ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্বল পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই প্রক্রিয়ায় এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ছাড়া বাকি ইউনিয়ন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক একীভূত হতে রাজি হয়েছে। তবে নিজেরাই ঘুরে দাঁড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সময় চেয়েছে এক্সিম ব্যাংক ও এসআইবিএল। গত এক সপ্তাহে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেছেন গভর্নর আহসান এইচ. মনসুর।
সূত্রমতে, একীভূত করতে পাঁচ শরিয়াহ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করে গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুর। এতে এক্সিম ব্যাংক একীভূত না করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে লিখিত চিঠি দিয়েছেন আগেই।
আর বৃহস্পতিবার সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক শেষবারের মতো একীভূত না করতে গভর্নরের ডাকা বৈঠকে নিজেদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছে। এদিকে, ব্যাংকটি একীভূত না করার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালত ব্যাংকের পক্ষে রুল জারি করেছে। ফলে পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণ আটকে যাচ্ছে বলে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, একীভূত প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচটি ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ মিলিয়ে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সরকারের অনুমোদন পেলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এ তহবিলে অর্থায়ন করবে। একীভূত হওয়ার পর নতুন ব্যাংকের নাম হতে পারে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ অথবা ‘আল-ফাতাহ্ ব্যাংক’।
কোন ব্যাংকের কী অবস্থা: পাঁচ ব্যাংকের তারল্য ঘাটতি, প্রভিশন পার্থক্য এবং সম্পদের মান কমে যাওয়াসহ সার্বিক বিষয়ে তাদের একটি করে একিউআর (অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ) প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
একিউআর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকের কাছে মোট আমানত রয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে মোট ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। খেলাপির পরিমাণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। ঋণের ৭৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ৯৭.৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬.৩৭ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২.৩ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮.২ শতাংশ।
ইউনিয়ন ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত হতে রাজি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ দুই ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ঋণের ৯৮ শতাংশ খেলাপি। আর এক্সিম ব্যাংকের ৫২ হাজার কোটি টাকা ঋণের প্রায় অর্ধেক খেলাপি।
ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দীন বলেন, আমানতকারীরা প্রতিনিয়ত টাকা নিতে এসে পাচ্ছেন না। এজন্য যত দ্রুত এসব ব্যাংক নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে তত ভালো। এক্ষেত্রে এসব ব্যাংক একীভূত, পুনর্গঠন বা অন্য কিছু হতে পারে।’ তিনি জানান, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে এস আলম ২৮ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে।
যাদের নামে এসব ঋণ দেয়া হয়েছে, তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ১৭ হাজার কোটি টাকার বন্ধকী সম্পত্তি দেখানো হলেও তার সর্বোচ্চ মূল্য এক হাজার কোটি টাকার কম।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণে সম্মতি জানিয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার সঙ্গে আমাদের দ্বিমত নেই। আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক দেখবে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে এস আলম বেনামে ৩৮ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে নিজের নামে অর্থ নেয়ার সুযোগ না থাকায় বেনামি ঋণ নেয়া হয়েছে। বেনামি ঋণের টাকা আদায় না হওয়ায় ব্যাংক বিপর্যয়ে পড়েছে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, আমরা একীভূতকরণে সম্মতি জানিয়েছি। কারণ গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান ঋণস্থিতি প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এসব ঋণ সবই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশের কম।
তবে এক্সিম ব্যাংক এখনই একীভূত হতে রাজি হয়নি। ব্যাংকটির পর্ষদ অন্তত দুই বছর সময় চেয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, এ ব্যাংক থেকেও বিপুল অর্থ লুট হয়েছে, যার সঙ্গে সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাম জড়িত।
এক্সিম ব্যাংক তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর একটি পরিকল্পনার খসড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করেছে। এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন বলেন, আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর বিষয়ে একটি রোডম্যাপ উপস্থাপন করেছি।
বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের আরও স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে তা দিতে বলেছে। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পরবর্তী বৈঠকে বিস্তারিত পরিকল্পনা জমা দেবো। তিনি বলেন, আর্থিক সূচকের উন্নয়নে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। এখন দেখা যাক কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী সিদ্ধান্ত দেয়।
এক্সিম ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকটিকে ভালো অবস্থায় নিতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই সময় দেবে কিনা, সেটি হলো বিষয়। তবে হঠাৎ করেই এই ব্যাংক খারাপ অবস্থায় আসেনি। প্রতিবছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক অডিট করেছে। এরপরও সাবেক চেয়ারম্যান কীভাবে এত টাকা নিয়ে গেলেন, সেই দায় তারাও এড়াতে পারে না।
এদিকে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মেজর (অব) ড. মো. রেজাউল হক বলেন, আমাদের ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। একটু সময় পেলে দুর্বলতা কেটে উঠতে পারবে। একীভূত না করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বারবার জানানো হয়েছে। কিন্তু গভর্নর আমাদের পক্ষে ক্লিয়ার কিছু বলেননি। পরিস্থিতি আগাম অনুধাবন করে আদালতে যাই। আদালত একীভূত না করতে বৃহস্পতিবার রুল জারি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, শরিয়াহ পাঁচ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেই একীভূতের কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু দুটো ব্যাংক না করেছে। তারা নিজেরা ঘুরে দাঁড়াতে পারলে তো ভালো। কিন্তু আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এখন একীভূত থেমে যাবে কিনা- তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।