে চিড়িয়াখানার প্রাঙ্গণে চলে আসে। চিড়িয়াখানাটি তখন দর্শনার্থীতে পূর্ণ ছিল না, তবে কর্মীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস প্রায় চার ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে সিংহ দুটিকে পুনরায় খাঁচাবন্দি করতে সক্ষম হয়। এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে যে, বন্যপ্রাণীর সঙ্গে কাজ করার সময় এক মুহূর্তের অসতর্কতাও জীবনের ইতি টানতে পারে।
ক্রুগার পার্কের ১৪ সিংহ
দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০১৯
একটি বা দুটি নয়, একেবারে ১৪টি সিংহের একটি দল লোকালয়ে! দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কের সীমানা পেরিয়ে ১৪টি সিংহের একটি দল ফালিবোরয়া নামের একটি খনি এলাকায় ঢুকে পড়ে।
২০১৯ সালের এই ঘটনায় খনি শ্রমিক এবং স্থানীয় গ্রামবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দেয়। বন্যপ্রাণী কর্মকর্তারা জানান, এই সিংহের দলটি সম্ভবত অন্য একটি শক্তিশালী দলের সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে পার্কের সীমানা ছেড়ে নতুন বাসস্থানের খোঁজে লোকালয়ের দিকে চলে এসেছিল। কয়েক দিন ধরে হেলিকপ্টার এবং ট্র্যাকারদের সাহায্যে নজরদারি চালানোর পর সিংহগুলোকে আবারও নিরাপদে পার্কে ফেরত পাঠানো হয়। তবে এই কয়েক দিন স্থানীয় মানুষ ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাননি।
জসপার্ক থেকে লাপাত্তা সিংহ
নাইজেরিয়া, ২০১৫
নাইজেরিয়ার প্লাটু রাজ্যের জস ওয়াইল্ডলাইফ পার্কে ২০১৫ সালে একটি সিংহ পালানোর ঘটনা ঘটে। সকালের দিকে যখন সিংহটিকে খাবার দেওয়া হচ্ছিল, তখন গেট খোলা থাকার সুযোগে সেটি বেরিয়ে পড়ে।
পার্কের সীমানা প্রাচীর খুব একটা উঁচু ছিল না, ফলে সিংহটি সহজেই লোকালয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। পার্কের আশপাশে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থাকায় কর্তৃপক্ষ কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। ঘুমপাড়ানি গুলি বা ট্রাঙ্কুলাইজার কাজ করতে দেরি হওয়ায়, মানুষের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে সেনাবাহিনী সিংহটিকে গুলি করে হত্যা করে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবাদীরা এই হত্যার তীব্র নিন্দা জানালেও কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল- তাৎক্ষণিক বিপদ এড়াতে তাদের হাতে আর কোনো পথ ছিল না।
তারোঙ্গায় কোড ওয়ান আতঙ্ক
অস্ট্রেলিয়া, ২০২২
সিডনির বিখ্যাত তারোঙ্গা চিড়িয়াখানায় তখন চলছিল ‘রোর অ্যান্ড স্নোর’ (জড়ধৎ ধহফ ঝহড়ৎব) নামের এক বিশেষ ইভেন্ট, যেখানে দর্শনার্থীরা চিড়িয়াখানার ভেতরে তাঁবুতে রাত কাটানোর সুযোগ পান। ২০২২ সালের নভেম্বরের এক ভোরে হঠাৎ সাইরেন বেজে ওঠে- জারি করা হয় সর্বোচ্চ সতর্কতা বা ‘কোড ওয়ান’। কারণ? প্রধান এনক্লোজারের বেড়া গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে পাঁচটি সিংহ- একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ এবং চারটি শাবক। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সিংহগুলো তাদের সীমানার ঠিক বাইরেই ঘোরাফেরা করছে। তাঁবুতে থাকা আতঙ্কিত অতিথিদের দ্রুত নিরাপদ বাথরুমে সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির পর চিড়িয়াখানার রক্ষীরা সিংহগুলোকে বুঝিয়ে এবং একটিকে ট্রাঙ্কুলাইজার দিয়ে অজ্ঞান করে পুনরায় খাঁচায় ঢোকাতে সক্ষম হন। তদন্তে জানা যায়, সীমানা প্রাচীরের একটি ‘ক্লিপ’ বা আংটা অকেজো হয়ে যাওয়ায় এই বিপত্তি ঘটেছিল।
চাঙ্গি বিমানবন্দরের কার্গো রহস্য
সিঙ্গাপুর, ২০২১
সাধারণত চিড়িয়াখানা থেকেই প্রাণী পালায়, কিন্তু ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে ঘটে এক নজিরবিহীন ঘটনা। একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে পরিবহনের সময় কার্গো সেকশনে রাখা একটি কনটেইনার ভেঙে বেরিয়ে পড়ে দুটি সিংহ। বিমানবন্দরের মতো কঠোর নিরাপত্তাপূর্ণ এলাকায় সিংহের উপস্থিতিতে তোলপাড় শুরু হয়। সিংহ দুটি কনটেইনারের ওপরে উঠে বসে ছিল এবং বেশ বিচলিত দেখাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ম্যান্ডাই ওয়াইল্ডলাইফ গ্রুপের বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে ট্রাঙ্কুলাইজার গান ব্যবহার করে সিংহ দুটিকে অজ্ঞান করেন। এই ঘটনা প্রাণী পরিবহনের নিরাপত্তা মানদণ্ড নিয়ে বড়সড় প্রশ্নের জন্ম দেয়।
জুনাগড় হোটেলে অনাহূত অতিথি
ভারত, ২০২১
ভারতের গুজরাটের জুনাগড় শহরটি গির অরণ্যের খুব কাছে হওয়ায় সেখানে মাঝে মাঝেই সিংহের দেখা মেলে। কিন্তু ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যা ঘটল, তা ছিল কল্পনাতীত। শহরের বিলাসবহুল ‘হোটেল সরোবর পোর্টিকো’-এর সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, হোটেলের প্রধান গেট টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ছে একটি পূর্ণবয়স্ক সিংহ! ভোরবেলায় হোটেলের লবি এবং পার্কিং এরিয়ায় সিংহটিকে কিছুক্ষণ রাজকীয় ভঙ্গিতে হাঁটতে দেখা যায়। সৌভাগ্যক্রমে, হোটেলের কাচের দরজাগুলো বন্ধ ছিল এবং রক্ষীরা নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর সিংহটি নিজেই আবার দেয়াল টপকে বেরিয়ে যায়। বনের পশু যে খাবারের খোঁজে কতটা লোকালয়ের গভীরে চলে আসতে পারে, এই ঘটনাটি ছিল তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
আইফেল চিড়িয়াখানায় মহাবিপদ
জার্মানি, ২০১৮
২০১৮ সালের জুন মাসে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলীয় লুনবাখ শহরের আইফেল চিড়িয়াখানায় এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় আঘাত হানে। প্রবল বৃষ্টি ও বন্যায় চিড়িয়াখানার নদীতীরবর্তী খাঁচাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সেখান থেকে পালিয়ে যায় দুটি সিংহ, দুটি বাঘ এবং একটি জাগুয়ার।
পুরো শহরে সতর্কতা জারি করা হয় এবং বাসিন্দাদের জানালা-দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের বিশাল একদল ড্রোন ব্যবহার করে প্রাণীগুলোর অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করে। কয়েক ঘণ্টা চরম আতঙ্কের পর জানা যায়, প্রাণীগুলো চিড়িয়াখানার সীমানার মধ্যেই একটি উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। যদিও এই ঘটনায় একটি ভালুককে গুলি করতে হয়েছিল, কিন্তু সিংহ ও বাঘগুলোকে নিরাপদে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
কানো চিড়িয়াখানার দীর্ঘ রাত
নাইজেরিয়া, ২০১৯
নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় কানো শহরের চিড়িয়াখানায় ২০১৯ সালের অক্টোবরে ঘটে এক নাটকীয় ঘটনা। রাত ৯টার দিকে চিড়িয়াখানার কর্মীরা বুঝতে পারেন, একটি বিশাল সিংহ তার খাঁচা থেকে উধাও। খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই আশপাশের জনবসতিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সিংহটি চিড়িয়াখানার ভেতরের ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। পুলিশ এবং বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা সারা রাত সিংহটিকে বাগে আনার চেষ্টা করেন। অন্ধকারের কারণে ট্রাঙ্কুলাইজার ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। শেষ পর্যন্ত পরদিন সকালে, প্রায় ১০ ঘণ্টা চেষ্টার পর সিংহটিকে অজ্ঞান করে খাঁচায় ফেরত পাঠানো হয়। ওই ১০ ঘণ্টা পুরো এলাকাবাসী ছিল নির্ঘুম এবং আতঙ্কিত।
পাপান্যাক পার্কের ট্র্যাজেডি
কানাডা, ২০১৬
কানাডার অটোয়ার কাছে অবস্থিত পাপান্যাক পার্ক চিড়িয়াখানায় ২০১৬ সালে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা। মানুষের অসতর্কতার কারণে বা রক্ষণাবেক্ষণের ভুলে একটি সিংহ তার এনক্লোজার থেকে বেরিয়ে পড়ে।
পার্কটি তখন সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ মনে করে, সিংহটি জনবসতির খুব কাছে চলে এসেছে এবং ট্রাঙ্কুলাইজার কাজ করতে যে সময় লাগবে, সেই সময়ে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে সিংহটিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনাটি চিড়িয়াখানার নিরাপত্তা প্রটোকল নিয়ে কানাডাজুড়ে বিতর্কের ঝড় তোলে।
তিবিলিসির রাজপথে বন্যপ্রাণীর ঢল
জর্জিয়া, ২০১৫
আমাদের তালিকার সর্বশেষ ঘটনাটি কোনো সাধারণ পালানোর ঘটনা নয়, বরং এটি ছিল এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফল। ২০১৫ সালে জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিতে প্রবল বন্যায় চিড়িয়াখানা পুরোপুরি প্লাবিত হয়ে যায়। পানির তোড়ে ভেঙে যায় খাঁচা ও দেয়াল।
শহরের রাস্তায় তখন এক পরাবাস্তব দৃশ্য- কাদা ও পানির স্রোতের সঙ্গে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সিংহ, বাঘ, ভালুক এবং জলহস্তী! শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি সাদা বাঘের আক্রমণে একজন মানুষের মৃত্যু হয়। পুলিশ ও বিশেষ বাহিনী শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া বন্যপ্রাণীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে অভিযান চালায়। অনেক প্রাণীকে ঘুমপাড়ানি গুলি দিয়ে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও, অনেক সিংহ ও বাঘকে মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে গুলি করতে হয়েছিল। তিবিলিসির সেই রাতটি আজও বিশ্ববাসী আতঙ্কের সঙ্গে স্মরণ করে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



