জুমবাংলা ডেস্ক : ঢাকার সাভারের মিরাজ ফকরুল। চার বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়া থাকেন। কাজ করেন ইস্পাত কারখানায়। শুরুর দিকে মাসে তাঁর বেতন ছিল এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।এখন পান দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা।
বগুড়ার শাখাওয়াত হোসেন। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে মালয়েশিয়া যান। প্রথম চার মাস সেখানে কাজ পাননি। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে কাজ পান। মাসে বেতন পাচ্ছেন প্রায় ৩৪ হাজার টাকা।
মিরাজ ও শাখাওয়াতের বেতনের এই ফারাক শুধু দক্ষতা থাকা না-থাকার কারণে। মিরাজের মতো দক্ষ শ্রমিকরা দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানে গিয়ে উচ্চ পারিশ্রমিকে কাজ করছেন।
আর দক্ষতা না থাকায় শাখাওয়াতের মতো কর্মীরা মালয়েশিয়ায় গিয়ে তুলনামূলক সস্তায় শ্রম বিক্রি করছেন। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া গেছেন। বাংলাদেশি শ্রমিকরা এই দেশ দুটি থেকে যে আয় করছেন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় এর চেয়ে পাঁচ-ছয় গুণ বেশি আয় করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশ থেকে চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে ওই দুটি দেশে ১ শতাংশেরও কম কর্মী গেছেন। এ জন্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের অদক্ষতাকেই দায়ী করছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো।
তাদের ভাষ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে যেসব শ্রমিক বিদেশে যান, বেশির ভাগই অদক্ষ ও নিম্ন আয়ের পরিবারের। তাঁরা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই অল্প সময়ের মধ্যে যেতে চান। এ জন্য তাঁদের জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠানো সম্ভব হয় না। তবে অভিবাসন বিশ্লেষকদের মতে, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দক্ষ ভিসার চেয়ে অদক্ষ ভিসা ক্রয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারণ দক্ষ ভিসা কিনতে অনেক দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়তে হয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দক্ষ কর্মীর অভাবে রেমিট্যান্স বাড়ছে না।
দক্ষিণ কোরিয়াপ্রবাসী মিরাজ ফকরুল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ায় আসা কিছুটা কঠিন। আমার দুই বছর লেগেছিল সব কার্যক্রম শেষ করতে। তবে এখানে এলে টাকার অভাব হয় না? আমি যখন শুরু করি তখন আমার বেতন ছিল এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। এখন আমি আয় করি মাসে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা। আর থাকা-খাওয়াসহ সব খরচ কম্পানি বহন করে। ’
দক্ষিণ কোরিয়ায় যেতে পরীক্ষা দিতে গত বুধবার জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) যান নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মিল্লাত হোসেন। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়া আমাদের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় একটি জায়গা। তবে এখানে যাওয়ার জন্য কষ্ট করতে হয়। আমি দেড় বছর ধরে ভাষা ও ওয়েলডিংয়ের ওপর ট্রেনিং নিয়েছি। এখন পরীক্ষা দিতে এসেছি। আশা করি, এবার চান্স পেয়ে যাব। ’
মালয়েশিয়াপ্রবাসী শাখাওয়াত গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মালয়েশিয়া যেতে আমার খরচ হয় চার লাখ ৫০ হাজার টাকা। আমরা ৪৭ জন একসঙ্গে মালয়েশিয়া এসেছিলাম। আসার পর আমাদের প্রথমে কুয়ালালামপুরের এক বাসায় রাখা হয়। তখন আমরা দুই বেলা করে খাবার পেতাম। চাকরির কথা বললে আমাদের ধৈর্য ধরতে বলা হয়। ২২ দিন পর সেখান থেকে আমাদের পেনাংয়ের এক বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে দেড় হাজার রিঙ্গিত দিয়ে বলে যায়, এ দিয়েই চলতে হবে। আর কোনো টাকা-পয়সা দেওয়া হবে না। ’ তিনি বলেন, ‘গত ২৫ এপ্রিল আমাদের কাজ দেওয়া হয়। এখন মোটামুটি ভালো আছি। মাসে দেড় হাজার করে রিঙ্গিত (প্রায় ৩৪ হাজার টাকা) বেতন পাই। কম্পানির দেওয়া একটি বাসায় থাকি। তবে খাওয়া খরচ নিজের। ’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় গমনের জন্য বয়স হতে হয় ১৮ থেকে ৩৯ বছর। শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে এসএসসি পাস। কোরিয়ান ভাষা পড়ালেখা ও বোঝার পারদর্শিতা থাকতে হয়। অর্থাৎ কয়েক ধাপের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে কর্মীকে পার হতে হয়। প্রথম ধাপে তাঁকে ভাষা পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করতে হয়। তারপর বিএমইটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ভাষা শিখতে হয়। ভাষা শেখা সম্পূর্ণ হলে কোরিয়া গমনকারীকে ভাষা শেখার ওপর পরীক্ষা দিতে হয়। ভাষা শেখা পরীক্ষায় পাস করলে বিভিন্ন কাজের দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয়। এ পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হতে পারলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এ পরীক্ষায় পাস করার পর কোরিয়ান ভিসা হাতে পান একজন কোরিয়া গমন ইচ্ছুক কর্মী।
আর জাপান যেতে হলে প্রথমে একজন কর্মীকে সে দেশের ভাষা শিখতে হয়। এই ভাষা শেখার জন্য বিএমইটির ৩৫টি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে (টিটিসি) প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। কর্মীদের দক্ষতাবিষয়ক বিশেষ পরীক্ষা (এসএসডাব্লিউ) দিতে হয়। বাংলাদেশি কর্মীদের গত বছর পর্যন্ত এই পরীক্ষা ভারতের দিল্লিতে গিয়ে দিতে হয়েছে। চলতি বছর এই পরীক্ষার কেন্দ্রটি রাজধানীর ধানমণ্ডিতে স্থাপন করা হয়েছে।
দক্ষ কর্মীর অভাবে রেমিট্যান্স বাড়ছে না উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশিদের প্রবাস আয় না বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক পাঠানো। পাশের দেশগুলো থেকে দেশের বাইরে যাঁরা কাজ করতে যান, তাঁরা মূলত দক্ষ হয়েই যান। এই জায়গায় আমাদের ঘাটতি রয়েছে। দক্ষ শ্রমিক যদি আমরা পাঠাতে পারি তাহলে প্রবাস আয় বেশি করা সম্ভব। ’
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর তথ্য মতে, অন্যান্য দেশের শ্রমবাজারের চেয়ে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বেশি আয় করা সম্ভব। কারণ এই দুটি দেশে শুধু দক্ষ কর্মী নেওয়া হয়। এ জন্য বেতনও ভালো। দক্ষতার ভিত্তিতে জাপানে একজন বাংলাদেশি শ্রমিক ঘণ্টায় ৭০০ থেকে ৯৫০ ইয়েন আয় করতে পারেন। জাপানে একজন বাংলাদেশি শ্রমিক দিনে আট ঘণ্টা কাজ করেন। এতে দিনে পাঁচ হাজার ৬০০ থেকে সাত হাজার ৬০০ ইয়েন আয় করা সম্ভব। মাসে তা দাঁড়ায় এক লাখ ৬৮ হাজার থেকে দুই লাখ ২৮ হাজার ইয়েন, যা বাংলাদেশি টাকায় এক লাখ ২৫ হাজার ৭২৭ টাকা থেকে এক লাখ ৭০ হাজার ৬৩০ টাকা। দক্ষিণ কোরিয়ায় শুরুতেই একজন শ্রমিক মাসে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৬০০ ওন আয় করতে পারেন, যা বাংলাদেশি টাকায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। এভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম বছরেই একজন শ্রমিক ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাসার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সৌদি আরব বা মালয়েশিয়ায় যেসব কর্মী যান, দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানে তা চলবে না। তারা চায় কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী। তাদের ভাষা জানাও বাধ্যতামূলক, যা মধ্যপ্রাচ্যের অঞ্চলগুলোতে নেই। ’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে যেসব কর্মী বিদেশে যান, বেশির ভাগ কম শিক্ষিত ও অসচ্ছল পরিবারের। তাঁরা ট্রেনিং নিয়ে সময় নষ্ট না করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে যেতে চান। যার ফলে আমরা চাইলেও ওই দেশগুলোতে সহজে কর্মী পাঠাতে পারি না। এর পরও কিছু কর্মীকে ট্রেনিং দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে পাঠাচ্ছি। আশা করি, একসময় ওই দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি কর্মী যাবেন। ’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক শহীদুল আলম বলেন, ‘জাপান, কোরিয়াসহ নানা দেশের দক্ষতার পরীক্ষা বিএমইটিই ব্যবস্থা করে থাকে। ফলে যেখান থেকে আসুক না কেন বিএমইটি তাদের চাহিদা পূরণ করছে। এখন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেও দক্ষ কর্মী পাঠাতে হবে। যখনই ঠিকমতো দক্ষ কর্মী যাওয়া শুরু করবে তখনই বোঝা যাবে আমরা কী পরিমাণ দক্ষ কর্মী তৈরি করেছি। ’
শরণার্থী ও অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের দক্ষ কর্মী তৈরির জন্য অনেক প্রশিক্ষণকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে—আমরা মূলত আনছি অদক্ষ কর্মীর ভিসা। কারণ যখন রিক্রুটিং এজেন্সি দক্ষ কর্মীর ভিসা আনবে, তখন অনেক ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি হবে। এই দায়বদ্ধতা যাতে না থাকে এ জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অদক্ষ ভিসায় কর্মী পাঠায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।